কৃষক নারীদের জীবন
Posted: May 28, 2016 Filed under: নারী, লাল সংবাদ/lal shongbad | Tags: কৃষক নারী, কৃষি Leave a comment
কৃষক নারীদের জীবন
আমাদের দেশের জনগোষ্ঠীর অর্ধেক হচ্ছেন নারী। এই নারী সমাজের শতকরা প্রায় ৭০ ভাগই গ্রামীণ কৃষক নারী।বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় গ্রামীণ কৃষক নারীরা সবচাইতে বেশি নিপীড়িত-নির্যাতিত অংশ। শহরের শ্রমিক নারী ও অন্যান্য শ্রেণির নারীরা কিছুটা সুযোগ-সুবিধা পেলেও গ্রামীণ কৃষক নারীরা এখনো মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিক বহু শৃংখলে ব্যাপকভাবে বাঁধা পড়ে আছেন। পাশাপাশি দেশি-বিদেশি পুঁজিবাদের শোষণ-নিপীড়নও তাদের উপর রয়েছে।
নারীরা ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় বিধানমতে জমি-সম্পত্তির অধিকার পান না, বা অর্ধেক পান। কিন্তু গ্রামীণ নারীদের অধিকাংশ তাদের এই অর্ধেক সম্পত্তির অধিকারও প্রায় ক্ষেত্রেই ভোগ করতে পারেন না। এই অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার কারণে নারীদেরকে বাল্যকালে পিতার, বিয়ের পরে স্বামীর, এবং বৃদ্ধ বয়সে ছেলের অধীন থাকতে হয়। সারা জীবন নারীকে কোনো না কোনো পুরুষের কর্তৃত্ব মেনে অর্থাৎ অধীনস্থ হয়ে থাকতে হয়। ফলে তাদের মত প্রকাশের বা তা প্রতিষ্ঠারও সত্যিকার কোন স্বাধীনতা থাকে না।
প্রচলিত সমাজের এই নীতি অনুযায়ী নারীর উপর শোষণের আরেকটি হাতিয়ার হচ্ছে যৌতুক প্রথা। গরীব কৃষক বা দরিদ্র শ্রেণীর মেয়েদের বিয়ে দিতে দরিদ্র পিতাকে হিমশিম খেতে হয়। ভিটেবাড়ি বিক্রি করে বা ভিক্ষা করে যৌতুক দিতে হয়। পুরুষের জন্য একত্রে একাধিক স্ত্রী রাখার বিধান রাখা হয়েছে। যখন-তখন তালাক দেয়ার অধিকার পুরুষকে দেয়া হয়েছে। অথচ নারী যখন দ্বিতীয় বিয়ে করতে যান সমাজে তাকে বহু কটু কথা শুনতে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সমাজচ্যুতও করা হয়।
সন্তানের প্রতিও নারীর সত্যিকার অধিকার নেই। সন্তানের প্রতি একচ্ছত্র অধিকার রাখা হয়েছে পুরুষের। সন্তান ধারণ, লালন-পালন থেকে যাবতীয় দায়িত্ব পালন করেন নারী, আর সন্তান পরিচিত হয় পিতার নামে। নারী নিজেও পরিচিত হন স্বামীর পরিচয়ে, বা ছেলে সন্তানের পরিচয়ে। স্বামী-স্ত্রীর তালাক হয়ে গেলে স্ত্রী চাইলেও সন্তান প্রায় ক্ষেত্রেই নিজের কাছে নিতে পারেন না। বিশেষত তা যদি হয় ছেলে-সন্তান। বুর্জোয়া শ্রেণির সরকার ইদানীং নারী অধিকারের ভড়ং দেখাতে সন্তানের পরিচয়ে পিতার নামের পাশে মা’র নাম দেয়ার নিয়ম চালু করেছে। যা সত্যিকার অর্থে পিতৃতান্ত্রিকতার কোনো পরিবর্তন ঘটায় না।
কৃষক নারীরা গৃহে সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করলেও তাদের শ্রমের কোন মর্যাদা দেয়া হয় না। তারা ঘরে রান্না-বান্না ও সন্তান প্রতিপালনের কাজ ছাড়াও সংসারের কৃষি-কাজেও অংশ নেন। এভাবে তাদেরকে কার্যত দ্বিগুণ পরিশ্রম করতে হয়। কিন্তু খাওয়া-খাদ্যের ভাল অংশটুকু তাদের ভাগ্যে জোটে না; সেগুলো স্বামী ও ছেলে-সন্তানের জন্যই রেখে দিতে হয়।
ক্ষেতে-খামারে, কৃষি কাজে মজুরী খাটা নারী, মাটিকাটা, ইটভাঙা, রাস্তা মেরামতী, যোগালীর কাজে নারীরা সমশ্রমে সমমজুরী পান না।
ব্যক্তিমালিকানাধীন শ্রেণি বিভক্ত সমাজে তারা শ্রেণি-শোষণের যাঁতাকালে নিস্পেষিত-তো হচ্ছেনই, তার উপর তাদের উপর চেপে বসে আছে উপরোক্ত ধরনের বহুবিধ পুরুষতান্ত্রিক শোষণ-নিপীড়ন। কৃষক নারী সমাজ এই দ্বৈত শোষণে জর্জরিত হয়ে দিনাতিপাত করছেন। তাদের জীবনে নেই কোন স্বাধীনতা, মত প্রকাশ ও প্রতিষ্ঠার অধিকার, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বা বিনোদন। সমাজ-সভ্যতার পর ব্যক্তিমালিকানাধীন সমাজের উদ্ভব থেকেই তাদের জীবনে এই চরম দুর্দশা নেমে আসে। ব্যাপক কৃষক নারীদের এই চরম দুর্দশা থেকে মুক্তি দিতে পারে একমাত্র সাম্যবাদী সমাজ ব্যবস্থা। যেখানে নারীর সাথে সাথে সকল নিপীড়িত পুরুষও মুক্তি পাবেন শ্রেণি-বিভক্ত সমাজের শোষণ-বঞ্চনা থেকে।
সেজন্য কৃষক নারীদেরকে পুরুষের পাশাপাশি সচেতন ও সংগঠিত হতে হবে। কৃষকের শত্রু সাম্রাজ্যবাদ-সম্প্রসারণবাদ, আমলা-মুৎসুদ্দি পুঁজিবাদ ও সামন্ততন্ত্র উচ্ছেদ করার লক্ষ্যে কৃষকদের নিজস্ব সংগঠন “কৃষক মুক্তি সংগ্রাম”-এ ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এবং সংগ্রামে এগিয়ে আসতে হবে।
– ৩০/০১/’১০
সূত্রঃ কৃষক সমস্যা ও কৃষক সংগঠন সম্পর্কে, কৃষক মুক্তি সংগ্রাম কর্তৃক প্রকাশিত