আজ প্যারী কমিউন এর ১৪৫তম বার্ষিকী! ১৮.০৩.১৮৭১ / ১৮.০৩.২০১৬

ico-commune-1

প্যারী কমিউন‘ লাল সালাম-
১৮ মার্চ, ২০১৬- ১৪৫ তম প্যারী কমিউন বিপ্লব দিবস

এক ঐতিহাসিক পটভূমিতে ১৮৭১ সালের ১৮ মার্চ ফ্রান্সের রাজধানী প্যারীর বীর শ্রমিকশ্রেণী বুর্জোয়া শাসন ব্যবস্থাকে চূর্ণ করে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে গঠন করে এক ঐতিহাসিক প্যারী কমিউন। ১৮৭০ সালে ফ্রাঙ্কো-প্রুশিয়া যুদ্ধে লুই নেপোলিয়ান পরাজিত হলে ফ্রান্সে থিয়ার্সের নেতৃত্বে বুর্জোয়া সরকার ক্ষমতায় আসে। তারা জার্মানীর সঙ্গে আঁতাত করে প্যারিসের শ্রমিকশ্রেণীকে নিরস্ত্র (১৮ মার্চ) পদক্ষেপ গ্রহণ করলে প্যারিসের শ্রমিকশ্রেণী ও জনগণ এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। ফলে বুর্জোয়া শ্রেণীর সাথে সর্বহারা শ্রেণীর গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। প্যারিসের বীর শ্রমিকশ্রেণী পুরাতন রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে গঠন করে ঐতিহাসিক প্যারী কমিউন। ২৬ মার্চ প্যারী কমিউন নির্বাচিত এবং ২৮ মার্চ তা ঘোষণা করা হয়। প্যারী শ্রমিকশ্রেণী ৭৩ দিন এই ক্ষমতা দখল করে রাখতে সমর্থ হয়। কিন্তু থিয়ার্সের নেতৃত্বে ফরাসী বুর্জোয়া শ্রেণী বিসমার্কের নেতৃত্বে প্রুশিয়ার বুর্জোয়া শ্রেণীর সাথে সমন্বিত হয়ে বর্বরতম আক্রমণ চালিয়ে রক্তের বন্যায় প্যারী কমিউনকে ধ্বংস করে।

প্যারী কমিউন ধ্বংস হলেও শ্রমিকশ্রেণীর সামনে প্যারী কমিউনের শিক্ষা অজেয় ও অমর। মহামতি কার্ল মার্কস্ প্যারী কমিউনের এই অভিজ্ঞতার পর্যালোচনা ও সারসংকলন করেন তাঁর বিখ্যাত ‘ফ্রান্সের গৃহযুদ্ধ’ পুস্তকে। কার্ল মার্কস্ ১৮৭১ সালের ১২ এপ্রিল কুগেলম্যানকে লেখা এক চিঠিতে প্যারীবাসীর এই ঐতিহাসিক বীরত্ব তুলে ধরে বলেন, “কি স্থিতিস্থাপকতা, কি ঐতিহাসিক উদ্যোগ, ত্যাগ স্বীকারের কি সামর্থ্য এই প্যারিসবাসীদের।…….

অনুরূপ মহত্ত্বের অনুরূপ দৃষ্টান্ত ইতিহাসে আর মেলে না……। যাই হোক না কেন পুরানো সমাজের নেকড়ে বাঘ, শুয়োর ও খেকী কুকুরেরা যদি প্যারীর বর্তমান অভ্যুত্থানকে পিষে চুরমার করে দেয় তা হলেও প্যারিসের জুন বিদ্রোহ (১৮৪৮ সালের জুন মাসে প্যারিসের শ্রমিকশ্রেণীর বিদ্রোহ)-এর পর এটি পার্টির সর্বোত্তম মহাকীর্তি।” কার্ল মার্কস্ অংশগ্রহণকারী (কমিউনার্ড)-দের এই যুদ্ধকে “স্বর্গ অধিকারের অসমসাহসী অভিযান” বলে শুধু প্রশংসাই করেন নাই, এর বৈপ্লবিক গুরুত্ব ও তাৎপর্যকে সামনে এনেছেন। কমিউন হলো শ্রমিকশ্রেণীর ক্ষমতা দখলের প্রথম প্রচেষ্টা। মহামতি লেনিন বলেন, “বুর্জোয়া রাষ্ট্রযন্ত্র বিধ্বস্ত করবার জন্য সর্বহারা বিপ্লবের প্রথম প্রচেষ্টা হলো প্যারী কমিউন। এই কমিউনই হলো ‘অবশেষে আবিষ্কৃত’ সেই রূপ যা ধ্বংসপ্রাপ্ত রাষ্ট্রযন্ত্রের স্থান দখল করতে পারে এবং অবশ্যই করবে।” ফ্রান্সের গৃহযুদ্ধ বইতে মার্কস্ বলেন, “কমিউন ছিল মূলতঃ শ্রমিকশ্রেণীর নিজস্ব সরকার। অপরের শ্রমফল আত্মসাত করে যারা ভোগ-দখল করছে তাদের বিরুদ্ধে উৎপাদক শ্রেণীর যে সংগ্রাম এই কমিউন ছিলো সেই সংগ্রামেরই ফল বিশেষ; যে রাজনৈতিক রূপে শ্রমিকশ্রেণীর আর্থিক মুক্তি সম্ভব হতে পারে কমিউন ছিলো অবশেষে আবিষ্কৃত সেই রূপ।” মার্কস্ এই প্যারী কমিউনকে সর্বহারা শ্রেণীর এক বাস্তব রূপ হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। মহামতি ফেডারিখ এঙ্গেলস ১৮৯১ সালে প্যারী কমিউনের ২০তম বার্ষিকীতে বলেন, “সম্প্রতি সর্বহারা একনায়কত্ব শব্দটির প্রতি সোস্যাল ডেমোক্রেটিক কূপমন্ডকরা ভীত-সন্ত্রস্থ হয়ে পড়ে। ঠিক আছে ভদ্র মহোদয়গণ, এই একনায়কত্ব দেখতে কেমন তা কি আপনারা জানতে চান? প্যারী কমিউনের দিকে তাকান। এটাই সর্বহারা একনায়কত্ব।” প্যারী কমিউনের একটা মূল শিক্ষাকে সামনে তুলে ধরে মার্কস্ এবং এঙ্গেলস বলেন, “কমিউন বিশেষভাবে একটি বিষয় প্রমাণ করেছে তা হলো এই যে, শ্রমিকশ্রেণী আগে তৈরী রাষ্ট্রযন্ত্র শুধু করায়ত্ব করে তার উদ্দেশ্য সাধন কাজে লাগাতে পারে না।” এই মূল শিক্ষাকে ১৮৭২ সালে কমিউনিস্ট ইশতেহারের জার্মান সংস্করণের ভূমিকায় মার্কস্-এঙ্গেলস সংযোজিত করেন। মার্কস্ প্যারী কমিউনের যে বৈশিষ্ট্যসমূহ তুলে ধরেছেন তা হচ্ছে- কমিউন বুর্জোয়া পার্লামেন্টের মত একটা সংসদ নয়। এটা একই সাথে আইন প্রণয়নকারী ও কার্যনির্বাহী সংস্থা সেখানে প্রতিনিধি নির্বাচন করা ও ফিরিয়ে আনা (Recall)-র অধিকার জনগণের থাকে, রাষ্ট্রের কর্মচারীদের বেতন শ্রমিকদের বেতনের সমান করা, জনগণকে সশস্ত্র করা ইত্যাদি।

প্যারী কমিউনের দিকে তাকালে দেখা যায় প্যারী শ্রমিকদের পরাজয়ের ক্ষেত্রে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ত্রুটি ঘটে। ক্ষমতা দখলের সঙ্গে সঙ্গে প্যারিসের শ্রমিকশ্রেণীর জরুরী কর্তব্য ছিল ব্যাংক অফ ফ্রান্স দখল করে নেওয়া। ব্যাংক দখল করে নিলে অর্থের থলেটা আর বুর্জোয়াদের হাতে থাকত না। এটা না করাটা একটা বড় ভুল। আরেকটা বড় ভুল হলো বুর্জোয়াদের মার্সেলাইসে সংঘবদ্ধ হয়ে শক্তি সঞ্চয়ের পূর্বেই আক্রমণ করে তাদের শক্তিকে বিধ্বস্ত না করা। এই দুই ক্ষেত্রেই প্যারীর শ্রমিকশ্রেণী শত্রুর প্রতি উদারতাবাদের প্রশ্রয় দেয়। প্যারী কমিউনের এই ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে প্রতিটি দেশের শ্রমিকশ্রেণীকে অগ্রসর হতে হবে।

প্যারী কমিউনের এই শিক্ষাকে সামনে রেখে মহামতি লেনিনের নেতৃত্বে ১৯১৭ সালের ৭ নভেম্বর রাশিয়ায় সর্বহারা বিপ্লব সংঘটিত হয় এবং সর্বহারা একনায়কত্বের বাস্তব রূপ হিসেবে সোভিয়েত প্রতিষ্ঠিত হয়। লেনিন বলেন, “শ্রমিক-কৃষকের সোভিয়েত হচ্ছে নতুন ধরনের রাষ্ট্র, নতুন এবং উচ্চতর ধরনের গণতন্ত্র, সর্বহারা একনায়কত্বের একটি রূপ, বুর্জোয়া শ্রেণীর বিরুদ্ধে এবং বুর্জোয়া বাদ দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার একটি উপায়।” (আমেরিকার শ্রমিকশ্রেণীর প্রতি চিঠি, লেনিন; ২৮ খন্ড পৃষ্ঠা-৭৩)। আজ সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়াও নেই। পৃথিবীতে কোন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা নেই। বুর্জোয়া স্বার্থের ধারক-বাহক রং-বেরং-এর সংশোধনবাদী এবং পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের পরিণতিতে সাময়িকভাবে সমাজতন্ত্রের পরাজয় ঘটলেও প্যারী কমিউন ও রুশ বিপ্লবের শিক্ষা এবং মার্কসবাদ-লেনিনবাদ অজেয়-অমর। এর থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে বিশ্ব শ্রমিকশ্রেণীকে অগ্রসর হতে হবে। বিশ্বে আজ সর্বহারা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ও জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব তথা বিশ্ববিপ্লবের পদধ্বনি নতুন করে শোনা যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী এই দুই বিপ্লবী ধারা মিলিত হয়ে এক সামগ্রিক বিশ্ববিপ্লবী ধারা সৃষ্টির আয়োজন চলেছে। এই পরিস্থিতিতে প্যারী কমিউন নতুন মহিমায় নতুন গৌরবে সামনে এসে দাঁড়াবে। এরই আয়োজন চলছে সর্বক্ষেত্রে। লাল সালাম প্যারী কমিউন

প্যারী কমিউন বিপ্লব

প্যারী কমিউন বিপ্লব