আইলান ও আমাদের শাশ্বত শ্লোগান – শশাঙ্ক মিত্র
Posted: May 9, 2016 Filed under: লাল সংবাদ/lal shongbad, সাহিত্য ও সংস্কৃতি | Tags: আইলান, সাম্রাজ্যবাদ Leave a comment
প্রাচীন সভ্যতার পাদপীঠ মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থিত চাঁদের ফালি আকৃতির একটি ঐতিহাসিক অঞ্চল যা লেভান্ট, প্রাচীন মেসোপটেমিয়া ও প্রাচীন মিশর অঞ্চলের সমন্বয়ে গঠিত। সিরিয়াকে “Fertile Crescent”(উর্বর চন্দ্রকলা) হিসাবে প্রথম চিহ্নিত করেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতাত্ত্বিক জেমস হেনরি ব্রেস্টেড। আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বের কামড়াকামড়িতে ক্ষতবিক্ষত সেই উর্বর চন্দ্রকলা সিরিয়ার অধিবাসী আবদুল্লাহ কুর্দি ও রেহান কুর্দির দুই ছেলে আইলান ও গালিব। অন্যান্য পিতা-মাতার মত তাদেরও স্বপ্ন ছিল যুদ্ববিধ্বস্ত দেশ ছেড়ে উন্নত জীবনের আশায় সাগর পথে ইউরোপে চলে যাওয়া। সেখান থেকে কানাডাতে শরণার্থী হিসাবে আশ্রয় নেয়া। কিন্তু আব্দুল্লাহ ও রেহান কুর্দির সেই স্বপ্ন সাগরের ঢেউ ভাসিয়ে নিয়ে যায়। আইলান ও তার ভাই গালিব ও মা সহ তিনজনের সাগরে সলিল সমাধি ঘটে। নাইন ইলেভেন শুরুর পর থেকে ইরাক, আফগানিস্থান, সিরিয়াতে কত হাজার শিশুর লাশ ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে মাটির নিচে চলে গেছে তার হিসাব হয়তো কেউ রাখেনি। তিন বছরের আইলান সেই দিক থেকে ব্যতিক্রম। সাম্রাজ্যবাদী মিডিয়াগুলো আফগানিস্থানের বামিয়ান প্রদেশের প্রত্নমূর্তি বোমার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হলে যতটা সরব থাকে ততটা কিন্তু সরব থাকে না আফগানিস্থানে ড্রোনের আঘাতে ছিন্নভিন্ন অসহায় মানুষ নিয়ে। আফগানিস্থানের শিশুদের আইলানের মতো সাম্রাজ্যবাদী মিডিয়ার হটকেকে পরিণত হওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। মেডিটেরিয়ান সাগরের তীরবর্তী তুর্কির বোদ্রাম বীচে নিলুফার দেমিরের তোলা আইলানের চিরনিদ্রার ছবিটি সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনে তক্ষ-বিক্ষত নির্যাতিত মানুষের অসহায়ত্বের বহিঃপ্রকাশ। সেই অসহায়ত্ব নিয়ে সাম্রাজ্যবাদী মিডিয়াগুলো শুরু করে দেয় ব্যবসা। আর ফেসবুক, টুইটার সহ সোশ্যাল মিডিয়াগুলোর তো পোয়াবারো !! লাইক, কমেন্ট, শেয়ারের বন্যা চলতে থাকে !! সস্তা আবেগের প্রকাশ যত বেশি হয় ডলারের আনাগোনা তত বেড়ে যায়। আইলান নিয়ে মুহুর্মুহু সংবাদ প্রকাশিত হতে থাকে সে কিভাবে খেলাধুলা করত! সে সব সময় কিভাবে হাসিমুখে থাকতো! তার মেধা নিয়ে পান্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা! আরও কত কথা!! সে বেঁচে থাকলে কি হতো !!! বেনিয়ারা সবকিছু নিয়েই ব্যবসা শুরু করে আইলানের ছবি নিয়েও তাই ব্যবসা শুরু করে দিল। সাম্রাজ্যবাদী মিডিয়াগুলো সাম্রাজ্যবাদকে মানব দরদী ও মঙ্গলাকাঙ্খী হওয়ার পরামর্শ দিতে লাগল!! জনগণের ভোতা হয়ে যাওয়া অনুভূতিতে আঘাত দেয়া এই ছবিটি যাতে কোন প্রতিবাদ-প্রতিরোধের ভাষা তৈরি করতে না পারে সেজন্য সাম্রাজ্যবাদী মিডিয়াগুলো সিরিয়াসহ যুদ্ধ ডঙ্কায় বিপর্যস্ত জনগণকে প্রতিরোধের শক্তিতে বলীয়ান হওয়ার বদলে লাইফ জ্যাকেট পরে কিভাবে ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকায় সাগর পাড়ি দিতে হয় সেই কৌশল শেখানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি করা হচ্ছে যাতে মনে হচ্ছে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিলেই সুখপাখি চলে আসবে! এই যুদ্ধের মাঝেই সাম্রাজ্যবাদীরা তথাকথিত শান্তির মুলা ঝুঁলিয়ে রেখেছে। আর এই মুলা স্পর্শ করার নেশায় লক্ষ লক্ষ লোক সাগড় পাড়ি দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। ভাগ্যের অলিক পথ পাওয়ার আশায় গাদাগাদি করে ছোট ছোট নৌকায় সাগড় পাড়ি দিতে গিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা ছাড়া তাদের আর কোন উপায় থাকে না। আর সাম্রাজ্যবাদী মিডিয়াগুলো লাইফ জ্যাকেট পরিহিত সাগড় পাড়ি দিয়ে ইউরোপের মাটি স্পর্শ করা কোন এক তথাকথিত নাদুস-নুদুশ সফল পরিবারের! “ভি” চিহ্ন সম্বলিত ছবির প্রচার খুব জোরে শোরে করতে থাকে। এই প্রচারে সাগড় পাড়ি দেওয়ার লাইন আরো বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে লাইফ জ্যাকেটসহ আরো কত ব্যবসা !! মুক্তির আশায় মোহাচ্ছন্ন মানুষের এই বিভ্রান্তি প্রসঙ্গে কবি সুকান্তের কবিতার দু’টি লাইন খুবই প্রাসঙ্গিক…
মূর্খ তোমরা
লাইন দিলে :
কিন্তু মুক্তির বদলে কিনলে মৃত্যু,
রক্ত ক্ষয়ের বদলে পেলে প্রবঞ্চনা।
মৃত্যু আর রক্তক্ষয়ের এই স্রোতে শুধু ইরাক, আফগানিস্থান আর সিরিয়ার জনগণই শুধু নয় পুরো দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকাসহ আমাদের মত নয়া ঔপনিবেশিক আধা সামন্তবাদী দেশ থেকে লক্ষ লক্ষ কর্মহীন ও যুদ্ধ বিধ্বস্ত জনতা মুক্তির অলিক নেশায় সাগর পথে লাইন ধরেছে। সাগরে ভাসছে কত মহাদেশের মানুষের লাশ। আব্দুল্লাহ কুর্দি আর রেহান কুর্দি চেয়েছিলো মুক্তির সেই অলিক পথ। কিন্তু তারা পায়নি। আব্দুল্লাহ কুর্দি তার স্ত্রী ও দুই পুত্রকে হারিয়েছেন। আব্দুল্লাহ কুর্দি সেই লক্ষ জনতার একটি ক্ষুদে অংশ যারা “কোন মতে সংসার সিন্ধু” পার হতে ইচ্ছুক। সমাজ জাহান্নামে যাক। নিজে বাঁচলেই হলো। নীরবে সবকিছু সহ্য করা সেই শিথিল সুবিধাবাদী মানুষগুলোর জন্য সাম্রাজ্যবাদীরা যে ফাঁদ পেতে রাখবে সেটাই তো স্বাভাবিক। সেই ফাঁদে মৃত্যু একটি স্বাভাবিক ঘটনা কিংবা একটি সংখ্যা। সাম্রাজ্যবাদীরা অন্যায় যুদ্ধ শুরু করার সাথে সাথেই জনগণের প্রতিরোধের হাতিয়ার যাতে শাণিত না হয় সেজন্য একতা ভাঙ্গনের ল্েয পলায়ন প্রবণতা সৃষ্টি করে সেই পলায়ন প্রবণতার পরিণতিই হচ্ছে শরণার্থী। শরণার্থী মানেই ধুকে ধুকে মৃত্যু। দাস খত দিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার। সস্তা শ্রমের মজুত বাহিনী। স্কিল্ড মাইগ্রেশন, ষ্টুডেন্ট ভিসা ইত্যাদি চটকদার প্যাকেজের আওতায় সাম্রাজ্যবাদ চায় মেধা পাচার, সস্তা শ্রম আর আগামী দিনের যুদ্ধের সৈনিক। জমে ঊঠেছে টোফেল, আইএলটিএস, জিআরই এর রমরমা ব্যবসা!! যুদ্ধ বিধ্বস্ত ও কর্মহীন জনগণের সামনে দেশে দেশে এভাবেই সাম্রাজ্যবাদীরা লাইফ জ্যাকেট আর আইএলটিএস এর ফাঁদে পেতে রেখেছে। আইলানের নিথর চিরনিদ্রার ছবি সাম্রাজ্যবাদের সেই ফাঁদের।
লেনিন সাম্রাজ্যবাদকে মুমূর্ষু পুঁজিবাদ হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। মুমূর্ষু পুঁজিবাদ তথা সাম্রাজ্যবাদ অতি উৎপাদনজনিত সমস্যা থেকে বাঁচার জন্য বাজার দখল ও পূনর্দখল ছাড়া তার আর কোন উপায় থাকে না। যুদ্ধ তাই অনিবার্য। এখানে জনগণের চাওয়া-পাওয়া ও আকাঙ্খার কোন মূল্য নাই। মার্কিন, ইউরোপ ও রাশিয়ার মারণাস্ত্র তৈরির কারখানাগুলোর জন্য প্রয়োজন যুদ্ধ। অর্থাৎ ‘যত রক্ত তত ডলার’। কমরেড আবদুল হক অনেক আগেই এই শিরোনামে একটি লেখাটি লিখে তৎকালীন বিশ্ব পরিস্থিতির মার্কসবাদী বিশ্লেষণ করেছেন। আইলান সাম্রাজ্যবাদের এই মূলনীতির শিকার। আইলানের মৃত্যু নিয়ে তাই মানব বন্ধন, গোলটেবিল আলোচনা আর মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করে কোন লাভ হবে না। সাম্রাজ্যবাদের নির্মম যাঁতাকলে পিষ্ট শ্রমিক-জনতাকে শরণার্থী আর স্কিল্ড মাইগ্রেশনের প্যাকেজের বেড়াজালে বন্দী না হয়ে মৃত্যু ভয়কে পায়ে ঠেলে প্রতিশোধের বহ্নিশিখা জ্বালাতে হবে।
আইলান আমাদের চেতনাকে উজ্জ্বীবিত করুক নিকোলাই অস্ত্রভস্কির শ্বাশত আহ্বানে সেই প্রত্যাশায় ……
মৃত্যু সেতো হেঁটেই চলেছে জীবনের পাশাপাশি
তাই মৃত্যু তেমন কষ্টসাধ্য ব্যাপার নয় কোন
তার চেয়ে নির্মম নিষ্ঠুর অনেক কষ্টসাধ্য
দাসত্বের শৃঙ্খল পড়ে নতজানু হয়ে নীরবে
নিঃশব্দে বেঁচে থাকা…………………………………।
সূত্রঃ