সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া প্রত্যেক নাগরিকের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করেছিল

Soviet-sasthya-2-768x623

নভেম্বর বিপ্লব পূর্ববর্তী রাশিয়ার স্বাস্থ্য পরিষেবা ছিল যৎসামান্য এবং তা অতি সাধারণ মানের৷ যেটুকু ছিল তা ভোগ করত সে দেশের সম্রাট বা জার এবং অভিজাত শ্রেণি৷

গরিবের ভরসা ছিল শিক্ষা–দীক্ষাহীন গ্রামীণ চিকিৎসক, গ্রামের যাজক এবং ঈশ্বর!  রোগ হলে ঈশ্বরের কাছে চোখের জল ফেলা আর প্রিয়জনের শেষযাত্রায় যোগ দেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না৷ কলেরা, স্মলপক্স, টাইফাস, যক্ষ্মা ও সূতিকা জ্বরে লক্ষ লক্ষ মানুষ জারশাসিত রাশিয়ায় অসহায়ভাবে প্রাণ হারাত৷ শিশু মৃত্যুর হার ছিল প্রতি হাজারে ২৬০ জন৷ মানুষের মৃত্যুর হার ছিল হাজার প্রতি ২৯.৪ জন

১৯১৩ সালে ৪,৩৬৭টি গ্রামীণ মেডিকেল স্টেশনে ৪,৫৩৯টি স্বাস্থ্য সহকারী (ফেল্ডসার) জাতীয় পদ ছিল এবং ৮ কোটি গ্রামীণ জনসাধারণের জন্য ছিল ৪৯০৮৭টি হাসপাতাল শয্যা৷ সারা দেশের শয্যা সংখ্যা ছিল ২,০৭,৩০০টি৷ প্রতি হাজারে ১.৩টি শয্যা৷ ওই সালের হিসাবে সমগ্র রাশিয়ার ১৫ কোটি  ৯২ লক্ষ লোকের জন্য ২৩,১৪৩ জন মাত্র চিকিৎসক ছিলেন, অর্থাৎ গড়ে ৬৯০০ লোক প্রতি ১ জন ডাক্তার৷ গ্রামে ১৮৫০০ জনে ১ জন ডাক্তার৷ ফেল্ডসার সংখ্যা ছিল ২৯,০০০, ছিল ১০,০০০ নার্স এবং ১৫,০০০ মিডওয়াইফ৷ হাসপাতালগুলির অবস্থান ছিল পরিকল্পনাবিহীন, এলোমেলো৷ ৩৫ শতাংশ শহরে কোনও হাসপাতাল ছিল না৷ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধাক্কায় এই নগণ্য স্বাস্থ্য  কাঠামোরও  বড়  অংশ  ধ্বংস  ও  অকেজো  হয়ে যায়৷

বিপ্লবের পর স্বাস্থ্যব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন

১৯১৭ সালে নভেম্বর বিপ্লবের পর সোভিয়েত ব্যবস্থায় চিকিৎসা মানুষের অধিকারে পরিণত হয়৷ সোভিয়েত সমাজে মায়েদের জন্যে দেশের শহর ও গ্রামাঞ্চলে প্রতি এলাকায় মাতৃমঙ্গল কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা হয়েছিল৷ অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের চিকিৎসার সব প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা, ভয় দূর করা, হাসপাতালে প্রসব করানো প্রভৃতি এই কেন্দ্রগুলি করত৷

বিনামূল্যে সর্বদা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসার পরিষেবা ছিল৷ এ সময় ছিল মায়েদের চাকরি থেকে ৭৭ দিন সবেতন ছুটি৷ ডাক্তার পরামর্শ দিলে তবেই কাজে যোগদান৷ অন্তঃসত্ত্বা অবস্থার চতুর্থ মাস থেকে ওভারটাইম কাজ বন্ধ৷ প্রসবের পর প্রত্যেক মাকে কাজের সাড়ে তিন ঘন্টা অন্তর আধঘন্টা ছুটি দেওয়া হত শিশুকে স্তন্যপান করানোর জন্য৷ মাকে রাতের শিফটে কাজ দেওয়া বন্ধ থাকত৷ অন্তঃসত্ত্বা অবস্থার ছয় মাস থেকে প্রসবের পর চার মাস পর্যন্ত প্রত্যেক মায়ের রেশন দ্বিগুণ করে দেওয়া হত৷ শিশুর জামাকাপড় কেনার জন্য এবং এক বছর বয়স পর্যন্ত খাওয়ার জন্য মাকে নগদ টাকা সাহায্য করা হত৷ ২ মাস থেকে ৫ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের ক্রেশে রাখার ব্যবস্থা ছিল৷

শিশুদের এই ক্রেশগুলি ছিল অতুলনীয়৷ শুধু রোগ প্রতিরোধ আর চিকিৎসাই নয় প্রতিটি শিশুর সার্বিক বিকাশের অভূতপূর্ব বন্দোবস্ত করেছিল সোভিয়েত দেশ৷ সারা দেশে শিশুদের দেখার জন্য শিশু বিশেষজ্ঞ এবং ডিসপেনসারি ও পলিক্লিনিক ছিল৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বেই শিশুমৃত্যুর হার, পুষ্টি, টিকাকরণ সহ সব মাপকাঠিতে উন্নত  পুঁজিবাদী দেশগুলিকে ধরে ফেলেছিল সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন৷ ক্রস ইনফেকশন রোখার জন্য ছিল সর্বাধুনিক বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থা৷

সোভিয়েত রাশিয়ায় প্রথমেই জোর দেওয়া হয়েছিল অধিক সংখ্যায় উপযুক্ত মানের ডাক্তার তৈরিতে৷ তার পাশাপাশি নার্স এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ফেল্ডসার (সহকারী চিকিৎসক) তৈরিতে গুরুত্ব দেওয়া হত৷ ১৯৮০ সালে দেশে ৮৩টি মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগ হিসাবে আরও ৯টি মেডিকেল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়ে যায়৷ ১৯৮৬ সালে দেশে চিকিৎসক সংখ্যা দাঁড়ায় ১২ লক্ষ৷ ১ লক্ষ জনসাধারণ পিছু ৪৩০ জন ডাক্তার, যা বিপ্লবপূর্ব রাশিয়ায় ছিল ১ লক্ষ মানুষ পিছু ১৪.৫ জন মাত্র৷ সমাজতন্ত্রে পড়াশোনার কোনও খরচ ছিল না৷ নিত্য নতুন মেডিকেল চিকিৎসা, প্রযুক্তি, ওষুধপত্রের  জ্ঞানার্জনের জন্য প্রত্যেক সোভিয়েত চিকিৎসকের  বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ছিল৷

মেডিকেল স্টেশন, ডিসপেনসারি, পলিক্লিনিক, হাসপাতাল ব্যবস্থা

সোভিয়েত স্বাস্থ্য পরিষেবায় হাসপাতালের ভূমিকা ছিল অতি গুরুত্বপূর্ণ৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সমাজতন্ত্রে গড়ে ওঠা বহু স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের পুনর্নির্মাণ করতে হয়েছে৷ ১৯৮৩ সালে সারা দেশে ২৩,৫০০ স্বাস্থ্য পরিষেবা কেন্দ্র এবং ৩৬,৬০,০০০ শয্যা সংখ্যা ছিল৷ সোভিয়েতের সর্বত্র সাধারণের হাসপাতাল পরিষেবা ছিল সম্পূর্ণ বিনামূল্যে৷ অঞ্চলভিত্তিক হাসপাতালে গড়ে ১০০০০ লোকের জন্য ৩৫ থেকে ৫০টি বেড ছিল৷ এখানে সার্জেন সহ কয়েক ধরনের বিশেষজ্ঞও থাকত৷ জেলা স্তরে  ৮০,০০০ থেকে ১,৫০,০০০ মানুষ প্রতি হাসপাতালে ১৪ থেকে ১৬ জন বিশেষজ্ঞ এবং ১০০ থেকে ৩০০ বেড থাকত৷ প্রাদেশিক হাসপাতালে ৬০০ থেকে ১২০০ বেড থাকত এবং সেগুলি প্রযুক্তিগতভাবে ছিল অনেক উন্নত৷ এগুলি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরও কাজ করত৷ এ ছাড়া শিশুরোগ, প্রসূতি, ক্যানসার, মানসিক রোগ, টিবি, সংক্রমণ, ট্রমা, হার্ট, চক্ষুরোগ ইত্যাদির জন্য বিশেষ বড় হাসপাতাল ও গবেষণাকেন্দ্র ছিল৷ এর বাইরে সোভিয়েত দেশে প্রাকৃতিক মনোরম পরিবেশ ১৩০০ বিশ্রাম আবাস এবং তাতে ২১ লক্ষ বেড ছিল৷ পৃথিবীর আর কোনও দেশে এত বিস্তৃত স্বাস্থ্যনিবাস ছিল না৷

প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে শুধুমাত্র ফেল্ডসার–নার্স পরিচালিত মেডিকেল স্টেশন ছিল৷ তার উপরে ছিল ৪,০০০ লোক প্রতি পলিক্লিনিক ব্যবস্থা– সেখানে জেনারেল প্র্যাকটিশনার্স, শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ, একজন প্রসূতি ও স্ত্রী–রোগ বিশেষজ্ঞ, একজন দন্ত চিকিৎসক এবং সাথে নার্স,  ক্লার্ক প্রভৃতির ব্যবস্থা ছিল৷ সাধারণ পলিক্লিনিক ছাড়াও শুধু শিশুদের জন্য ১৩,০০০ পলিক্লিনিক ছিল৷ প্রসূতি, শ্রমিক, ও বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ–তরুণীদের জন্য বিশেষ পলিক্লিনিক সারা দেশে ছড়ানো ছিল৷ ১৯৮৬ সাল নাগাদ সারা দেশে সব মিলিয়ে প্রায় ৪০,১০০ পলিক্লিনিক ছিল, গড়ে ৭০০০ লোকের জন্য একটি৷

১৯৩৬ সালের গৃহীত সংবিধানে (স্ট্যালিন সংবিধান) নাগরিকদের অধিকার সম্পর্কিত ১২০ নম্বর ধারাতে বলা হয়েছিল– সোভিয়েত নাগরিকদের বার্ধক্যে, অসুস্থতায় এবং অক্ষম অবস্থায় সম্পূর্ণ সামাজিক সুরক্ষা আছে৷ সরকারি অর্থেই বিস্তৃত ভাবে শ্রমিক এবং অন্যান্য কর্মচারীদের জন্য ইনসিওরেন্স ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল৷ শ্রমজীবী মানুষদের জন্য সমস্ত প্রকার চিকিৎসা পরিষেবা বিনামূল্যে সুনিশ্চিত করা হয়েছিল এবং তাদের জন্য দেশজুড়ে স্বাস্থ্যনিবাস গড়ে তোলা হয়েছিল৷

ইমার্জেন্সি মেডিকেল সার্ভিস

সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক সমাজের একটি অভিনব ব্যবস্থা ছিল এই ইএমএস৷ ফোন কল করলেই সেন্ট্রাল সুইচ বোর্ডের মাধ্যমে নিকটবর্তী কেন্দ্র থেকে অ্যাম্বুলেন্সসহ ডাক্তার এবং ফেল্ডসার বা নার্স হাজির হয়ে যেত৷ তারা প্রাথমিক চিকিৎসা করে প্রয়োজনে হাসপাতালে পাঠাত৷ আর ইমার্জেন্সি মনে না করলে রোগীকে অ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়ে নিকটবর্তী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হত৷ সারা দেশের গ্রাম–শহর মিলিয়ে এরকম ৫,১০০টি ইর্মাজেন্সি মেডিকেল সার্ভিস অ্যাম্বুলেন্স স্টেশন ছিল৷

রিসার্চ–জ্ঞানচর্চা–টেকনোলজি

নতুন স্বাস্থ্যসংক্রান্ত জ্ঞান, স্বাস্থ্যসমস্যা নিয়ে গবেষণা এবং প্রযুক্তি কৌশল বাড়ানোর জন্য সোভিয়েত দেশে নিরলস প্রচেষ্টা ছিল৷ মেডিকেল রিসার্চের কাজ বিশেষভাবে পরিচালনার জন্য ৭০০টি গবেষণাকেন্দ্র ছিল৷ নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী পাভলভের গবেষণা প্রতিষ্ঠানে সোভিয়েত সরকার সমস্ত সহযোগিতা প্রদান করে এবং তাকে অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সে উত্তীর্ণ করে৷ রিসার্চ প্রতিষ্ঠানগুলিতে স্বাস্থ্যমন্ত্রকের পরিচালনায় এবং অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স ও ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব মেডিকেল সায়েন্সের তত্ত্বাবধানে অর্থদান করা হত৷ গুরুত্বপূর্ণ পত্র–পত্রিকা (জার্নাল) এবং বইপত্র স্বল্পমূল্যে হাজার হাজার কপি ছাপানো হত৷ তার দামও অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম ছিল৷

টাইফাস–টিবি–যৌনরোগ্ বিরুদ্ধে সংগ্রাম

লেনিনের শিক্ষা অনুযায়ী সোভিয়েত সমাজতন্ত্র ঘোষণা করেছিল– ‘আমরা শুধু অর্থনৈতিক ভিত্তিতে মানবসমাজ পুনর্গঠিত করছি না, আমরা বিজ্ঞানসম্মত নিয়ম অনুযায়ী মানবসমাজকে ভেঙে গড়ছি’৷ সোভিয়েত সমাজ সমাজতান্ত্রিক আদর্শকে শিরোধার্য করে বিজ্ঞানের আধারে এই সমস্ত অসুখকে নিয়ন্ত্রণ ও নির্মুল করে৷

১৯২৫ সালে সোভিয়েত সরকার ‘পতিতাবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামের কর্মসূচি’ গ্রহণ করে৷ পতিতাদের বিরুদ্ধে জার সরকারের সমস্ত দমনমূলক আইন বাতিল, এই বৃত্তি থেকে মুনাফাভোগীদের বিরুদ্ধে ক্ষমাহীন যুদ্ধ এবং যৌনরোগাক্রান্ত মানুষের কাছে বিনাপয়সায় চিকিৎসা পৌঁছে দেওয়ার কর্মসূচি গৃহীত হয়৷

১৯৫১ সালে ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল ঘোষণা করে ‘সোভিয়েত ইউনিয়নে আর পতিতাবৃত্তির অস্তিত্ব নেই’৷ যৌনরোগের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ৬,০০০ ক্লিনিক ও ১০,০০০ ছোট ডিসপেনসারি ছিল৷ ১৯৪০ সালের মধ্যে ৯০ শতাংশ সিফিলিস নির্মূল হয়৷

বিশ্বখ্যাত থোরাসিক সার্জেন ডাঃ নর্মান বেথুন ১৯৩০–এর দশকে ডাক্তারদের এক সভায় উল্লেখ করেন, আমেরিকার কম রোজগারের ৩৮.২ শতাংশ মানুষের কোনও চিকিৎসার সুযোগ নেই৷ আজকের আমেরিকাতেও ৫০ থেকে ৬০ মিলিয়ন মানুষের কোনও মেডিকেল ইনসিওরেন্স নেই, অর্থাৎ চিকিৎসার সুযোগ নেই৷ দেশের প্রায় ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কর্মক্ষম মানুষ বেকার৷ এর থেকে বোঝা যায় সমাজতান্ত্রিক সমাজের স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং দৃষ্টিভঙ্গির সাথে অগ্রসর পুঁজিবাদী দেশগুলির স্বাস্থ্যব্যবস্থার পার্থক্য কতখানি৷

পুঁজিবাদে ফিরে আসা রাশিয়ায় স্বাস্থ্যের দৈন্যদশা

স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর ক্ষমতাসীন অযোগ্য নেতৃত্ব সমাজতন্ত্র থেকে সরে এসে পুঁজিবাদ কায়েম করায় বর্তমান রাশিয়ার স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়ে গর্ব করার মতো বিশেষ কিছু নেই৷ জন্মের পরে আয়ুর যে মাত্রা নির্ধারিত হয় তাতে গর্বাচভ–ইয়েলতসিন রাশিয়া নেপাল–বাংলাদেশের সাথে আজ তুলনীয়৷ স্বাস্থ্যে অর্থবরাদ্দ ভীষণভাবে হ্রাস করা হয়েছে৷ চালু করা হয়েছে ম্যান্ডেটরি হেলথ ইনসিওরেন্স যার প্রিমিয়াম ব্যক্তিকেই দিতে হবে৷ আজ পুঁজিবাদী রাশিয়ায় মানুষের অধিকার নেই বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা পাওয়ার৷ যদিও সংবিধানে স্বাস্থ্য নাগরিকের অধিকার হিসাবে স্বীকৃত– কিন্তু তার ব্যবস্থাপনা বিভিন্ন রকমের ইনসিওরেন্সের মাধ্যমে৷ সরকার সেই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়েছে৷ টাকা বা সাজ–সরঞ্জামের অভাবের কথা বলে এই ইনসিওরেন্স কোম্পানিগুলি স্বাস্থ্য পরিষেবা থেকে নাগরিকদের প্রায়শই বঞ্চিত করে৷

পুঁজিবাদী রাশিয়াতে গ্রামাঞ্চলে অবস্থিত ডিসপেনসারি ও পলিক্লিনিকগুলি প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে৷ অর্থ ও সরবরাহের অভাবে পরিষেবা ধুঁকছে৷ গ্রামের সাথে শহরের বহু হাসপাতাল বন্ধ করা হয়েছে৷ কমানো হয়েছে শয্যাসংখ্যা৷ আউটডোর প্রেসক্রিপশনের ওষুধ কোথাও সরবরাহ করা হয় না৷ সামান্য কিছু প্রান্তিক মানুষদের ছাড়া৷ পকেটের টাকা খরচ করে কিনে নিতে হয়৷

২০১২ সালের ‘মে ডিক্রি’–তে প্রেসিডেন্ট পুতিন স্বাস্থ্য কর্মচারীদের বেতনবৃদ্ধি এবং সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবাকে ধীরে ধীরে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন৷ যে দেশ পৃথিবীতে যৌনরোগকে নির্মূল করেছিল এবং পতিতাবৃত্তিকে সমাজজীবন থেকে বিনাশ করেছিল– সে দেশে এখন বর্তমান সময়ের মারণ যৌনরোগ– এইচ আই ভি–এইডস রোগের রমরমা৷ পুঁজিবাদী রাশিয়ার বুকে শুধু নয়, পৃথিবীর প্রায় সব শহরেই রুশ যুবতীদের দেহ বিক্রি করতে দেখা যাচ্ছে৷ সমাজতন্ত্র থেকে সরে আসায় যক্ষ্মা সংক্রমণ এবং তা থেকে মৃত্যু দুটোই অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে৷ বেড়েছে শিশুমৃত্যু, প্রসবকালীন মাতৃমৃত্যু৷

জারের আমলের জরাগ্রস্ত চিন্তাভাবনা ও জঘন্য স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে ভেঙে লেনিন–স্ট্যালিনের নেতৃত্বে সর্বাধুনিক এবং সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক দর্শন মার্কসবাদ–লেনিনবাদ প্রয়োগ করে নভেম্বর বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বলশেভিক পার্টি রাশিয়ার সমাজে যে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছিল, তার প্রভাবে সারা দুনিয়ার বুকে সোভিয়েত স্বাস্থ্যব্যবস্থা হয়ে উঠেছিল শীর্ষস্থানীয় এবং দৃষ্টান্তস্বরূপ৷ বিশ্বের মানুষের, বিশেষত ধনতান্ত্রিক পশ্চিমী দেশগুলির কাছে যা ছিল বিস্ময় সৃষ্টিকারী এবং ঈর্ষার বস্তু৷ পুঁজিবাদে ফিরে আসা রাশিয়ার স্বাস্থ্যব্যবস্থার দৈন্যদশা আবার প্রমাণ করল সমাজতন্ত্রই সবার জন্য সুনিশ্চিত স্বাস্থ্যের শেষ কথা৷


সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে সাতটি কল্প কাহিনী — স্টিভেন গাউন্স

maxresdefault

২২ বছর পূর্বে ১৯৯১ সালের ২৬ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যায়। পূর্বতন সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায়; মার্কসবাদের নামে বুর্জোয়া চিন্তার আমদানি যখন থেকে শুরু হলো, সেই সময় থেকেই সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের প্রচারকেরা সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে ঘরে বাইরে অপপ্রচারের বন্যা বইয়ে দিতে থাকে। প্রচার করতে থাকে কিছু কাল্পনিক কাহিনী।

কিন্তু এই ধারণাগুলোর কোনোটাই সঠিক নয়।

এই কল্প কথাগুলোর প্রথমটি হলো — ‘সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি সেখানকার জনগণের কোনো সমর্থন ছিল না।’ এর জবাবে বলা যায় সোভিয়েত ইউনিয়নের অবলুপ্তির ৯ মাস আগে ১৯৯১ এর ১৭ মার্চ সোভিয়েত নাগরিকরা একটি গণভোটে অংশ নেয়। যেখানে জানতে চাওয়া হয়েছিল তারা সোভিয়েত ইউনিয়নকে টিকিয়ে রাখার পক্ষে কিনা? সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভেঙে দেয়ার সম্পূর্ণ বিপরীতে তিন চতুর্থাংশেরও বেশি মানুষ সোভিয়েত ইউনিয়নের ঐক্যের পক্ষেই ভোট দেয়।

দ্বিতীয় ভ্রান্ত ধারণা হলো — ‘রাশিয়ানরা স্ট্যালিনকে ঘৃণা করে।’ এধারণাও যে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত তার প্রমাণ ‘রাশিয়া’ নামে একটি টিভি চ্যানেল তিন মাস ধরে পাঁচ কোটি রাশিয়ান নাগরিকের ওপর সমীক্ষা চালিয়ে দেখতে চায় তাদের মতে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ রাশিয়ান কারা? সেখানে দেখা যায় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে যিনি সাফল্যের সঙ্গে পশ্চিমী রাষ্ট্র কর্তৃক রাশিয়া আক্রমণের প্রচেষ্টা প্রতিহত করে ছিলেন সেই আলেকজান্ডার নভোস্কিকে প্রথম স্থান দেয়া হয়। দ্বিতীয় জার নিকোলাসের প্রধানমন্ত্রী পাইথর স্টলিপিন, যিনি রাশিয়ায় ভূমি সংস্কার কার্যকরী করেছিলেন, তাঁকে সমীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান দেওয়া হয়। মাত্র ৫৫০০ ভোটের ব্যবধানে তৃতীয় স্থান দেয়া হয় জোসেফ স্ট্যালিনকে। যাঁকে পশ্চিমী মতামত সৃষ্টিকারীরা নিয়মিতভাবে একজন নির্মম স্বৈরাচারী শাসক হিসেবে বর্ণনা করে থাকেন, যার হাত নাকি লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্তে রঞ্জিত।

কর্পোরেট ধনকুবের যারা পশ্চিমী আর্দশগত প্রচার কেন্দ্রের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে আছে তাদের হৃদয় জয়ের দিকে যিনি ছোটেননি, তাকে সেই পশ্চিমী দুনিয়ায় গালিগালাজ করাই স্বাভাবিক। কিন্তু দেখা যাচ্ছে রাশিয়ানদের মত সম্পূর্ণ অন্যরকম। রাশিয়ানরা স্ট্যালিনের শাসনে ভালো থাকার পরিবর্তে খারাপ অবস্থায় ছিলেন পশ্চিমী প্রচারকদের এই ধারণার সঙ্গেও এই জনমতের রায় অসঙ্গতিপূর্ণ। ২০০৪ সালের মে-জুন মাসে প্রকাশিত ‘ফরেন অ্যাফেয়ার‘ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ফ্লাইট ফ্রম ফ্রিডম হোয়াট রাশিয়ান থিংক এন্ড ওয়ান্ট’ প্রবন্ধে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্যুনিস্ট বিরোধী ঐতিহাসিক রিচার্ড পাইপ একটি সমীক্ষার উল্লেখ করেন। ঐ সমীক্ষায় রাশিয়া ও সমগ্র বিশ্বের সর্বকালের ১০ জন শ্রেষ্ঠ পুরুষ ও নারীর তালিকা দিতে বলা হয়েছিল। যথেষ্ট বিরক্তির সঙ্গেই ঐ সমীক্ষার ফলাফল তুলে ধরে পাইপ দেখান যেÑ স্ট্যালিনকে পিটার দি গ্রেট, লেনিন ও পুশকিনের পর চতুর্থ স্থানে রাখা হয়।

তৃতীয় কাল্পনিক ধারণা হলো — ‘সোভিয়েত সমাজতন্ত্র ছিল অকার্যকরী।’ একথা সত্য হলে তর্কাতীতভাবে ধনতন্ত্র সমপরিমাণে ব্যর্থ। ১৯২৮ সালে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সূচনা থেকে ১৯৮৯ সালে তা ভেঙে যাওয়ার সময় পর্যন্ত একমাত্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন অস্বাভাবিক পরিস্থিতি ছাড়া সোভিয়েত সমাজতন্ত্র কখনোই মন্দায় হোঁচট খায়নি বা পূর্ণ কর্মসংস্থানেও ব্যর্থ হয়নি।

দীর্ঘ ৫৬ বছর সময়কাল ধরে (১৯২৮-১৯৪১ ও ১৯৪৬-১৯৮৯, যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল সমাজতান্ত্রিক এবং তারা কোনো যুদ্ধে লিপ্ত ছিল না।) কোনো ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি মন্দা ছাড়া এবং পূর্ণ কর্মসংস্থান কি কখনও অব্যাহতভাবে বিকশিত হয়েছে? তদুপরি ১৯২৮ সালে স্ট্যালিন যখন প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা শুরু করেন তখন যে সমস্ত ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্র অর্থনৈতিক বিকাশের একই স্তরে ছিল সেই সমস্ত ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির চেয়ে সোভিয়েত অর্থনীতির বিকাশ ছিল দ্রুততর। এমনকি সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অস্তিত্বের অধিকাংশ সময়ই সোভিয়েত অর্থনীতির বিকাশ ছিল মার্কিন অর্থনৈতিক বিকাশের চেয়েও দ্রুততর।

নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, সোভিয়েত অর্থনীতি কখনোই মূল অগ্রসর ধনতান্ত্রিক শিল্প-অর্থনীতিগুলির সমান হতে বা ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। যদিও তারা দৌড় শুরু করেছিল অনেক পেছন থেকে, আবার তা পশ্চিমী রাষ্ট্রগুলোর মতো কোনো সাহায্যও পায়নি। ক্রীতদাসত্বের ইতিহাস, ঔপিনিবেশিক লুটতরাজ এবং অর্থনৈতিক সা¤্রাজ্যবাদ ও অব্যাহতভাবে পশ্চিমী দুনিয়ার বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্ঘাত প্রচেষ্টার লক্ষ্য ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। সোভিয়েত অর্থনীতির বিকাশের পক্ষে বিশেষ করে ক্ষতি করছিল পশ্চিমী সামরিক চাপের চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করার জন্য বৈষয়িক ও মানব সম্পদকে বেসামরিক অর্থনীতি থেকে যুদ্ধ অর্থনীতিতে ঘুরিয়ে দেয়ার প্রয়োজনীয়তা। রাষ্ট্রীয় মালিকানা বা পরিকল্পিত অর্থনীতি নয় বরং ঠান্ডা যুদ্ধ, অস্ত্র প্রতিযোগিতা- যা সোভিয়েত ইউনিয়নকে অধিকতর শক্তিশালী শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জড়িয়ে ফেলেছিল, তাই সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির পক্ষে অগ্রসর ধনতান্ত্রিক দেশগুলোর শিল্প অর্থনীতিগুলোকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার পক্ষে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তথাপি, সোভিয়েত অর্থনৈতিক বিকাশকে পঙ্গু করার অব্যাহত পশ্চিমী প্রচেষ্টা সত্ত্বেও সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত অর্থনীতি যুদ্ধের সময় ছাড়া প্রতি বছরই তার অস্তিত্বের সমগ্র পর্যায়েই ইতিবাচক বিকাশ ঘটিয়েছে এবং সকলের জন্য বৈষয়িকভাবে নিরাপদে বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করেছে। কোন ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি এমন সাফল্যের দাবি করতে পারে?

চতুর্থ কল্পকথা হলো — ‘সোভিয়েত ইউনিয়নের মানুষ সমাজতন্ত্রের পরিবর্তে পুঁজিবাদেই আস্থা রেখেছে।’ কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা সোভিয়েত ব্যবস্থার রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা বা সমাজতন্ত্রই ফিরিয়ে আনতে চাইছে। একটি সাম্প্রতিক জনসমীক্ষায় উঠে এসেছে আটান্ন শতাংশ মানুষ রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা ও বন্টনের পক্ষে রায় দিয়েছে। সেখানে মাত্র আটাশ শতাংশ মানুষ ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও ব্যক্তিগত বন্টনের পক্ষে তাদের মত ব্যক্ত করেছে। চৌদ্দ শতাংশ মানুষ এ বিষয়ে তাদের মতামত দিতে পারেননি। অধ্যাপক পাইপ কর্তৃক আর একটি জনসমীক্ষায় বাহাত্তর শতাংশ মানুষ ব্যক্তি পুঁজির বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে।

পঞ্চম যে কল্পকথাটি প্রচার করা হয় তা হলো ‘বাইশ বছর পর পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের মানুষ দেখছে সোভিতে ইউনিয়নে ভাঙন তাদের জন্য ক্ষতিকর হয়নি; বরঞ্চ ভালোই হয়েছে।’ কিন্তু এই ধারণাটিও সম্পূর্ণভাবে ভুল। একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষা অনুযায়ী এগারোটি পূর্বতন সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের মানুষ (রাশিয়া, ইউক্রেন, বেলারুশ, উজবেকিস্তান, কাজাকস্তান, জর্জিয়া প্রভৃতি) যারা ভেবেছিলেন যে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙন তাদের জন্য ভালো হবে, আজ তারা অনেকেই মনে করেন ভাঙনের ফলে তাদের ক্ষতি হয়েছে বেশি। বিশেষ করে যে বয়স্ক মানুষরা পূর্বতন সোভিয়েত ব্যবস্থা প্রত্যক্ষ করেছিলেন, তারা এই ক্ষতির দিকটি আরো ভালোভাবে অনুধাবন করতে পারছেন। সমাজতন্ত্র বিরোধী পাইপের দ্বারা সংগঠিত আর একটি সমীক্ষায় উঠে এসেছে যে রাশিয়ার চার ভাগের তিন ভাগ মানুষের কাছেই সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙন দুঃখজনক, যা একেবারেই অপ্রত্যাশিত তাদের কাছে যারা পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের দমননীতি ও আর্থিক দুরবস্থার কথা বলেন।

ষষ্ঠ যে কাল্পনিক কাহিনীটি পুঁজিবাদের প্রচারকরা দাবি করে থাকেন — ‘পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের নাগরিকরা আগের তুলনায় ভালো আছেন।’ এক্ষেত্রে সকলেই জানেন কিছু লোক নিশ্চয়ই ভালো আছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বেশিরভাগ মানুষই কী ভালো আছেন? যেহেতু বেশিরভাগ মানুষই মানছেন যে তারা পূর্বতন সোভিয়েত সমাজতন্ত্রেই ভালো ছিলেন এবং নতুন পুঁজিবাদী ব্যবস্থা তাদের ক্ষতিই করেছে বেশি। তাই বলা যায় যে, বেশিরভাগ মানুষই নতুন বর্তমান ব্যবস্থায় ভালো নেই। এই ধারণাটি প্রতিষ্ঠিত হয় যদি আমরা এই মানুষগুলির জীবনকাল (Life expectancy) সম্পর্কে আলোকপাত করি। একটি বিশ্ব বিখ্যাত স্বাস্থ্য পত্রিকা ‘দি ল্যান্সেট’-এ সমাজতত্ত্ববিদ ডেভিড স্টাকলার ও স্বাস্থ্য বিষয়ক গবেষক মার্টিন ম্যাক্কি দেখিয়েছেন যে পূর্বতন সোভিয়েত ব্যবস্থার পর থেকে সেখানকার মানুষের জীবনকাল কীভাবে কমতে শুরু করেছে। খুব কম সংখ্যক পূর্বতন সমাজতান্ত্রিক দেশই তাদের পূর্বের জীবনকাল ধরে রাখতে পেরেছে। রাশিয়াতে পুরুষদের জীবনকাল ১৯৮৫ সালে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ছিল ৬৭ বছর। ২০০৭ সালে সেটি নেমে এসেছে ৬০ বছরে। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৪ আয়ুষ্কাল সব থেকে কমেছে। সমাজতন্ত্রের ভাঙনের পর পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় বহু অকাল মৃত্যু ঘটেছে এবং মৃত্যুর হারও বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী শার্লে শিরিসটো ও হাওয়ার্ড ওয়াটকিনের ১৯৮৬ সালের একটি গবেষণায় উঠে এসেছে যে পুঁজিবাদের সময় থেকে সমাজতন্ত্রের সময়ই জীবনকাল, শিশু মৃত্যুর হার, ক্যালোরি গ্রহণ এবং বাহ্যিক সুযোগ সুবিধা প্রভৃতি আরো ভালো ছিল। অধ্যাপক পাইপের দ্বারা সংগঠিত আরো একটি সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে যে, রাশিয়ানরা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে একটি ধাপ্পা হিসাবেই দেখেন। বেশিরভাগ রাশিয়ানরাই মনে করেন পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধনী ও প্রভাবশালী লোকেদের পরিচালিত সরকারের একটি মুখোশ মাত্র। কে বলেছে যে, রাশিয়ানদের বোঝার ও বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা নেই?

সপ্তম কাহিনীটি হলো — ‘যদি পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের লোকেরা সমাজতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনতে চাইত তাহলে তারা তা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেই করতে পারত।’ কিন্তু বাস্তবে তা এত সহজ নয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা সেইসব নীতিকেই সমর্থন করে যা তাদের অনুকূলে, এমন নীতি নয় যা তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যেতে পারে। এই ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যবীমা প্রকল্পের প্রসঙ্গ উত্থাপন করা যেতে পারে। যদিও সব আমেরিকান নাগরিক এই বীমার আওতার মধ্যে আসতে চান, কিন্তু সবার অন্তর্ভুক্তি হয়নি। তাহলে তারাও চাইলে এর জন্য ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন। কিন্তু এই ক্ষেত্রে এটি সম্ভব নয়। কারণ এটি কিছু শক্তিশালী ও বিত্তবান বেসরকারি বীমা কোম্পানির স্বার্থের প্রতিকূলে যাবে, তাই তারা তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থে তাদের ক্ষমতা ব্যবহার করে এই নীতি স্থগিত করে রেখেছে। তাই বলা যায়, যা জনমোহিনী তা সব সময় সমাজে স্থান পায় না, সেখানে বিত্তবানরা তাদের স্বার্থে ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করেন।

মাইকেল পেরেন্টি লিখেছেন, পুঁজিবাদ শুধুমাত্র একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নয়, এটি একটি সমাজব্যবস্থা। একবার এটি প্রচলিত হয়ে গেলে ভোটের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদে পরিণত করা যায় না। তারা দপ্তর অধিগ্রহণ করতে পারে কিন্তু আসল ক্ষমতা সমাজের সম্পদ, উৎপাদন সম্পর্ক, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, আইন ব্যবস্থা, পুলিশ বিভাগ প্রভৃতি পুঁজিবাদীদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়।

রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের পুনঃপ্রবর্তন আবার বিপ্লবের মাধ্যমেই হতে পারে, ভোটের মাধ্যমে নয়। কিন্তু বিপ্লব শুধুমাত্র মানুষের পছন্দ অপছন্দের উপর নির্ভর করে না। বিপ্লব তখনই ঘটে যখন পুরনো ব্যবস্থায় মানুষের জীবন অসহনীয় হয়ে ওঠে এবং দেশের বেশিরভাগ মানুষ সেই ব্যবস্থা থেকে মুক্তির তীব্র আকাক্সক্ষা নিয়ে একটি বিকল্প রাজনৈতিক সংগ্রাম ও শক্তির জন্ম দেয়। কিন্তু দুঃখের হলেও সত্য রাশিয়ার মেহনতি, সাধারণ মানুষের সংগ্রাম ও শক্তি এখনও সেই কাক্সিক্ষত জায়গায় পৌঁছতে পারেনি।

২০০৩ সালে একটি সমীক্ষা হয়েছিল যাতে জানতে চাওয়া হয়েছিল যে, যদি আবার সমাজতন্ত্র ফিরে আসে তাহলে তাদের মনোভাব কী হবে? সেই সমীক্ষায় দেখা গেল যে, মাত্র ১০ শতাংশ মানুষই এর বিরোধিতা করছে। সেখানে ২৭ শতাংশ মানুষ এটি মেনে নিতে প্রস্তুত। ১৬ শতাংশ মানুষ অন্য কোথাও যাবার কথা বলেছেন। আর মাত্র ১০ শতাংশ মানুষ সক্রিয়ভাবে এটিকে প্রতিরোধ করবেন বলে জানিয়েছেন।

তাই বলা যায় সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনে অনেকেই দুঃখিত, বিশেষ করে যারা পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নকে দেখেছেন। কিন্তু সেইসব পশ্চিমী সাংবাদিক বা রাজনীতিকরা যারা তাদের পুঁজিবাদের চোখ দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নকে দেখেন তাদের কাছে বিষয়টি ভিন্ন। এখন বুর্জোয়া মিডিয়ার প্রচার সত্ত্বেও দু’দশকের বহুদলীয় গণতন্ত্র, ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ও বাজার অর্থনীতির অভিজ্ঞতা থেকে বেশিরভাগ রাশিয়ানই সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে যেতে চান। তাই বলা যায় সমাজতন্ত্র ব্যর্থ হয়েছিল এটি সত্য নয়।

সূত্রSeven Myths about the USSR By Stephen Gowans