ভারতঃ মাওবাদী দমনের নামে বেপরোয়া জুলুম বস্তারে

jhargram-rape_1207_630

নতুন চেহারায়,নতুন ভঙ্গিমায় ছত্তিশগড়ে ফিরে আসছে সালওয়া জুদুম। ‘মাওবাদী’ আখ্যা দিয়ে চলছে নির্বিচারে সমাজকর্মী-সাংবাদিক-আইনজীবীদের ওপর আক্রমণ। আদিবাসী মানুষদের ধরপাকড়। হঠাৎই নিরুদ্দেশ হয়ে যাচ্ছেন নিরীহ গরিব আদিবাসীরা বস্তার থেকে! আদিবাসী মহিলাদের শ্লীলতাহানি, দল বেঁধে ধর্ষণ। অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধে। বি জে পি কর্মীদের বিরুদ্ধে। সামাজিক একতা মঞ্চ গড়ে তুলে মাওবাদী দমনের নামে যে কোন প্রতিবাদকে থামানোর চেষ্টা চলছে কয়েকমাস ধরেই। বি জে পি শাসিত ছত্তিশগড়ের মুখ্যমন্ত্রী রামন সিং ও তাঁর বশংবদ পুলিশের একটাই লক্ষ্য বস্তার, বিজাপুর, সুকমার খবর যাতে বাইরের পৃথিবীতে না আসে।

২০শে ফেব্রুয়ারি। জগদলপুর থেকে গিদমে নিজের বাড়ি ফিরছিলেন মানবাধিকার ও সমাজকর্মী-আপ নেত্রী সোনি সোরি। অতর্কিতে আক্রমণ, সোনি সোরির মুখে ছোঁড়া হয় সবুজ রঙের রাসায়নিক তরল। কালো মুখ নিয়ে সোনি সোরি দিল্লিতে, অ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। দীর্ঘদিন ধরেই বস্তার অঞ্চলে আদিবাসীদের মধ্যে কাজ করে আসছেন সোরি। মাওবাদী তকমা সেঁটে দিয়ে আদিবাসী মানুষদের ওপর পুলিশের অত্যাচার, জুলুমের বিরুদ্ধেও বারে বারে সরব হয়েছেন তিনি। সালওয়া জুদুমের বিরুদ্ধে লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে গেছেন সোরি। অভিযোগ করেছিলেন জেলে শারীরিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে। গত লোকসভা ভোটে বস্তার কেন্দ্র থেকে আপ-র প্রার্থী ছিলেন সোরি।

কয়েকদিন ধরেই চলছিল হুমকি। বাড়িতে ছোঁড়া হয়েছিল পাথর। সোরির পরিবারের লোকেদেরও দেওয়া হয়েছিল প্রাণনাশের হুমকি। বস্তার ছাড়তে হবে সোনি সোরিকে, অভিযুক্ত সেই বি জে পি কর্মীদের নিয়ে গঠিত ‘সামাজিক একতা মঞ্চ’। শেষ পর্যন্ত হামলা।

গত তিন বছর ধরে নিরীহ আদিবাসীদের ওপর পুলিশী জুলুম, মিথ্যা মামলায় তাদের সাহায্যের জন্য কাজ করছিলেন দুই মহিলা আইনজীবী শালিনী গেরা ও ইশা খান্ডেলওয়াল। গড়ে তুলেছিলেন ‘জগদলপুর লিগাল এইড গ্রুপ’। কয়েকমাস ধরে চলছে জগদলপুরে আদিবাসী মহিলাদের ওপর যৌন হেনস্তা, অভিযোগ এসেছে দলবদ্ধ ধর্ষণেরও। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অভিযুক্ত পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনী। শালিনী ও ইশাকে জগদলপুর ছাড়তে হয়েছে। পুলিশ বাড়িওয়ালাকে ডেকে বলেছে ওঁদের ভাড়া থেকে তুলতে।

একই অবস্থার শিকার হয়েছেন সাংবাদিক মালিনী সুব্রহ্মণ্যম। একসময়ে ছত্তিশগড়ে রেডক্রসের প্রধান ছিলেন মালিনী। নিরীহ আদিবাসীদের ওপর মাওবাদী অভিযোগ দেখে পুলিশের ধরপাকড়, ভুয়ো এনকাউন্টার, মিথ্যে আত্মসমর্পণের নাটক নিয়ে এখন নিয়মিত লিখছেন ওয়েব পোর্টাল স্ক্রল ডট ইন এ। বিজাপুরে আদিবাসী মহিলাদের ওপর পুলিশ-আধাসেনার যৌন আক্রমণ নিয়েও লিখেছিলেন তিনি। বারে বারে হুমকির মুখে পড়েছেন মালিনী। ‘সামাজিক একতা মঞ্চ’ গত ৬ই ফেব্রুয়ারি চড়াও হয় মালিনীর ভাড়াবাড়িতে। মালিনী নাকি মাওবাদীদের প্রতি সহানুভূতিশীল, এই অভিযোগে তাঁর বাড়িতে ঢিল ছোঁড়া হয়, গাড়ির কাচ ভাঙা হয়। চলতে থাকে অশ্রাব্য গালিগালাজ। আজ বস্তারে থাকেন না মালিনী। গত ১৯শে ফেব্রুয়ারি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন ছত্তিশগড়।

বস্তার ছাড়া হয়েছে বিশিষ্ট সমাজকর্মী বেলা ভাটিয়াও। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পি এইচ ডি, মুম্বাইয়ের ‘টাটা ইন্সটিটিউট অফ সোশ্যাল সায়েন্স’-র প্রাক্তন অধ্যাপিকা বেলা বিগত একবছর ধরে গরিব আদিবাসীদের মধ্যে কাজ করছিলেন। ২০০৬ সালে প্ল্যানিং কমিশন গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্যা ছিলেন বেলা, সেই একই কমিটিতে ছিলেন আজকের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালও! ছত্তিশগড়ের মাওবাদী সমস্যা নিয়ে সেই বিশেষজ্ঞ কমিটি বলেছিল গরিব আদিবাসী ও দলিত সম্প্রদায়ের সাথে সরকার, সমাজের মূলস্রোতের ধারাবাহিক বিচ্ছিন্নতার সুযোগেই মাওবাদীরা নিজেদের অবস্থান তৈরি করেছে। বেলা ভাটিয়ার বিরুদ্ধেও একই ভাবে মাওবাদীদের সহানুভূতিশীল অভিযোগে আক্রমণ, কুৎসা,হুমকি চালিয়ে গেছে ‘সামাজিক একতা মঞ্চ’। বেলা ভাটিয়াও এখন বস্তার ছাড়া। জগদলপুরের বাইরে এখন থাকেন তিনি।

আদিবাসীদের ওপর আক্রমণ, মাওবাদী অভিযোগে মিথ্যে মামলা, ভুয়ো সংঘর্ষে মৃত্যুর বিরুদ্ধে সরব হওয়া কন্ঠস্বরগুলিকে দমানো হচ্ছে বারে বারেই। দীর্ঘ হচ্ছে তালিকা। অভিযোগ মূলত দুটি সংগঠনের বিরুদ্ধে। পুলিশের প্রত্যক্ষ মদতে চলছে তাদের কাজ।

সালওয়া জুদুমের প্রাক্তন নেতা, এখন বি জে পি-র মাতব্বর মধুকর রাওয়ের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ‘নকশাল পীড়িত সংঘর্ষ সমিতি’ আর বস্তারের স্থানীয় নেতার ভাইপোর গড়ে তোলা ‘সামাজিক একতা মঞ্চ’।

গত কয়েক মাসে বস্তার, বিজাপুর, জগদলপুরে অজস্র মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলেও নীরব পুলিশ। একটা এফ আই আরও দায়ের হয়নি, তদন্ত দূর অস্ত। এত ঘটনা ঘটলেও দায় এড়িয়েছেন বস্তারের ইন্সপেক্টর জেনারেল কাল্লুরি।

‘বস্তারের মানুষ বাইরে থেকে আসা ওনাদের মেনে নিতে পারছিলেন না, সমাজকর্মীরা মাওবাদীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে পুলিশের অভিযানে বাধা দিচ্ছিলেন, এই ঘটনাগুলি তারই বহিঃপ্রকাশ’! সাফ সাফাই কাল্লুরির।



Leave a comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.