“আমার জন্ম হয় পার্টিতে” : মাওবাদী নারীরা

13TH_WOMAN_NAXAL-2_2655198f

সিপিআই (মাওবাদী) এ যোগদানকারী অন্ধ্র প্রদেশের প্রথম নারী কুরসেঙ্গা মোতিবাই ওরফে রাধাক্কা গত ১২ই ডিসেম্বর ২০১৫ জামিনে মুক্তি পান। তেলেঙ্গানা রাজ্যের আদিলাবাদের আদিবাসী গোন্ডি এই নারী ২৮ বছর আন্ডারগ্রাউন্ডে ছিলেন। খাম্মাম জেলায় গ্রেফতার হবার সময় তিনি বস্তারের বিভাগীয় কমিটির সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। মাওবাদীরা নিজেরাই তাদের অভ্যন্তরীণ একটি দলিলে স্বীকার করেছে যে খুব বেশী নারী দলে নেতৃত্বের অবস্থানে যেতে পারেননি; সেদিক থেকে রাধাক্কা ব্যতিক্রম। আরো বড় ব্যতিক্রম ছিলেন অনুরাধা গান্ধী যিনি শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্ব নিয়ে গঠিত ক্ষমতাধর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন।

সিপিআই (মাওবাদী) এর অভ্যন্তরীণ একটি দলিল থেকে অংশ বিশেষ নিম্নে উল্লেখ করা হলঃ

নারী ফ্রন্টে আমাদের কার্যক্রম এখনো সন্তোষজনক নয়। অনেক রাজ্যে নিয়োগের হার ভাল নয়, নারী ক্যাডারদের বাছাই-পদমর্যাদা-পদোন্নতি এখনো নিয়মানুগ পরিকল্পনা মাফিক নয়। নারীদের আন্দোলন গড়ে তোলা, ক্যাডার নিয়োগ দেয়া ও নারীদের থেকে নেতৃত্ব পর্যায়ে পদোন্নতি প্রদানের প্রয়োজনীয়তা এবং বিশাল সম্ভাবনার তুলনায় আমাদের প্রচেষ্টা অপ্রতুল। এই ক্ষেত্রে আমাদের প্রচেষ্টায় একটি শক্তিশালী প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে পিতৃতন্ত্র।  

সিপিআই (মাওবাদী) এর পূর্ববর্তী সিপিআই মার্কসবাদী-লেনিনবাদী (গণযুদ্ধ)/Communist Party of India –– Marxist-Leninist (People’s War) এর সময়ে নারী আন্দোলন গড়ে তোলা ও নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় নানাবিধ উদ্যোগ চিহ্নিত করেছিল মাওবাদীরা।

সেগুলো হলঃ

কৃষি শ্রমিক ও দরিদ্র খামারি নারীদেরকে ভূমি বন্টনের ক্ষেত্রে সমানাধিকার প্রদান।

স্বচ্ছল পরিবার থেকে উঠে আসা নারীদের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ও নিজে রোজগারকৃত সম্পত্তিতে সমানাধিকার।

সমান শ্রমের জন্য সমান মজুরী প্রদান।

নারীদের উপর শারীরিক নির্যাতন দূরীকরণ ও পতিতাবৃত্তির সম্পূর্ণ বিলোপসাধন।

নারীদের উপর অত্যাচার দূরীকরণ ও অপরাধীকে চরম শাস্তি প্রদান।

যৌতুক প্রথার বিলুপ্তি সাধন।

জাঁকজমকপূর্ণ বিবাহ অনুষ্ঠানের বিলুপ্তি ও সাদাসিধে, অসবর্ণ বিবাহ অনুষ্ঠান আয়োজনে উৎসাহ প্রদানের দাবী।

সরকারী চাকুরীতে নারীদের জন্য ৫০ শতাংশ কোটা বরাদ্দকরণ।

বালিকা ও সহশিক্ষা বিদ্যালয়গুলোতে বিনা বেতনে, বাধ্যতামূলক শিক্ষার জন্য সংগ্রাম করা।

শিক্ষা পদ্ধতিতে মেয়েদের প্রতি বৈষম্যের/বিকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করা।

লিঙ্গ নির্ণয় পরীক্ষা ও কন্যা ভ্রূণ হত্যার বিরুদ্ধে লড়াই করা।

কিশোর ও কিশোরীদের মধ্যকার বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করা।

নারীদের প্রতি অবমাননাকর ধর্মীয় প্রথার বিরুদ্ধে লড়াই করা।

‘ব্যক্তিগত আইন’ এর বিরুদ্ধে লড়াই করা।

গণমাধ্যম সহ সকল পর্যায়ে নারীদের মর্যাদাহানিকর উপস্থাপনের বিরুদ্ধে লড়াই করা।

একইভাবে, নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের আগমন ঘোষণা করার পর নারী আন্দোলন যে সকল দীর্ঘমেয়াদী কার্যক্রম হাতে নেবে সেগুলোও মাওবাদীরা চিহ্নিত করেছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছেঃ

সামাজিক উৎপাদনে নারীদের পূর্ণাঙ্গ অংশীদারিত্ব; যেমন, উৎপাদনে নারী ও পুরুষের মধ্যকার সম্পর্কের রূপান্তর।

গৃহস্থালী কর্মকাণ্ডে যৌথ ভূমিকা পালন।

গৃহস্থালী কাজে নারী ও পুরুষের যৌথ সম্পৃক্ততা।

রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ ও রাজনৈতিক ক্ষমতার যৌথ অনুশীলন।

ব্যক্তিগত সম্পদের/সম্পত্তির যৌথ সম্পদে/সম্পত্তিতে রূপান্তর ও পিতৃতন্ত্রের বিলোপ সাধনের সংগ্রাম।

ব্যক্তিগত, পারিবারিক ব্যবসা/কারখানার বিলুপ্তি সাধন করে যৌথ উৎপাদন ও মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা।

ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ও বিশ্ব জুড়ে নারী আন্দোলনসমূহকে সমর্থন প্রদান।

images

আন্ডারগ্রাউন্ডে নারীদের যোগদানের পিছনে প্রায়শঃ যে কারণগুলো উল্লেখ করা হয় তা হল, মাওবাদীদের বিভিন্ন স্কোয়াড গ্রামে ঘুরে ঘুরে বক্তব্য রাখে ও সাংস্কৃতিক দলগুলো বিপ্লবী গান শোনায়। এই অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য ও গান সংবেদনশীল বয়সে তাদের মনে দাগ কাটে। ২০০২ সালের বসন্তকালে সারিথা নামের ছটফটে মেয়েটি এই প্রতিবেদককে বলেছিল, “আমার গ্রামে ঘুরতে আসা মাওবাদী স্কোয়াডের উদ্দীপনামূলক ও জ্বালাময়ী গান আমাকে উৎসাহ যুগিয়েছিল”।

নারীদের কেউ কেউ তার পরিবারের সদস্যদের (স্বামী, ভাই, চাচা) দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েও মাওবাদী আন্দোলনে যোগদান করে। যেমন, উত্তর তেলেঙ্গানা বিশেষ জোনাল কমিটির সদস্য অনসূয়া। কোলের ছেলেকে শাশুরির কাছে রেখে এসে স্বামী কোমারাইয়াকে অনুসরণ করে তিনি মাওবাদী আন্দোলনে যোগদান করেন।

নেলাকোন্দা রাজিথার গল্পটা আবার ভিন্ন। তেলেঙ্গানার করিমনগর জেলার আন্ডার গ্র্যাজুয়েট ছাত্রীনেত্রী রাজিথা উত্তর তেলেঙ্গানা বিশেষ জোনাল কমিটির একমাত্র নারী সদস্য ছিলেন। আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকাকালীন তিনি সান্ডে রাজামৌলির সান্নিধ্যে আসেন এবং তাকে বিয়ে করেন। পরবর্তীতে রাজামৌলি কেন্দ্রীয় কমিটি ও কেন্দ্রীয় মিলিটারি কমিশনের সদস্য পদ লাভ করেন। ২০০২ সালের জুলাই মাসে একটি ‘বন্দুকযুদ্ধে’ রাজিথা নিহত হন এবং রাজামৌলি নিহত হন ২০০৭ সালের জুন মাসে। ৯০ এর দশক থেকে বর্তমান দশকে মাওবাদীদের ভেতরে নারী ক্যাডারের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।

Anuradha_Ghandy

মাওবাদীদের মাঝে প্রায় ৪০ শতাংশ নারীদের বড় অংশই এসেছে ভারতের গ্রামীণ ও আদিবাসী এলাকা থেকে এবং তারা যোদ্ধা। কেউ কেউ আছেন শহর থেকে আসা উচ্চশিক্ষিত তাত্ত্বিক নেতা। এই শ্রেণীর শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হিসেবে বলতে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের প্রভাষক অনুরাধা গান্ধীর নাম। সেরেব্রাল ম্যালেরিয়ায় মৃত্যুবরণ করার আগে সর্ব ভারতীয় নারী আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী অনুরাধা ছিলেন সিপিআই (মাওবাদী) এর কেন্দ্রীয় কমিটির একমাত্র নারী সদস্য। তিনি ছিলেন ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে দিল্লি থেকে গ্রেফতার হওয়া সিপিআই (মাওবাদী) এর পলিটব্যুরো্র সদস্য ও কেন্দ্রীয় প্রচারণা ব্যুরোর (Central Propaganda Bureau) প্রধান কোবাদ গান্ধীর স্ত্রী।

মাওবাদী পদে নারীদের যোগদানের পিছনে কোন একটি বিশেষ কারণ নেই। কেউ কেউ আন্ডারগ্রাউন্ডে যোগ দিয়েছেন হতাশা থেকে। গ্রামের উঁচু ও ক্ষমতাশালীদের কাছে নির্যাতিত হওয়াও আরেকটি কারণ। একটি পরিবারের সব বোনদের কিংবা একটি পরিবারের সকল সদস্যের বিপ্লবে যোগদানের উদাহরণও রয়েছে।

এই প্রতিবেদককে একজন নারী ক্যাডার বলেছিলেন, “পার্টিতে আমার জন্ম হয়”। তার বাবা মায়ের পরিচয় হয় আন্ডারগ্রাউন্ডে, এরপর বিয়ে। কয়েক বছর পর তার জন্ম হয়। কল্যাণ অধিদপ্তর পরিচালিত একটি স্কুলে তিনি পড়তেন আর ছুটিতে বাবা মায়ের সাথে দেখা করতে যেতেন। পরবর্তীতে তিনিও পার্টিতে যোগদান করেন ও আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যান। দণ্ডকারণ্যতে নানা ভাবে পিতৃতন্ত্রের অবসান ঘটানোর ক্ষেত্রে মাওবাদীদের সচেতন প্রচেষ্টা নারীদেরকে আন্ডারগ্রাউন্ডে কিংবা গণ সংগঠনে যোগদান করতে সহযোগিতা করেছে।

জোরপূর্বক বিয়ে এবং আত্মীয়দের (খালাতো/মামাতো/চাচাতো/ফুপাতো ভাই বোন) মধ্যে বিয়ে বন্ধ করার ক্ষেত্রে মাওবাদীরা বেশ সফল হয়েছে। বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে নারীরা মাওবাদে যোগদান করে। তারা মনে করে না যে পার্টিতে যোগদান করে তারা কোন ভুল করেছে। মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব, তৎকালীন সামাজিক অবস্থা, ব্যক্তিগত সমস্যা, আত্মীয় পরিবারের প্রভাব ও মতাদর্শগত অনুপ্রেরণা থেকে নারীরা মাওবাদে যোগদান করে। সমাজ পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা এতটা শক্তিশালী আকার ধারণ করে যে একটা পর্যায়ে গিয়ে তারা মাওবাদে যোগদান না করে পারে না।

maoists-chhattisgarh_edfc50c8-6ffa-11e5-9358-ce0f694bc37c

লিখেছেন পি ভি রামানা

১৫ ডিসেম্বর ২০১৫

অনুবাদ সূত্রঃ http://www.idsa.in/idsacomments/women-in-maoist-ranks_pvramana_151215



Leave a comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.