“ওয়াটার” – পুরুষতান্ত্রিক সমাজে
Posted: April 10, 2016 Filed under: নারী, লাল সংবাদ/Red News, সাহিত্য ও সংস্কৃতি | Tags: ওয়াটার, নারী, পুরুষতান্ত্রিক, water movie Leave a commentপুরুষতান্ত্রিক সমাজে বিধবা নারীর মর্মবেদনা ও ক্ষুব্ধ চৈতন্যের খণ্ডচিত্র- “ওয়াটার”
(ফেব্রুয়ারি, ২০০৭)
আমাদের দেশে প্রচলিত বাংলাদেশ-ভারতের সিনেমাগুলোতে নারী ও নারীর বিষয় নেই- এমন কথা কেউ নিশ্চয়ই বলবে না। বরং বলা ভাল নারীকে বিক্রি করেই এসব সিনেমা টাকা কামাচ্ছে। বাংলাদেশের ছবিগুলোতে কিছু ব্যতিক্রম বাদে অশ্লীল নামে পরিচিত ছবিগুলো ছাড়াও তথাকথিত ‘পরিচ্ছন্ন’ ছবিতেও নারীর ভূমিকা হলো পুরুষতান্ত্রিকতার অধীনে প্রেম করা, এবং কম-বেশি দেহ প্রদর্শন করে যৌন সুড়সুড়ি দেয়া। বোম্বের ছবিগুলোও তা-ই- শুধু কুশিলবদের দেহসৌন্দর্য, অভিনয় দক্ষতা, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও বিপুল অর্থব্যয়- এ সবের পার্থক্য ছাড়া।
এরই মাঝে কিছু ছবি প্রকৃতই ইতিবাচক চেতনার ছবি হয়ে ওঠে, এবং কিছু ছবি সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের নারীদের বঞ্চনা, লাঞ্ছনা, প্রতিবাদ ও সংগ্রামকে প্রগতিশীল ও আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে আন্তরিকভাবে ও সাহসের সাথে এই বিরুদ্ধ সমাজেও তুলে ধরে। তেমনি এক ছবি হলো ‘ওয়াটার’। ভারতীয় ব্যতিক্রমী ছবি-নির্মাতা দীপা মেহতার এই ছবি এখন অবশ্য ভারতে খুব ঝক্কি-ঝামেলার মধ্যেও মুক্তি পেয়েছে- যখন এটা অস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছে। আর বিশ্বের সর্ববৃহৎ ‘গণতন্ত্র’-র মুখে চুনকালি দিয়ে এ ছবির ইতিহাস বলছে যে, ভারতীয় নির্মাতার এ ছবির কাহিনী, কুশিলব এবং বিশেষত নির্মাতা ভারতীয় হলেও এটা ভারতীয় ছবি নয়। এ ছবি এখন কানাডার, এবং তার শুটিং-ও হয়েছে অন্য আরেক দেশ রাবণের শ্রীলংকায়- রামের ভারতে নয়।
ইতিহাসটা খুব পুরনো নয়। দীপা মেহতাও ভারতীয় সংস্কৃতি জগতে অপরিচিত নাম নয়। ২০০০ সালে ভারতের বারানসীতে দীপা মেহতা ছবিটির কাজ প্রথম শুরু করেছিলেন। বিখ্যাত অভিনেত্রী শাবানা আজমী, নন্দিতা দাস ও লগন-খ্যাত আমির খানকে নিয়ে তিনি কাজ শুরু করলেও বেশি দূর এগুতে পারেননি। প্রথম শুটিং-এই তারা আক্রান্ত হন। ফিল্ম-সেট পুড়িয়ে ফেলে নদীতে ডুবিয়ে দেয়া হয়। আক্রমণকারীরা দীপার কুশপুত্তলিকা দাহ করে। আক্রমণকারীরা আর কেউ ছিল না, তথাকথিত বৃহত্তম গণতন্ত্রের তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিজেপি’র নেতা-কর্মীরা এটা করে। এই হিন্দু-মৌলবাদী শাসক পার্টির সাথে অন্য সব হিন্দু মৌলবাদী এ ছবিকে ‘হিন্দু-বিরোধী’ বলে আখ্যায়িত করে। পরের কয়েক সপ্তাহ ধরে হিন্দু মৌলবাদীরা দেশজুড়ে এক ভয়ংকর অভিযান চালায় যাতে প্রত্যক্ষভাবে মদদ দেয় প্রধান সংবাদ-মাধ্যমগুলো। এ অবস্থায় সেট-টেট গুটিয়ে মাথা-মুড়ানো শাবানা আজমীসহ সবাইকে রাজ্য সরকার ওখান থেকে চলে যেতে বলে। দীপা অন্য রাজ্যে লোকেশনের সন্ধানে হন্যে হয়ে ঘোরেন। কিন্তু বিশাল ভারতে তিনি সে সুযোগ পান না। মৃত্যুর হুমকি ও অব্যাহত হামলার মুখে তার কাজ বন্ধ করে দিতে তিনি বাধ্য হন।
কিন্তু দীপা দমে যাননি। ৫ বছর পর তিনি আবার ছবিটিতে হাত দেন- কানাডিয়ান মালিকানায়, অন্য অভিনেতা-অভিনেত্রীকে নিয়েÑ আর শুটিং করেন শ্রীলংকায়। বিদেশেই এটা মুক্তি পায়; আর পেয়ে তা সোজা চলে যায় ’০৬-সালের অস্কার মনোনয়নে। ইতিমধ্যে ভারতে সরকার বদল হয়েছে। ভারতে প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক শক্তির চাপ, আর বর্তমান শাসক কংগ্রেস দল কর্তৃক বিজেপি-বিরোধী নিজেদের ‘মৌলবাদ বিরোধী’ ভাবমূর্তির স্বার্থে ভারতেও এটা এখন মুক্তি পেয়েছে। দীপা মেহতার এই ছবি নিয়ে এতবড় ভারতের এত বড় শাসক পার্টি, বিশেষত হিন্দু মৌলবাদীরা এতটা ক্ষিপ্ত কেন হলো? কী তার ‘হিন্দু-বিরোধী’ চরিত্র? এর আগেও ‘ফায়ার’ নামে একটা ছবি বানিয়ে তিনি হিন্দু-মৌলবাদীদের তোপের মুখে ছিলেন- যে ছবিতে হিন্দু-ধর্মশাস্ত্রানুসারে বর্তমান সমাজের এক পরিবারে গৃহবধু/নারীর যৌন বঞ্চনাকে তিনি তুলে ধরেছিলেন। তাই, ‘ওয়াটার’ ছবিকে ভারতীয় রাষ্ট্রের কর্ণধাররা শুরুই করতে দেয়নি।
* কী আছে এই ‘ওয়াটার’-এ?
ছবিটি তিনটি বিধবা নারীর বঞ্চনা ও ক্ষুব্ধ চৈতন্যকে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে পাতানো (এ্যারেঞ্জড্) বিয়ে, বিধবার মর্মবেদনা ও বিদ্রোহকে তুলে ধরেছে। এ ছবি হলো হিন্দু বলয়ে সামন্ত ঐতিহ্যের জীবন-ধ্বংসী নিষ্ঠুরতার কাহিনী। কাহিনীর সময়কাল ১৯৩৮-এ, যখন ভারতবর্ষ বৃটিশের উপনিবেশ ছিল, এবং ভারতীয় জনগণ স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করছেন। চুইয়া, কল্যাণী আর শকুন্তলা- এই হলো ছবির তিন প্রধান চরিত্র, তিন তরুণী বিধবা নারী। তারাসহ মোট ১৫জন বিধবাকে এক আশ্রম/প্রতিষ্ঠানে থাকতে দেয়া হয়। এখানে তাদের বঞ্চনা ও লজ্জার জীবন, জীবন-ধ্বংসী ও নিষ্ঠুর ধর্মীয় সামন্ত রীতি, এবং সেসবের বিরুদ্ধে তাদের বুঝে ওঠা ও উঠে দাঁড়ানো- এগুলোই এ ছবিতে উঠে এসেছে।
ছবি শুরু হয় চুইয়াকে দিয়ে- যে শিশু-বয়সে পাতানো-বিয়ের শিকার, ও কিছু পরেই বিধবা। বয়স তার মাত্র সাত। তাকে যখন এই বিধবা প্রতিষ্ঠানে তার বাবা রেখে যাচ্ছে তখন তার চুল কেটে মাথা কামিয়ে দেয়া হয়। এটাই রীতি, তার বৈধব্যের চিহ্ন- যা তার লজ্জাকে বহন করে চলে। সাত বছরের চুইয়া বুঝতেও সক্ষম নয় যে, এই চুলকাটা ও মাথা কামানোর মধ্য দিয়ে তার সমগ্র জীবন ভয়ংকরভাবে বদলে যাচ্ছে। তার লাল ব্রেসলেট ভেঙে ফেলা হয়, রঙিন কাপড়চোপড় কেড়ে নেয়া হয়। সাদা কাপড়ে ন্যাড়া মাথায় তাকে এখন থেকে সারাজীবন বৈধব্যের গ্লানির নিচে তার জীবন, যৌবন ও সকল কামনা-বাসনাকে মাটি চাপা দিয়ে চলতে হবে।
কারণ, হিন্দু শাস্ত্রমতে স্বামীর জীবিতকালে স্ত্রী তার অর্ধাঙ্গিনী; স্বামী মারা গেলে স্ত্রী তার লাশের অর্ধাঙ্গিনী। এ অবস্থায় ধর্ম ও সমাজ চুইয়ার সামনে তখন তিনটি পথ খোলা রেখেছিল- ১) মৃত স্বামীর সাথে সহমরণ- যা সতীদাহ প্রথা নামে পরিচিত ছিল; ২) পারিপার্শ্বিকতা অনুমোদন করলে দেবরকে বিয়ে করা; ৩) মাথা কামিয়ে সাদা কাপড়ে সাধারণ খাদ্য খেয়ে দিনের বেলায় ভিক্ষে করে আর রাতে শীতের মধ্যে শক্ত মেঝেতে শুয়ে দিন কাটানো। চুইয়াকে এখন এই তৃতীয়টির মধ্যে রেখে গেছে তার বাবা।
এখানে অন্য বিধবারা ছিল উচ্চ বর্ণের ব্রাহ্মণ গোত্রের। কিন্তু তাদেরকেও অস্পৃশ্যের মতই দেখা হতো। গঙ্গার পবিত্র পানিতে নিজেদের পাপ ধুয়ে পবিত্র হওয়া যায় বলে মনে করা হয়। এরকম এক সকালে স্নান সেরে ওঠা এক নারীর উপর এই বিধবাদের একজন দুর্ঘটনাবশত পড়ে যায়। সেই নারী রেগে গিয়ে বলে যে, বিধবাটি তাকে অপবিত্র করে ফেলেছে; তাই তাকে আবার স্নান করতে হবে। কিন্তু দ্রুতই দেখা যায় চুইয়া এ ব্যবস্থার মধ্যে এক বিদ্রোহী চেতনা/ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে। রীতির বিরুদ্ধে গিয়ে সে প্রশ্ন করে, “পুরুষ বিধবাদের জন্য এরকম বাড়ি কই?” সে রীতি ভঙ্গ করে মৃত্যু পথযাত্রী এক বিধবাকে নিষিদ্ধ মিষ্টি খেতে দেয়। এ সবের মধ্য দিয়ে তার বন্ধুত্ব হয় কল্যাণীর সাথে।
শকুন্তলাও চুইয়ার বিদ্রোহী সত্ত্বায় প্রভাবিত হয়। প্রথমদিকে সে চুইয়াকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু পরে সে নিজেও এই প্রতিরোধে সামিল হয়। তার স্পিরিট বাড়তে থাকে। তার নিজের ধর্মীয় বিশ্বাসকে সে প্রশ্ন করতে থাকে। এক পর্যায়ে তার সমগ্র ধর্মীয় মতবাদই তার কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। সে একে চ্যালেঞ্জ জানানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
কল্যাণী ন্যাড়া ছিল না, তার চুল রাখার অনুমতি ছিল। কারণ, রাতে তাকে দেহদানে বাধ্য করা হতো। এ থেকে আয় দিয়েই সে তার থাকা-খাওয়ার খরচ যোগাতো। তাই, অন্য বিধবাদের মত তাকে ভিক্ষা করতে হতো না।
প্রথমাবস্থায় কল্যাণীকে দেখায় ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। কিন্তু তার চোখে বিদ্রোহের ঝিলিক দেখা যায়। চুইয়ার সাথে একত্রে তারা নিষিদ্ধ কুকুরছানা পালতে থাকে। এভাবে তাদের জীবনমুখিতা বিদ্রোহের পথ পেতে থাকে।
কল্যাণী নারায়ণ নামের এক তরুণ আলোকপ্রাপ্ত স্বচ্ছল পরিবার-উদ্ভূত আইনজীবীর প্রেমে পড়ে। নারায়ণ ছিল ঐতিহ্যের রীতিতে অবিশ্বাসী। বিধবাবিবাহ নিষিদ্ধ এটা সে মানতো না। কল্যাণী এক পর্যায়ে নারায়ণকে বিয়ে করবে বলে ঘোষণা করলে বিদ্রোহ পুরোপুরি ফেটে পড়ে।
বিধবাদের মাঝে একজন মধুমতি, যে ছিল সর্দারনী ধরনের ও অত্যাচারী। এই বিদ্রোহের অপরাধে তার চুল কেটে দেয়, ঘরে আটকে রাখে এবং কল্যাণী-যে বিধবা সেই ‘লজ্জা’ যেন সে গোপন করতে না পারে তার ব্যবস্থা করে।
ছবির শেষটা রূপকাশ্রিত। এখানে নির্মাতা দীপা মেহতার দৃষ্টিভঙ্গি বোঝা যায়, যা গান্ধীর মতবাদে ভারতে নারীমুক্তি ঘটবে বলে তুলে ধরা হয়- নারায়ণের জবানীতে। এখানেই ছবির মতাদর্শিক ও রাজনীতিক মৌলিক সমস্যা। কারণ, এমনকি সে সময়টাতেও গান্ধীর চেয়ে অনেক মৌলিক ও প্রগতিশীল চিন্তা ভারতে কাজ করছিল। গান্ধীর মতবাদকে তুলে ধরাটা সেই সব প্রগতিশীল ও বিপ্লবী চেতনা থেকে পরিচালকের বিচ্ছিন্নতা ও গান্ধী সম্পর্কে বিভ্রান্তি ও মোহকে প্রকাশ করে।
* ছবির সময়কাল ১৯৩৮-এর বহু পর এখন ২০০৭ সাল। এই দীর্ঘসময়ে ‘স্বাধীন’ ভারতে গান্ধীর পথে নারীর মুক্তি ঘটেনি। বহু আইনই এখন নারীর পক্ষে হয়েছে বটে, কিন্তু, নারীর উপর পুরুষতান্ত্রিকতার নিপীড়ন বিভিন্ন রূপে রয়েই গেছে। আর ভারত-বাংলাদেশের মত তৃতীয় বিশ্বের এক বিরাট অংশে সেটা রয়েছে প্রায় ‘ওয়াটার’ ছবির সময়কালের মতই। পুরুষতন্ত্র ও ধর্মীয় মৌলবাদ- সে হিন্দু, মুসলিম বা খৃষ্টান যা-ই হোক না কেন, নব নব রূপে বিরাজ করছে শুধু তৃতীয় বিশ্বে নয়, তথাকথিত আধুনিক পশ্চিমা দেশগুলোতেও। ২০০১ সালের এক জরীপে দেখা যায়, ভারতে সাড়ে তিন কোটি বিধবা নারী রয়েছেন, যাদের অনেকেই এখনো পুরুষতন্ত্রের একই নিপীড়নে এবং জীবন-ধ্বংসী একই ব্যবস্থায় জীবন যাপন করছেন।
বিশেষত বাংলাদেশের পরিস্থিতিও একই। ভারতের সাথে বাংলাদেশের পার্থক্যটা শুধু দেশের নাম ও প্রধান ধর্মের নাম ও রীতির পার্থক্যে সীমাবদ্ধ। ‘ওয়াটার’ ছবির কাহিনীর চেয়ে সমাজের বহু পরিবর্তন ঘটলেও সারবস্তুতে নারী, বিশেষত বিধবা নারী- পাতানো বিয়ে, বৈধব্য জীবনের মর্মবেদনা, বঞ্চনা ও লজ্জার অবসান এখনো ঘটেনি। পুরুষতন্ত্র, পশ্চাদপদ ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও ধারণাগুলো যা সামন্তীয় ধর্মীয় ঐতিহ্যের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত- নারীকে এখনো ‘ওয়াটার’ ছবির চরিত্রগুলোর মতই তাড়িত করে।
ধর্ম ও ঐতিহ্য বলছে গঙ্গার জলে পাপ ধুয়ে যায়। কিন্তু ‘ওয়াটার’ বলছে, এই পবিত্র পানিতে তুমি ডুবে যেতেও পার।
[ আমেরিকার মাওবাদী পত্রিকা ‘রিভলিউশন’-এর ৪ জুন,’০৬ সংখ্যায় প্রগতিশীল সাংবাদিক-লেখিকা লি অনেস্টোর প্রতিবেদনের অনুসরণে লিখিত।]
Advertisements