লাশ নিয়ে জাতিবিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িক চক্রান্ত রুখে দাঁড়াও

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

লাশ নিয়ে জাতিবিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িক চক্রান্ত রুখে দাঁড়াও

(ডিসেম্বর/’৯১)

উত্তরবঙ্গে যখন না খেয়ে মরা মানুষের মৃত্যুর খবর সরকার গোপন করে চলছিল, তখনই পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ছয়জন নির্যাতিত বাঙালীর লাশ এল ঢাকার প্রেস ক্লাবের সম্মুখে। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী- এই ছয়জন শান্তিবাহিনীর হাতে নিহত।  প্রেস ক্লাবে এই ‘ছয় লাশ’ নিয়ে বাঙালী দালাল বুর্জোয়াদের প্রতিনিধি-নেতা-আইনজীবী- এরা বক্তব্য রাখলো।  পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ী জনগণের বিরুদ্ধে বাঙালী উগ্র জাতীয়তাবাদ উসকানোর অপচেষ্টা চলল। চলল ইসলামী মৌলবাদের সুরসুরি দেবার পাঁয়তারা। এসবের মধ্য দিয়ে ঢাকা পড়লো, এ মৃত্যুর জন্য আসলে দায়ী কারা?
পার্বত্য চট্টগ্রাম সূত্রে জানা যায়- যারা মারা গিয়েছেন, তারা সেই সব হতভাগ্য বাঙালীদেরই অংশ যাদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামে অন্যায়ভাবে পুনর্বাসিত করা হয়েছিল।  এভাবে এসব গরিব বাঙালী জনগণকে একদিকে সমতল ভূমি থেকে সর্বস্বান্ত করে উচ্ছেদ করা হয়েছে।  অন্যদিকে তাদেরকে ঠেলে দেয়া হয়েছে পাহাড়ী জনগণের ন্যায্য সংগ্রামের তোপের মুখে।  এরা হয়েছে পাহাড়ী জনগণের উপর নির্যাতনকারী বাঙালী দালাল বুর্জোয়া ও আমলাদের বলির পাঁঠা। আর তাই, এদের মৃত্যুর জন্য মূলত দায়ী পাহাড়ী জনতা নয়, দায়ী এই সরকার, তার আর্মী, সামরিক-বেসামরিক আমলা ও ধনী- যারা এদেরকে সমতলভূমি থেকে উচ্ছেদ করে পাহাড়ে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে।
এই ছয়জন নির্যাতিত বাঙালী, জীবিতকালে যাদের তাড়া করে ফিরেছে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অচিকিৎসা, হতাশা- বেঁচে থেকে যারা কখনই বিনামূল্যে পাবলিক বাসে পর্যন্ত উঠতে পারেনি, প্রাইভেটকার তো দূরের কথা, আজ তাদের মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী তারাই তাদের লাশ আনছে বিশেষ ট্রেনে, হেলিকপ্টারে। এটা তাদেরকে নিয়ে এক নির্মম তামাশা! মরেও তারা দালাল বুর্জোয়াদের এ রাষ্ট্রের কূটচাল থেকে রক্ষা পাচ্ছে না।
এটা ঠিক যে, ভারতীয় সম্প্রসারণবাদই পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে চক্রান্ত চালিয়ে যাচ্ছে এবং তারাও পাহাড়ী জনগণকে তাদের বলির পাঁঠা হিসেবে ব্যবহার করছে। পাহাড়ীদের মধ্যকার উগ্র জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের একাংশ এই ভারতীয় চক্রান্তে সামিল হয়েছে। ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীরা পাহাড়ী জনগণের সত্যিকার জাতীয় মুক্তিকে বিপথগামী করছে, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চক্রান্ত চালাচ্ছে এবং এরই পরিণতি হিসেবে পাহাড়ী জনগণের সত্যিকার নির্যাতকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম কেন্দ্রীভূত না করে হত্যা করা হচ্ছে পুনর্বাসিত বাঙালী গরিব জনগণকেও- যারা বিপরীত পক্ষে বাংলাদেশী সরকারের চক্রান্তে তাদের বলির পাঁঠা হয়েছে। কিন্তু ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের এ চক্রান্তকে পরাজিত করার একমাত্র উপায় হচ্ছে পাহাড়ী জনগণের জাতীয় মুক্তি, তাদের উপর বাঙালী নিপীড়ক বুর্জোয়া আর্মীর নির্যাতন উৎখাত করা।
আজ তাই, পাহাড় থেকে সমস্ত পুনর্বাসিত বাঙালীদের ফেরত এনে, তাদের সমতল ভূমিতে পুনর্বাসিত করাই এ সমস্যার সমাধান। একই সাথে বাঙালী নির্যাতক আর্মীদের পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ফিরিয়ে এনে পার্বত্য চট্টগ্রামের সংখ্যালঘু জাতিসত্তা-সমূহকে সম্পূর্ণ আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার দিতে হবে।

প্রতিক্রিয়াশীল জাতিবিদ্বেষী পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালী ছাত্র গণপরিষদ- নিপাত যাক!
জাতিবিদ্বেষী বাংলাদেশী সরকার- ধ্বংস হোক!
পাহাড়ী জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার- জিন্দাবাদ!

সূত্রঃ পাহাড় ও সমতলে আদিবাসী জাতিসত্ত্বার সংগ্রাম সম্পর্কে নিবন্ধ সংকলন, আন্দোলন প্রকাশনা

 


মহালছড়িতে পাহাড়ীদের উপর বর্বর আক্রমণ, বেনামে সামরিক শাসন চলছে

elaheebd_1266775294_4-Bangladesh-Army_jumma_town

মহালছড়িতে পাহাড়ীদের উপর বর্বর আক্রমণ, বেনামে সামরিক শাসন চলছে

(অক্টোবর/২০০৩)

কিছুদিন আগে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও পুনর্বাসিত বাঙালীরা সম্মিলিতভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের মহালছড়িতে পাহাড়ীদের ৪০টা বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে।  এখানেই শেষ নয়।

পাহাড়ী জনগণের প্রতিবাদ-প্রতিরোধকে স্তব্ধ করার জন্য সন্ধ্যার পর কোন পাহাড়ী চলাফেরা করতে পারবে না- এ জাতীয় অধ্যাদেশ জারির পাঁয়তারা করছে চারদলীয় সরকার।
বিগত ৩০ বছর বাঙালী বড় ধনী শ্রেণীর সরকার আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টির নামে সংখ্যালঘু পাহাড়ী জাতিসত্তাকে উচ্ছেদের লক্ষ্যে অব্যাহত দমন- নির্যাতন চালিয়ে আসছে।  তথাকথিত শান্তিচুক্তির নামে জনসংহতি সমিতি আত্মসমর্পণের পর এই দমন-নির্যাতন ভিন্নরূপ নিয়েছে ও সম্প্রতি তা পুনরায় তীব্র হয়ে উঠেছে।
বিএনপি’র নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় এসেই বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ-এর নির্দেশে আদমজীসহ মিলকারখানা উচ্ছেদ-বস্তি উচ্ছেদ-হকার উচ্ছেদ-রিক্সা উচ্ছেদ-ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উচ্ছেদ-পাহাড়ী জাতিসত্তা উচ্ছেদসহ সর্বত্র উচ্ছেদ অভিযান চালাচ্ছে। তাই পাহাড়ী নিপীড়িত জাতিসত্তাকে বাঙালী নিপীড়িত জনগণের সাথে সম্মিলিতভাবে সাম্রাজ্যবাদের দালাল আমলা-মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া শ্রেণীকে উচ্ছেদের সংগ্রাম করতে হবে।  এজন্য সারা দুনিয়ার সর্বহারা শ্রেণী ও নিপীড়িত জনগণের মুক্তির মতবাদ মাওবাদকে গ্রহণ করতে হবে। পাহাড়ী জনগণের বিগত ৩০ (ত্রিশ) বছরের সংগ্রাম প্রমাণ করেছে এছাড়া জুম্ম জাতিসত্তার মুক্তির কোন বিকল্প নেই।

সূত্রঃ পাহাড় ও সমতলে আদিবাসী জাতিসত্ত্বার সংগ্রাম সম্পর্কে নিবন্ধ সংকলন, আন্দোলন প্রকাশনা


লংগদু’র গণহত্যাঃ একটি বিপ্লবী দৃষ্টিভঙ্গি

01-Mallya-Massacre-1992

লংগদু’র গণহত্যাঃ একটি বিপ্লবী দৃষ্টিভঙ্গি

পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালী প্রতিক্রিয়াশীল শাসক শ্রেণী ও ফ্যাসিস্ট সরকারী বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতনের আরেকটি ঘটনা

(এপ্রিল/’৯০)

“এমন মানুষ গোনা যাবে যারা সরকারী আর্মীর নির্যাতনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, কিন্তু এটা গুণে শেষ করা কঠিন যে কতজন খুন-জখম-গ্রেপ্তার-হয়রানি ও এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে”- পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে একজন পাহাড়ী ছাত্রের মন্তব্য এটা। আর এটাই হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের আজকের বাস্তবতা। পার্বত্য চট্টগ্রামের ১০টি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সমন্বয়ে গঠিত জনগণের উপর বাঙালী শাসক শ্রেণী- মুৎসুদ্দি-বুর্জোয়া ও সামন্তদের ফ্যাসিস্ট সরকার ও তার ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রযন্ত্রের উগ্র জাতীয়তাবাদী নিপীড়নের হিংস্র চেহারা এমন এক রূপ লাভ করেছে যার সাথে কেবল ’৭১ সালে পাক-বাহিনীর বাঙালীদের উপর পরিচালিত নৃশংসতারই তুলনা চলে।  শাসক শ্রেণী ও প্রতিক্রিয়াশীল নিপীড়কদের প্রচারযন্ত্র- রেডিও, টিভি, ইত্তেফাক, ইনকিলাব, বাংলার বাণীর মতো সংবাদপত্রগুলি ভুলেও কখনো নিপীড়িতদের পক্ষে যেতে পারে এমন কোনো সংবাদ পরিবেশন করে না। তবে নিপীড়িত জনতার সংগ্রামের বিরুদ্ধে সকল প্রকার কুৎসা অপপ্রচার করা এদের স্বভাব। পার্বত্য চট্টগ্রামের সংগ্রাম সম্পর্কে এরা সেটাই যে করে এসেছে তার প্রমাণ হ’ল পার্বত্য চট্টগ্রামে লংগদু উপজেলায় ’৮৯ সালের ৪ঠা মে তারিখে সংঘটিত গণহত্যা। লংগদু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ঢাকায় হাজার হাজার পাহাড়ী ছাত্রের শোক মিছিল, প্রেসক্লাবে দেশী-বিদেশী সাংবাদিকদের সামনে তাদের বক্তব্য- এসব কিছুই সমতল ভূমির একজন মানুষও জানতে পারেননি তথাকথিত “জাতীয়” পত্র-পত্রিকাগুলো থেকে। রেডিও, টিভি তো দূরেই থাকুক।  শুধু ’৮৯ সালের লংগদুতেই নয়, ইতিপূর্বেও এ ধরনের গণহত্যা ও ধ্বংসলীলা চালিয়েছে উগ্র জাতীয়তাবাদী বাঙালী শাসক শ্রেণীর হাতিয়ার ফ্যাসিস্ট সেনাবাহিনী।  এর মাঝে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ও পাইকারী নির্যাতনের বিশেষ ঘটনাগুলো ঘটে ১৯৭১ সালে পানছড়ি ও কুর্কি চারায়, ১৯৮০-তে কাউখালীতে, ১৯৮৪ সালে ভূষণছড়ায়, ১৯৮৬ সালে পানছড়ি-দিঘীনালা-মাটিরাঙায় ও ১৯৮৮ সালে বাঘাইছড়ি (কাশলং)-এ।
বাংলাদেশ সরকারের দালাল লংগদু উপজেলা চেয়ারম্যান আঃ রশিদকে গত বছরের ৪ঠা মে তারিখে অজ্ঞাত পরিচয় আততায়ীরা হত্যা করে।  এই ঘটনাটির সুযোগ গ্রহণ করে স্থানীয় আর্মী ক্যাম্পের কমান্ডার মেজর জাকিরের নেতৃত্বে স্থানীয় বাঙালী প্রতিক্রিয়াশীলরা পাহাড়ী জনগণের উপর উন্মত্তভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে।  তারা মিসেস নমিতা চাকমার তিন মাসের শিশু কন্যা, ৭০/৭৫ বছরের বৃদ্ধ-বৃদ্ধাসহ ৩২ জন নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ-শিশুকে নির্বিচারে হত্যা করে; মারাত্মকভাবে আহত করে অনেককে।  এই বর্বর অভিযানে ধ্বংস করা হয় নয়টি গ্রামের জুম্ম জনগণের সর্বস্ব।  পুড়িয়ে দেয়া হয় এক হাজার এগারটি ঘর, দু’টি স্কুল ও ৬টি ধর্মীয় মন্দির। পাহাড়ী জনগণ আজ এমন এক পর্যায়ে রয়েছে যে নিজ জন্মভূমিতে পরিচয়পত্র ছাড়া ঢুকতে পারে না।
এই হলো সরলপ্রাণ সংগ্রামী পাহাড়ী জাতিসত্তার জুম্ম জনগণের কাছে “গণতান্ত্রিক” বাংলাদেশ সরকার ও তার সেনাবাহিনীর চেহারা। কি অপরাধে এই ভয়াবহ দমন অভিযান? অপরাধ একটাই, তারা এই উগ্র জাতীয়তাবাদী বাঙালী শোষক ও শাসকদের ফ্যাসিস্ট নিপীড়ন থেকে মুক্তি চান, তারা তাদের জাতির উপর বাঙালী শোষকদের শোষণের অবসান চান, যুগ যুগ ধরে নিজস্ব বাসভূমি বলে পরিচিত পার্বত্য এলাকায় তারা জোরপূর্বক বসতকারী বাঙালীদের দ্বারা উচ্ছেদ হবার হুমকির অবসান চান। কিন্তু পাহাড়ী জনগণের এই ন্যায়সঙ্গত ক্ষোভকে পুঁজি করে সাহায্যের নামে এই জাতিসত্তার দিকে থাবা মেলে দিচ্ছে আরেক নিপীড়নকারী ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ- যারা শিখ, তামিল, গুর্খা, কাশ্মিরীসহ অনেক নিপীড়িত জাতির অস্তিত্ব বিলোপের চেষ্টায় নিয়োজিত। ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের কারণেই পাহাড়ী জনগণের ন্যায্য সংগ্রাম বিপথে চালিত হচ্ছে।
বাঙালী শ্রমিক-কৃষক-বিপ্লবী বুদ্ধিজীবী ও সকল নিপীড়িত জনগণের দায়িত্ব হচ্ছে পাহাড়ী জনগণের ওপর শাসক শ্রেণী ও রাষ্ট্রযন্ত্রের শোষণ-নির্যাতনের প্রতিবাদ করা এবং পাহাড়ী জনগণের ন্যায্য সংগ্রামের পক্ষে দাঁড়ানো। কারণ একই শাসক-শোষক শ্রেণী, তাদের প্রভু মার্কিন-রুশ-ভারত এবং তাদের রাষ্ট্রযন্ত্র পুলিশ-মিলিটারি, আইন-প্রশাসন বাঙালী নিপীড়িত জনতারও শত্রু।  বাঙালী শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্ত জনগণের মুক্তির জন্য একই শত্রুর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হচ্ছে ও হবে।  তাই পাহাড়ী ও বাঙালী নিপীড়িত জনগণের মুক্তি সংগ্রাম পরস্পরের মিত্র। লংগদু গণহত্যাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘঠিত সকল হত্যাযজ্ঞ ধ্বংসলীলা এবং বর্বর মধ্যযুগীয় নিপীড়ন-নির্যাতনের আমরা তীব্র নিন্দা করি।  আমরা আহ্বান জানাই, পাহাড়ী ও বাঙালী নিপীড়িত জনগণের যুক্ত সংগ্রামের।  যে সংগ্রাম মাওবাদের আদর্শে শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে পরিচালিত হলেই শুধুমাত্র বর্বর ফ্যাসিস্ট অত্যাচারী এই শত্রুকে পরাজিত করতে পারবে।

সূত্রঃ পাহাড় ও সমতলে আদিবাসী জাতিসত্ত্বার সংগ্রাম সম্পর্কে নিবন্ধ সংকলন, আন্দোলন প্রকাশনা


আজ লোগাং গণহত্যার ২ যুগ

539544_453972424642785_20892984_n 1491615_252290818287665_2012887018412247240_n 1438933389

Pakuakhali-4

Protest-photo-92-300x225

আজ ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের লোগাঙ গণহত্যার দুই যুগ পূর্ণ হল। ১৯৯২ সালের এই দিন সেনাবাহিনী, বিডিআর, আনসার-ভিডিপি’র সহযোগিতায় সেটলার বাঙালিরা খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলার লোগাঙ গুচ্ছগ্রামে এই বর্বর গণহত্যা সংঘটিত করে। শান্তিবাহিনী কর্তৃক এক বাঙালি রাখাল বালককে হত্যার মিথ্যা অভিযোগে তারা এ লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড চালায়। সেটলাররা দা, বটি, কুড়াল দিয়ে পাহাড়িদের উপর আক্রমণ করে এবং সেনাবাহিনী ও বিডিআর(বিজিবি) নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। এতে কয়েকশত পাহাড়ি হতাহত হয়। অনেকে নিঁখোজ হয়ে যায়। সেদিন শিশু, বৃদ্ধ, নারী কেউই রেহাই পায়নি। অগ্নিসংযোগ করে ছাই করে দেওয়া হয় ৭ শতাধিক ঘরবাড়ি।

পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের ঐতিহ্যবাহী সামাজিক উৎসব বৈ-সা-বি (বৈসু-সাংগ্রাই-বিঝু) উৎসবের ৩দিন আগে সংঘটিত এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে পাহাড়িরা। বর্জন করা হয় বৈ-সা-বি উৎসব।

এই বর্বর হত্যাকাণ্ডের ফলে বৈ-সা-বি’র আনন্দ উৎসব শোক সাগরে পরিণত হয়। ১৩ এপ্রিল’৯২ উৎসবের মূল দিন (মূল বিঝু) খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে হাজার হাজার লোকের বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা থেকে আগত রাজনৈতিক  সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, মানবাধিকার কর্মী, আইনজীবী, লেখক-সাংবাদিকরাও আনন্দ উৎসবের পরিবর্তে আপামর জনগণের সাথে একাত্ম হয়ে প্রতিবাদ বিক্ষোভে সামিল হয়।  খাগড়াছড়ির হাজার হাজার আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সেদিন বাঁধ ভাঙা পানির মতো রাজপথে নেমে এই বর্বর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানান। স্বতঃস্ফুর্তভাবে বৈ-সা-বি উৎসব বর্জন করা হয়। নিহতদের সম্মান জানাতে রান্না করা পাজন (মূল উৎসবের দিন হরেক রকমের সবজি দিয়ে তৈরি খাদ্য বিশেষ) চেঙ্গী নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। হাজার প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করা হয়।

বৈ-সা-বি উপলক্ষে ঢাকা থেকে আগত রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, মানবাধিকার কর্মী, আইনজীবী, লেখক-সাংবাদিকরা ১২ এপ্রিল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে যাবার পথে পানছড়ি উপজেলা সদরে সেনাবাহিনী তাদের বাধা প্রদান করে।

এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ২৮ এপ্রিল’৯২ পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত হয় লোগাঙ অভিমুখে ঐতিহাসিক পদযাত্রা। হাজার হাজার নারী-পুরুষ এতে অংশ নেন। ঢাকা থেকে আসা রাজনৈতিক দলের নেতা, ছাত্র নেতা, সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী-লেখকরাও পাহাড়ি জনগণের সাথে সংহতি জানিয়ে এই পদযাত্রায় অংশ নেন। সেনাবাহিনীর সকল বাধা-বিঘ্ন অতিক্রম করে লোগাং পোড়াভিটায় গিয়ে তারা ফুল দিয়ে নিহতদের সম্মান জানান।

লোগাং গণহত্যাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে এ যাবত ডজনের অধিক গণহত্যা ও দুই ডজনের অধিক সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু কোন ঘটনারই আজ পর্যন্ত বিচার হয়নি। ফলে এ ধরনের বর্বর ঘটনা এখনো ঘটেই চলেছে। কাজেই, পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত সকল গণহত্যার সুষ্ঠু বিচার ও দোষীদের শাস্তির দাবিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের ছাত্র-যুব সমাজ তথা সর্বস্তরের জনগণকে রুখে দাঁড়ানো ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই।

এদিকে, দিনটির স্মরণে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন লড়াকু সংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন আজ বিকালে ঢাকার শাহবাগে (জাতীয় জাদুঘরের সামনে) প্রদীপ প্রজ্জ্বলন ও প্রতিবাদী আলোচনা সভা এবং পানছড়িতে প্রতিবাদী সভা ও রক্তে খোদিত “১০ এপ্রিল” প্রদর্শন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। তারা গণশত্রুদের বিরুদ্ধে পাহাড়ি ও বাঙালি জনগণের সংগ্রামী মৈত্রী উর্ধ্বে তুলে ধরার আহ্বান জানিয়েছে।

সূত্রঃ chtnews


সিরাজ সিকদার রচনাঃ পার্বত্য চট্টগ্রামের সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদীদের প্রতিক্রিয়াশীল কার্যকলাপ

সিরাজ সিকদার রচনা

পার্বত্য চট্টগ্রামের সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদীদের

প্রতিক্রিয়াশীল কার্যকলাপ

(সেপ্টেম্বর ১৯৭৪)

[স্ফুলিঙ্গ ১নং সংখ্যায় প্রকাশিত]

 sikder

[যেমনটা সভাপতি সিরাজ সিকদার ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন, পার্বত্য চট্রগ্রামের সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদীদের আন্দোলন ৯০ দশকের শেষের দিকে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের নির্দেশে আত্মসমর্পণ করে। বিনিময়ে আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলির বাংলাদেশে অবস্থানরত নেতা-কর্মীদের ভারতের কাছে ধরিয়ে দিয়ে ঐ আন্দোলনগুলিকে মারাত্মকভাবে দুর্বল করে দেয়। অন্যদিকে সিরাজ সিকদারের সময়ে পার্বত্য চট্রগ্রামে পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির মুক্ত এলাকা গড়ে উঠলেও, তাঁর মৃত্যু পরবর্তীকালে ভ্রান্ত লাইনসমূহ কারণে কাজ বিপর্যস্ত হয়ে যায় — সর্বহারা পথ]

সামন্ত ক্ষুদে বুর্জোয়াদের নেতৃত্বে চট্রগ্রামের চাকমা জাতিসত্তার মধ্যে একটি সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন চলে আসছে। তারা শোষক ও শোষিত বাঙালীদের কোন পার্থক্য রেখা টানে না, সকলবাঙালীকেই শত্রুমনে করে।

তাদের মুক্তির জন্য বাঙালীদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজনীয়তাকে তারা বিরোধিতা করে।

তারা পাহাড়ী জাতিসত্তার শোষক-শোষিতের মধ্যকার কোন পার্থক্য করে না।

তারা পার্বত্য চট্রগ্রামের বিভিন্ন জাতিসত্তার জন্য স্বায়ত্বশাসনের প্রতিশ্রুতি না দিয়ে পার্বত্য চট্রগ্রামের স্বায়ত্তশাসন, কখনো কখনো বিচ্ছিন্নতা দাবী করে।

এ দাবীর অর্থ হচ্ছে কিছুটা ক্ষুদে বুর্জোয়া আলোকপ্রাপ্ত সংখ্যাধিক চাকমা জাতিসত্তার ক্ষমতা দখল এবং অন্যান্য জাতিসত্তার উপর তাদের কর্তৃত্ব ও নিপীড়ন।

চাকমা জাতিসত্তার এই সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদীরা মার্কসবাদের কথাও কখনো কখনো বলে, কেউ কেউ নিজেদেরকে মার্কসবাদী দাবী করে।

কিন্তু মার্কসবাদের অন্যতম মৌলিক বৈশিষ্ট্য আন্তর্জাতিকতাবাদ ‘বিশ্বের শ্রমিক শ্রেণী এক হও’,একটি দেশের ভৌগলিক সীমার মধ্যে শ্রমিক শ্রেণীর একটিই রাজনৈতিক পার্টি-কমিউনিস্ট পার্টিহতে পারে, জাতিয়তাভিত্তিক কমিউনিস্টরা বিভক্ত হতে পারে না, জাতীয় সমস্যা হচ্ছে মূলতঃ শ্রেণী সমস্যা, ইত্যাদি তারা স্বীকার করে না।

এই সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদীদের কোন রাজনৈতিক কর্মসূচী,সামরিক, সাংগঠনিক ও বাস্তব কাজের লাইন নেই।

পাক বাহিনীর পরিত্যাক্ত অস্ত্র, প্রাক্তন রাজাকার, সামন্ত বুদ্ধিজীবী, EPCAF [East Pakistan Civil Armed Force— সর্বহারা পথ] দ্বারা তারা একটি সশস্ত্র বাহিনী গড়েছে।

এর সাহায্যে তারা গ্রাম থেকে জোর পূর্বক অর্থ সংগ্রহ, কোথাও কোথাও ডাকাত দমন, ডাকাতি করা, সামন্ত প্রতিক্রিয়াশীলদের রক্ষা ইত্যাদি কাজ করে।

পার্বত্য চট্রগ্রামে কিছু দিন পূর্বে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তারা বন্দুক দেখিয়ে জনগণকে তাদের প্রতিনিধিদেরভোটদানে বাধ্য করে। এদের সংগঠন হচ্ছে “জনসংহতি” ও P.L.A বা (শান্তি বাহিনী); কোথাও তার “জংলী” নামে পরিচিত।

সরকার বিরোধী তাদের কোন তৎপরতা নেই।

তাদের উপর জনগণের আস্থা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে।

পক্ষান্তরে পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির কাজ দ্রুত পার্বত্য চট্রগ্রামে বিকাশ লাভ করছে।

পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি নিপীড়িত বাঙালী-পাহাড়ীদের ঐক্যের পক্ষপাতী এবং পাহাড়ী–বাঙালীদেরসম অধিকার, পাহাড়ী জাতিসত্তাসমূহের প্রত্যেকের জন্য স্বায়ত্বশাসনের পক্ষপাতী।

পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি পাহাড়ী জনগণকে সংগঠিত করা এবং তাদের উপর নির্ভর করে বাংলাদেশ পুতুল সরকার ও তার পাহাড়ী তাবেদেরদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাচ্ছে।

বিশেষ করে পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি পাহাড়ী জুমিয়া চাষী এবং শ্রমজীবীদের ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত করছে।

পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির কাজ দ্রুত বিকাশ লাভ করছে। ১৯৭৩ সালে চন্দ্রঘোনা থানা দখল, এ বছর পারোয়া ফাঁড়ি দখল, ঝুমিয়া কৃষকদের রিজার্ভ ফরেস্টে ঝুম কাটার আন্দোলন ইত্যাদির মাধ্যমে সর্বহারা পার্টির নেতৃত্বে পাহাড়ী জনগণের সংগ্রাম এগিয়ে চলেছে।

পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির নেতৃত্বে সংগ্রাম ব্যাপক পাহাড়ী জনগণ ও পাহাড়ী বুদ্ধিজীবীদের সহানুভূতি ও আস্থা অর্জন করেছে।

পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি জনসংহতি, P.L.A প্রভৃতিদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার জন্য বারংবার প্রস্তাব দেয় এবং প্রচেষ্টা চালায়।

মানবেন্দ্র লারমার সাথেও আলাপ হয়।

কিন্তু তারা তাদের সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গীআঁকড়ে থাকে, নিপীড়িত পাহাড়ী-বাঙালীঐক্যের পক্ষে তারা সাড়া দেয়নি।

সম্প্রতি তারা পার্বত্য চট্রগ্রামে আমাদের দ্রুত বিকাশে শংকিত হয়ে কিছুসংখ্যক কর্মীকে আটক করে,তাদের উপর নির্যাতন চালায়, সর্বহারা পার্টি করতে পারবে না বলে কারো কারো আত্মী-স্বজনেরনিকট থেকে বন্দুকের মুখে বন্ড নেয়। তারা আমাদের অন্যান্য এলাকাস্থ কর্মীদের আক্রমণ ও হত্যাকরার হুমকি দিচ্ছে। সর্বহারা পার্টির কর্মী ও বাঙালী পেলেই তারা খতম করবে এ ধরনের কথা প্রচারকরে।

এ সকল ঘটনা সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদীদের ফ্যাসিবাদী প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্রকে উন্মুক্ত করে দিয়েছে।

এরা যদি গণতন্ত্রীমনা বুর্জোয়াও হতো তবে দলমত নির্বেশেষে রাজনৈতিক কাজের স্বাধীনতা, বাক-স্বাধীনতা, সমাবেশ ও সংঘবদ্ধ হওয়ার স্বাধীনতা স্বীকার করে আমাদের কাজে হস্তক্ষেপ করতো না।

কিন্তু এরা একদলীয় নায়কত্ব, মাতব্বরী ও ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে। এই সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদীদের চরিত্রের সাথে আমাদের দেশের এবং অন্যান্য দেশের সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদীদেরকোন পার্থক্য আছে কি?

আওয়ামীলীগ সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী প্রতিক্রিয়াশীলদের দ্বারা পরিচালিত হয়, তারা বাঙালী বিহারীদেরমধ্যকার শোষক-শোষিতের কোন পার্থক্য করেনি, সকল বিহারীকে শত্রুমনে করেছে। অন্যান্যদের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে ফ্যাসিস্ট একনায়কত্ব কায়েম করেছে।

এরা শেষ পর্যন্ত ভারতের কাছে নিজেদের দাসখত লিখে দিয়েছে। পাহাড়ী জাতিসত্তার মুক্তি(…)।

একইভাবে ভারতের নাগা-মিজো প্রভৃতি জাতিসত্তার মধ্যকার সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী অংশ প্রতিক্রিয়াশীলদের নিকট আত্মসমর্পণ করে তাদের পুতুল হিসেবে কাজ করছে।

কাজেই সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদীরা আজ হোক কাল হোক জাতীয় নিপীড়ণকারীদের নিকট আত্মসমর্পণ করে, জনগণের মুক্তি আনতে পারে না।

পার্বত্য চট্রগ্রামে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদীদের প্রতিক্রিয়াশীল কার্যকলাপের গতিধারা প্রমাণ করছে তারা পার্বত্য চট্রগ্রামের জাতিসত্তাসমূহের মুক্তি আনতে পারে না, উপরন্তু তারা আমাদের আক্রমণ করে আওয়ামী লীগ বিশ্বাসঘাতক ও ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের স্বার্থ রক্ষা করছে। হয়তারা ইতিমধ্যেই ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও আওয়ামীলীগের সাথে হাত মিলিয়েছে বা অদূর ভবিষ্যতেতারা হাত মিলাবে।

আমাদের আক্রমণ তাদের পতনকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।

অস্ত্রের জোরে তারা পাহাড়ী জনগণকে দাবিয়ে রাখতে পারবে না, বাঙালী-পাহাড়ী ঐক্যে তারা ফাটল ধরাতে পারবে না। বরঞ্চ অচিরেই তারা নিজেরাই উৎখাত হবে, ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে।

সূত্রঃ http://sarbaharapath.com/?p=1423


“বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একমাত্র কাজ শোষণ করা”

বাংলাদেশ

(দৃকের পরিচালক ড. শহীদুল আলম জার্মান বেতার ডয়চে ভেলের সাথে এক সাক্ষাতকারে কল্পনা চাকমার অপহরণ ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলেছেন। DWর blogwatch এ প্রকাশিত সাক্ষাতকার ভিত্তিক প্রতিবেদনটি কল্পনা চাকমা সম্পর্কিত হওয়ায় গুরুত্ব বিবেচনা করে এখানে হুবহু প্রকাশ করা হলো)-

Picture1-1433788469

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রয়োজনীয়তা এবং তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন দৃকের প্রতিষ্ঠাতা ড. শহীদুল আলম৷ গত সপ্তাহে জার্মানি সফরকালে ডয়চে ভেলেকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে  তিনি বলেন, সেনাবাহিনীর একমাত্র কাজ ‘শোষণ করা’।

ডয়চে ভেলের গ্লোবাল মিডিয়া ফোরাম সম্মেলনে অংশ নিতে গত ১৭ থেকে ১৯ জুন, ২০১৩সালে বন শহরে অবস্থান করেন ড. শহীদুল আলম৷ এসময় ডয়চে ভেলেকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি কল্পনা চাকমা অপহরণ বিষয়ে সর্বশেষ অনুসন্ধানের কথা জানান ৷ সম্প্রতি শহীদুল এবং সায়দিয়া গুলরুখ এই চাকমা তরুণীর খোঁজ করেছেন ৷ এই সংক্রান্ত একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনীও অনুষ্ঠিত হয়েছে ঢাকার দৃক গ্যালারিতে ৷

কল্পনা চাকমা অপহরণ –

বাংলাদেশে অন্যতম আলোচিত এবং চাঞ্চল্যকর ঘটনা কল্পনা চাকমা অপহরণ৷ ১৯৯৬ সালের ১১ জুন মধ্যরাতে রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে নিজ বাড়ি থেকে অপহৃত হন কল্পনা৷ এরপর থেকে আর তাঁর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।

কল্পনার অপহরণের বিষয়ে শহীদুল তাঁর গবেষণার ভিত্তিতে বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি অপহরণ করেছে তাকে চিহ্নিত করা সত্ত্বেও এই ১৭ বছরে পুলিশ কিন্তু তাকে একবারও জিজ্ঞাসাবাদ করেনি৷ আমরা এতবছর পর যে তিনজন ব্যক্তি (কল্পনা চাকমা অপহরণে) অভিযুক্ত তাদের মধ্যে দুজনকে খুঁজে পেয়েছি৷ তবে লেফটেন্যান্ট ফেরদৌসের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি ৷

শহীদুল জানান, কল্পনা চাকমা অপহরণের জন্য প্রধান অভিযুক্ত লেফটেনেন্ট ফেরদৌস ৷ অথচ তাঁর সম্পর্কে কোন তথ্য সামরিক বাহিনীর কাছে নেই বা তারা তা প্রকাশ করতে চায় না ৷ শহীদুল বলেন, ‘‘একটা স্বাধীন দেশে এরকম একটি ঘটনা ঘটে যাবার পরে সাধারণ নাগরিকের জানার যে অধিকার, সেটা থেকে তাঁরা আজও বঞ্চিত হচ্ছে, এটা আমাকে অবাক করে ৷”

কল্পনা কি বেঁচে আছেন ?

কল্পনা চাকমাকে এখনো অপহৃত হিসেবেই বিবেচনা করছে তাঁর পরিবারের সদস্যরা৷ তাই তাঁকে ফিরে পাওয়ার স্বপ্ন কিছুটা হলেও দেখছেন কেউ কেউ৷ ১৭ বছর আগের এই অপহরণের প্রত্যক্ষ সাক্ষী কল্পনা চাকমার বড় ভাই কালিন্দী কুমার চাকমার সঙ্গে কথা বলে সেটাই মনে হয়েছে শহীদুলের৷ তবে বাস্তবতা তেমন নয় ৷ শহীদুল বলেন, ‘‘আমরা যদি ঠান্ডা বাস্তবতার কথা ভাবি, তাহলে আমাদের সকলের কাছেই বিষয়টি পরিষ্কার৷ শুধু যে তাঁকে ১৭ বছর ধরে পাওয়া যায়নি, তা নয়৷ তাঁর শেষ যে আর্তনাদ ‘দাদা মোরে বাঁচা ঐ জায়গা থেকে শোনা যায়৷ তারপর কিন্তু গুলির শব্দ শোনা যায়৷ এবং তারপরের দিন গ্রামবাসী সেই জলাশয়ে (যেখান থেকে আর্তনাদ এবং গুলির শব্দ শোনা গেছে) লাশ খুঁজে বেড়ায়, কিন্তু পায়নি ৷

শহীদুল বলেন, ‘‘সামরিক বাহিনীর স্বভাবও আমাদের জানা আছে, বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে, যেখানে এত রকমের হত্যাকাণ্ড হয়েছে, অত্যাচার হয়েছে, যেই নিপীড়নের ইতিহাসের মধ্যে যখন এরকম একজন শক্তিশালী, বিপ্লবী নেতাকে অপহরণ করা হয়, তারপরে তাঁকে পাওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত কম ৷

একমাত্র কাজ শোষণ করা –  

কল্পনা চাকমাকে অপহরণের পর পেরিয়ে গেছে ১৭ বছর ৷ এই সময়ে একাধিকবার সরকার বদল হয়েছে৷ কিন্তু কোনো সরকারই অপহরণের বিষয়টি সুরাহায় কার্যত কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি৷ তারমানে কি কোনো সরকারই সামরিক বাহিনীর বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী নয়? এ ধরনের প্রশ্নের জবাবে শহীদুল বলেন, ‘‘আমাদের সামরিক বাহিনীর প্রয়োজন আছে কিনা সেটাই আমি প্রথমে প্রশ্ন করি ৷ ৪৩ বছর ধরে আমরা যে সামরিক বাহিনীকে লালন করছি, তারা কিন্তু দেশরক্ষায় একবারও নিয়োজিত হয়নি ৷ আমাদের শান্তি আছে, সেটা ভালো ৷ তবে বিশাল অংক এদের পেছনে ব্যয় করা হচ্ছে ৷ যেটা শিক্ষায় যেতে পারতো, স্বাস্থ্যে যেতে পারতো, অন্যান্য খাতে যেতে পারতো ৷

শহীদুল বলেন, ‘‘এমনকি যে জায়গায় তাদের কাছ থেকে আমরা কিছু আশা করতে পারি, আমাদের সীমান্তে বাঙালিদের যে পাখির মতো গুলি করা হচ্ছে, বিএসএফ-রা গুলি করছে, সেখানে প্রতিবাদ করা, সেখানে অন্তত বাঙালিদের, বাংলাদেশিদের বাঁচানো, সেই কাজেও তারা (সেনাবাহিনী) কোনো কিছু করেনি ৷ তাদের একমাত্র কাজ শোষণ করা।

উল্লেখ্য, গত ১২ থেকে ২১ জুন ঢাকার দৃক গ্যালারিতে ‘কল্পনা চাকমার খোঁজে শীর্ষক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে৷ এর আগে দৃকে দুটি প্রদর্শনী সরকার বন্ধ করে দিলেও এবার সেরকম কিছু হয়নি বলে জানান শহীদুল ৷

সাক্ষাৎকার গ্রহণে : আরাফাতুল ইসলাম, সম্পাদনা: দেবারতি গুহ

সৌজন্যে: DW

সুত্র – http://www.chtnews.com/?p=254 ( ২৭ শে জুন ২০১৩)