মার্কসবাদী গেরিলা দলঃ ‘পপুলার লিবারেশন আর্মি’

epl

প্রাকৃতিক খনিজ সম্পদের আকর কলম্বিয়া। পেট্রোলিয়াম, কয়লা, তেল, স্বর্ণ, পান্না, কফি, কৃষিজাত পণ্যসহ মূল্যবান সব সম্পদ কোলে নিয়েই বেড়ে উঠেছে এক লাখ ১৪ হাজার ১৭৮ বর্গকিলোমিটারের এই দেশটি। সম্পদের পরিমাণ ঈর্ষণীয় বলে বারবারই নানা কায়দায় গ্রাস করতে চেয়েছে বড়সব রাঘব বোয়ালরা। তাই তো কোরিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র কলম্বিয়াই মিলিটারি দল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। যার মূল ইন্ধনদাতা ছিল খোদ আমেরিকা! ১৯৬০ সালের দিকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক দ্বিধাবিভক্তির কারণে কলম্বিয়ার সার্বিক পরিস্থিতি অশান্ত হয়ে পড়ে। সংকট নিরসনে সাম্যবাদের মূলমন্ত্র নিয়ে গড়ে উঠে বেশ কয়েকটি গেরিলা দল। এই দলগুলোর মধ্যে ‘এহেরচিতো পপুলার দে লিবারাসিওন’ বা ‘ইপিএল’ বেশ জনপ্রিয়। দলটিকে বিশ্ববাসী চিনে ‘পপুলার লিবারেশন আর্মি’ নামে। দলটির জনপ্রিয়তার মূলে ছিল তাদের কর্মপদ্ধতি ও গঠন-প্রক্রিয়া। ‘ইপিএল’ কাজ শুরু করে গ্রামের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষদের নিয়ে। এই মানুষদেরই প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি হয় জনমানুষের গেরিলা দল। কলম্বিয়ার আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় আমেরিকার অযাচিত নাক গলানো স্বভাব ছিল বরাবরই। কিন্তু ষাটের দশকে কম্যুনিজমের স্লোগান নিয়ে তৈরি হওয়া বেশ কয়েকটি গেরিলা দল আমেরিকাকে চিন্তিত করে তোলে। তাই কম্যুনিজমের অস্তিত্বকে নিশ্চিহ্ন করতে কলম্বিয়ান মিলিটারি বাহিনীকে তাদেরই গ্রাম্য কৃষক ও ছোট ছোট গোত্রগুলোর বিরুদ্ধে উসকে দেয়। ফল হলো, ‘ইপিএল’সহ গেরিলা দলগুলোর সঙ্গে কলম্বিয়ান মিলিটারির দীর্ঘ যুদ্ধ।
১৯৬৭ সালে ‘কম্যুনিস্ট পার্টি অব কলম্বিয়া (মার্ক্সিস্ট-লেলিনিস্ট)’-এর একটা বড় অংশ তৈরি করে ‘ইপিএল’ বা ‘পপুলার লিবারেশন আর্মি।’ গ্রামীণ পরিবেশে নিজেদের শক্ত অবস্থানের কারণে যখন বহিঃশক্তি আক্রমণ চালাতে বেগ পেল না, তখনই সন্ত্রাসী তকমা দিয়ে প্রচারণা শুরু করে দিল বিশ্বদরবারে। সত্তরের দশকে ‘ইপিএল’-এর সব বড় নেতাকে নির্বিচারে হত্যা করা হলো। জনগণের অধিকার সমুন্নত রাখার শর্তে ১৯৮৪ সালের দিকে সরকারপক্ষের আহ্বানে তারা যুদ্ধ ক্ষান্ত দেয়। এতে অসমর্থন দেখিয়ে প্রায় দুই হাজার কর্মী অন্যান্য গেরিলা দলে যোগ দেয়। ওপরে সব ঠিকঠাক দেখালেও ১৯৯১ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত ‘ইপিএল’ নেতাদের ৩৪৮ জনকে গুপ্ত হত্যা করা হয়। যার ফলে, ‘ইপিএল’ ফ্রান্সিসকো কারাবালোর নেতৃত্ব নতুন করে রূপ নিল। তবে এবার তাদের আকার ছোট ও অনেকটাই গোপনীয়।

c8b574eb3bf2ed76c1405d112a5e841f

 


মাওবাদী গেরিলা দল – ‘ভুটান টাইগার ফোর্স’

Communist_Party_of_Bhutan_Flag.svg

ভারত ও চীনের মধ্যবর্তী ছোট্ট এলাকা নিয়ে রয়েছে ভুটান। দুই পার্শ্ববর্তী শক্তিশালী দেশের চাপের কারণে দীর্ঘদিন ভুটান নিজেদের গুটিয়ে রেখেছিল বহির্বিশ্বের কাছে। এমনকি টেলিভিশন, ইন্টারনেট- সব কিছুই সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ ছিল দেশটিতে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত। জনগণের সুখে থাকার সংখ্যা দ্বারা নির্ধারিত হয় দেশটির উন্নয়ন; অন্তত এমনটাই প্রচারিত হতো। এ প্রচার-প্রচারণার মধ্যে দেশটির অভ্যন্তরীণ শাসন ব্যবস্থা মূলত দীর্ঘদিন রাজতন্ত্রের হাতে বন্দি ছিল। উত্তরাধিকারসূত্রে রাজা দর্জি ওয়ানচেকের পর ক্ষমতাসীন হন তাঁর ১৬ বছরের ছেলে। দীর্ঘ বছর ধরে চলতে থাকা রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ হওয়ার কোনো চিহ্ন ভুটানে ছিল না। কিন্তু ২০০০ সালের দিকে ভুটানের রাজা গোটা ভুটানের ভাষা ও সীমারেখা পুনর্নিধারিত করলে নেপালি ভাষাভাষী ভুটানিরা তার প্রতিবাদ জানায়। এ ঘটনার প্রেক্ষিতে ১০ দফা দাবি নিয়ে যাত্রা শুরু করে ‘দ্য ভুটান কমিউনিস্ট পার্টি’; যা সংক্ষেপে ‘সিপিবি’ নামে পরিচিত। আর ভুটান কমিউনিস্ট পার্টির(BCP [MLM]) সশস্ত্র বাহিনী ‘ভুটান টাইগার ফোর্স’ মূলত গেরিলা বাহিনী হিসেবে কাজ করে। ২০০৩ সালের ২২ এপ্রিল যাত্রা শুরু হয় ভুটান টাইগার ফোর্সের।

রাজতান্ত্রিক শাসন ক্ষমতা ভেঙে নয়া গণতান্ত্রিক ভুটান প্রতিষ্ঠা দলটির মূল দাবি। তা ছাড়া আদর্শিকভাবে মার্ক্সিস্ট-লেনিনিস্ট-মাওইস্ট ভাবনাপন্থী হওয়ায় সার্বিকভাবে সামাজিক সাম্য ও বৈষম্যহীনতা একান্ত কাম্য। ক্ষমতাবান দুই প্রতিবেশীর কারণে ভুটানের রাজা বরাবরই ব্রিটেনের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখেছেন। ফলে ভুটানের শাসনব্যবস্থায় ব্রিটেনের প্রভাব স্পষ্ট। তাই গণতন্ত্র, সাম্য- সব মিলিয়ে স্বাধীন, সর্বোভৌম ভুটান প্রতিষ্ঠা দলটির প্রধানতম দাবি। গেরিলা দলটিকে নেপালি কমিউনিস্ট পার্টি ট্রেনিং, অস্ত্র, লোকবল- সব কিছু দিয়েই সাহায্য করছে শুরু থেকেই। ভুটানে নিষিদ্ধ হলেও ‘ভুটান টাইগার ফোর্স’ এখনো আন্ডারগ্রাউন্ড গেরিলা দল হিসেবে কাজ করছে। দলটি ২০০৭ সালের ১৩ই ডিসেম্বর, ২০০৮ সালের ২৩শে এপ্রিল ও ৩০শে ডিসেম্বর, ২০০৯, ২০১০ সালে কয়েকটি গণযুদ্ধ পরিচালনা করে।  দলটির বর্তমান গেরিলা সদস্যের সংখ্যা প্রায় ৬০০-১০০০ জন।


মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বামপন্থি গেরিলা দলঃ ব্ল্যাক প্যান্থার পার্টি

ব্ল্যাক প্যান্থার পার্টির শীর্ষ ৬ নেতৃত্ব(নভেম্বর, ১৯৬৬)। ছবির বাম থেকে ডানে: Elbert “Big Man” Howard; Huey P. Newton (Defense Minister), Sherman Forte, Bobby Seale (Chairman). Bottom: Reggie Forte and Little Bobby Hutton (Treasurer)

দ্য ব্ল্যাক প্যান্থার পার্টি বা বিপিপি (প্রকৃত ভাবে দ্য ব্ল্যাক প্যান্থার পার্টি ফর সেলফ ডিফেন্স) একটি বিপ্লবী কৃষ্ণাঙ্গ জাতীয়তাবাদী ও সমাজতান্ত্রিক গেরিলা সংগঠন ছিল। ১৯৬৬ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এর কার্যক্রম অব্যহত ছিল। এছাড়া আন্তর্জাতিক ভাবে ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত আলজেরিয়াতে এ সংগঠনটি কাজ করেছিল।

ষাটের দশক। গোটা আমেরিকাজুড়ে চলছে নতুন আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত তৈরির যুদ্ধ। তার মধ্যে বর্ণবৈষম্যের তীব্র শিকার হচ্ছে কালোরা। আমেরিকান সাদা নাগরিক ও তাদের পুলিশের হাতে কালোরা প্রতিনিয়ত নির্মমভাবে অত্যাচারিত হতে থাকে, যা ইতিহাসে ‘পুলিশ ব্রুটালিটি’ নামে পরিচিত। সব ধরনের বৈষম্যের শিকার ও নিপীড়িত মানুষদের অধিকার আদায়ের জন্য গড়ে উঠে ‘ব্ল্যাক প্যান্থার পার্টি ফর সেলফ ডিফেন্স’ সংক্ষেপে ‘ব্ল্যাক প্যান্থার পার্টি’ বা ‘বিপিপি’। ১৯৬৬ সালের ১৫ অক্টোবর হুয়ে নিউটন ও ববি স্কেলের নেতৃত্বে আত্মপ্রকাশ করে। বিপিপির অন্য শাখাগুলোর মূল নেতা হিসেবে যোগ দেন আলবার্ট হওয়ার্ড, শেরয়েন ফোর্টে, রেগে ফোর্টে ও লিটল ববি হুটন।

প্রথমদিকে শুধু কালোদের প্রতিরক্ষাকে মূল করে পার্টি গঠিত হলেও অল্প দিনেই পুঁজিবাদ, ফ্যাসিবাদ, বর্ণবৈষম্য, সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে কিন্তু সাম্যবাদী, নারীবাদী, মার্ক্স-লেনিন ও মাও-এর আদর্শে রূপান্তরিত হয়। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, ন্যায়বিচার, সম-অধিকার, শান্তিসহ মোট দশ দফা যুগান্তকারী ধারণা নিয়ে ওকল্যান্ডের একটি স্কুলে নিয়মিতভাবে পার্টির কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতে থাকে।  ১৯৬৯ সালে, দলটি বিভিন্ন সামাজিক সেবামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। অর্থনৈতিক সাম্যতার প্রতীক হিসেবে এলাকার শিশুদের জন্য সকালের খাবার বিনা মূল্যে দেওয়া ও অসুস্থদের স্বাস্থ্যসেবা প্রদান ইত্যাদি। । এর পাশাপাশি লাইব্রেরি স্থাপন, বিদ্যালয় পরিচালনা, আত্মরক্ষার কৌশল শেখানো ও প্রাথমিক চিকিৎসা সম্পর্কে ধারণাসহ নানান কর্মসূচি হাতে নেয়।

মাত্র দুই বছরের মাথায় ১৯৬৯ সালের মধ্যে গেরিলা দলটি আমেরিকার বোস্টন, শিকাগো, ফিলাডেলফিয়া, নিউ ইয়র্ক, লস অ্যাঞ্জেলেস, সানফ্রান্সিসকোসহ প্রায় ২০টি স্থানে তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। এ সময়ে দশ হাজারের বেশি কর্মী ও নেতৃত্ব গড়ে ওঠে। এমন অবস্থায় দেশটির ক্ষমতাসীন সবার টনক নড়ে ওঠে। যার ফলে এফবিআই ‘বিপিপি’কে দেশটির অভ্যন্তরীণ সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে ঘোষণা দেয় এবং এর প্রেক্ষিতে কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স প্রোগ্রাম (COINTELPRO) নামে একটি গুপ্ত পরিকল্পনা চালায় দলটিকে মানুষের কাছে খারাপ ও অকার্যকর করে তোলার উদ্দেশ্যে। যাতে করে তারা হয়ে পড়ে অনেকটাই নিঃস্ব। শুরু হয় ব্যাপক হারে ধরপাকড় ও গণমাধ্যমে অপপ্রচার।

একদিকে দলটিকে অবৈধ ঘোষণা করে প্রচার করতে থাকে- এরা মাদকসহ অনৈতিক কাজে যুক্ত; অন্যদিকে গুপ্তহত্যার শিকার হয় দলটির নেতা-কর্মীরা। শুধু ১৯৭০ সালেই দলটির মূল ১০ নেতাকে হত্যাসহ অগুণিত কর্মীকে গুম ও বিকলাঙ্গ করে ফেলা হয়। ১৯৭২ এর দিকে দলটির কার্যক্রম শুধু ওকল্যান্ডে তাদের সদর দপ্তরে ও একটি বিদ্যালয়ে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ে। সেখানে তারা স্থানীয় রাজনীতিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। সত্তরের দশক ধরে ধীরে ধীরে দলটি নিস্ক্রিয় ও স্তিমিত হয়ে পড়ে। ১৯৮০ সালে ব্ল্যাক প্যান্থার পার্টির নেতাকর্মী অবশিষ্ট ছিল মাত্র ২৭ জন।

ব্ল্যাক প্যান্থার পার্টির ইতিহাস বিতর্কিতই থেকে যায়। ব্ল্যাক প্যান্থার পার্টিকে ১৯৬০ এর দশকের সবচেয়ে প্রভাবশালী কৃষ্ণাঙ্গ আন্দোলন সংগঠন এবং স্বদেশী কৃষ্ণাঙ্গদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও বিশ্বব্যাপী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী যোগসূত্র স্থাপনকারী হিসেবে অভিহিত করা হয়।

তথ্য সূত্রঃ ইন্টারনেট

 


ভারতের মাওবাদী গেরিলা দল PLFI প্রধানের একটি সাক্ষাৎকার

1

সিপিআই (মাওবাদী) এর সাথে পিএলএফআই এর মতাদর্শের দিক থেকে মিল আছে তবে কার্যক্রমে ভিন্নতা রয়েছে 

ঝাড়খণ্ড, উড়িষ্যা, বিহার ও ছত্তিসগড়ে সক্রিয় রাষ্ট্র কর্তৃক একটি নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন পিএলএফআই (People’s Liberation Front of India-PLFI)। সিপিআই (মাওবাদী) এর পর ঝাড়খণ্ডে এটি দ্বিতীয় বৃহত্তম বাম ধারার সশস্ত্র দল। ১২টি রাজ্যের ২৪টি জেলায় এ সংগঠনটি সক্রিয়। রাষ্ট্র কর্তৃক এ ধরনের অন্তত ১৭টি নিষিদ্ধ ঘোষিত দল রয়েছে।  

গত বছরের ৮ মার্চ  AJSU(All Jharkhand Students` Union )এর নেতা তিলেশ্বর সাহুকে গুলি করে হত্যা করে পিএলএফআই এর ক্যাডাররা।

উড়িষ্যার সুন্দরগড় ও রাউরকেল্লা জেলায় এ দলটি সক্রিয়। ২০১২ সালে সুন্দরগড় জেলায় ঠিকাদার হরদীপ সিং ও রাজ্যসভা সদস্য মঙ্গলা কিষণকে চাঁদার জন্য হত্যা করে পিএলএফআই।

২০১৪ সালে রাউরকেল্লাতে পিএলএফআই এর জোনাল কমান্ডার জয়নাথ গোপকে এক বন্দুকযুদ্ধে হত্যা করে পুলিশ।

গত ৩০শে মার্চ বিহারের রাজধানী পাটনায় একটি ফ্ল্যাটে বোমা বিস্ফোরণের দায় স্বীকার করে পিএলএফআই।

ছত্তিসগড়ের জশপুর অঞ্চলে পিএলএফআই সক্রিয় রয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের আদিবাসী অধ্যুষিত বেল্টগুলোতে এর ভিত্তি তৈরি হতে শুরু করেছে।

পিএলএফআই এর সশস্ত্র স্কোয়াডে রয়েছে তরুণদের দল ও এর নেতৃত্বে রয়েছে একজন যুবক।

পিএলএফআই এর অস্ত্র ভান্ডারে রয়েছে একে ৪৭, একে ৫৬ এসল্ট রাইফেল, এলএমজি, আমেরিকায় তৈরি এম ১৬ রাইফেল, কারবাইন, গ্রেনেড লাঞ্চার ও মর্টার।

2

প্রাক্তন সৈনিক দীনেশ গোপ (৩৩) ভারতীয় আর্মিতে যোগ দেয়ার তিন বছর পর ২০০৩ সালে আর্মি ত্যাগ করেন ও বিদ্রোহী দল গঠন করেন। এর কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, লাদাখে তার উচু স্তরের এক আর্মি সদস্যকে একজন নারীকে ধর্ষণ করতে দেখেছিলেন।

স্বাস্থ্যবান গোঁফধারী ছয় ফিট লম্বা দীনেশ ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। তিনি দশটির বেশী ভাষায় কথা বলতে পারেন। তার কাঁধে ঝোলানো ব্যাগে ৩৫টির মতো মোবাইল ফোন থাকে এবং দলের সশস্ত্র কর্মীদের সাথে মোটরসাইকেল বহরে চলাফেরা করেন।

গোপের সাথে সাক্ষাতের জন্য ঝাড়খণ্ড-উড়িষ্যা সীমান্তের কাছে অপ্রকাশিত একটি স্থানে হিন্দুস্তান টাইমসকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। জাতীয় দৈনিকে দেয়া তার প্রথম সাক্ষাৎকারে গোপ বেশ কিছু বাঁকা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন।

আপনারা নিরীহ লোকদের হত্যা করেন কেন?

আমরা কেবল তাদের হত্যা করি যারা সমাজ বিরোধী ও যারা গরীব ও নিরীহ মানুষদের শোষণ করে। শান্তি সেনার মতো প্রতিপক্ষের কিছু গোষ্ঠী যারা পুলিশের ছত্রছায়ায় কর্মকাণ্ড চালায় তারাই এসমস্ত কর্মকাণ্ড করে আমাদের ঘাড়ে দোষ চাপায়। পুলিশ যা বলে গণমাধ্যম তাই প্রচার করে। আমাদের জনপ্রিয়তা বাড়ছে, তাই লোকজন আমাদের দলের নাম ব্যবহার করছে।

সিপিআই (মাওবাদী) এর সাথে পিএলএফআই পার্থক্য কী?

আমাদের মতাদর্শে মিল আছে কিন্তু আমাদের কর্মকাণ্ড তাদের থেকে আলাদা। আমরা শিশুদের হাতে অস্ত্র তুলে দিই না, তারা দেয়। আমরা স্কুল তৈরী করি, তারা স্কুল উড়িয়ে দেয়। আমরা শিশুদের স্কুলে ভর্তি করাই, তারা তাদের সশস্ত্র স্কোয়াড ও শিশু ইউনিটের সদস্য সংগ্রহের জন্য শিশুদের অপহরণ করে নিয়ে যায়।

আপনাদের সশস্ত্র স্কোয়াডের শক্তি কী?

পাঁচটি রাজ্যে আমাদের ৭০০০ থেকে ৮০০০ যোদ্ধা আছে।

বন্দুক আর রক্তপাত কি কোন সমস্যার সমাধান হতে পারে?

ইতিহাস বলে রক্তপাত ব্যতীত কোন বিপ্লব ঘটেনি। বন্দুক হল সমাজে আকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনার একটি মাধ্যম মাত্র।

পিএলএফআই এর মধ্যে প্রচুর স্ববিরোধীতা আছে। আপনি বলছেন আপনারা রাষ্ট্রের বিরোধী অথচ আপনাদের নেতারা ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছে  ও সাংবিধানিক পদে বসে আছে।                                                                                  

সময়ে সময়ে সিস্টেমকে ভালোভাবে বুঝতে হলে আপনাকে সিস্টেমের মধ্য দিয়ে যেতে হবে।

আপনার শক্তিশালী রাজনৈতিক যোগাযোগের কারণে আপনি এখনো পর্যন্ত গ্রেফতার হননি                                                                                       

আমি রাষ্ট্রের (রাজনীতিবিদদের জন্যেও) সবচেয়ে বড় শত্রু। আমাকে গ্রেফতারের উদ্দেশ্যে যে অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে তা থেকে পুলিশ ও রাজনীতিবিদেরা বিপুল পরিমাণ অর্থ নিয়ে থাকে।

 

পিএলএফআই বিপুল অংকের চাঁদা আদায় করে থাকে। হিসাবের বাইরের অর্থগুলো কোথায় যায়?                                                                                         

আমাদের অর্থের হিসাব অডিট করা হয় এবং এ অর্থ সংগঠনের কল্যাণে ব্যয় করা হয়। অর্থের অধিকাংশ যায় জনগণের কল্যাণে।

আপনাদের জন্য যারা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে তাদের জন্য আপনারা কী করেছেন?

ওরা আমার মত জন্ম থেকে বিপ্লবী। ওরা অর্থ বা কোন কিছু পাওয়ার আশায় আসেনি। আমরা সবাই মিলে সেই অধরা সমাজের বীজ বপন করছি যেখানে গরীবদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে।

আপনারা নারী ও শিশুদের কেন দলে ঢোকান?

আমরা ওদের দলে ঢোকাই না। যদি অপ্রাপ্তবয়স্ক কোন কিশো বা কিশোরী স্বেচ্ছায় আসতে চায়, তাহলে আমরা তাকে বাধা দিই না।

আপনাদের মূল লক্ষ্য কী?

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমাদের মতাদর্শকে ছড়িয়ে দেয়া আমাদের লক্ষ্য। আকসাম ভিত্তিক চা বাগানের শ্রমিকদের একটি সংগঠনের সাথে আমাদের আলোচনা চলছে। আমরা উত্তরখণ্ড ও হরিয়ানাতেও আমাদের কার্যক্রম বিস্তৃত করেছি। বর্তমানে আমাদের বাহিনীর ক্যাডাররা শ্রীলংকা, মরিশাস, চীন ও নেপালের সমমনা সংগঠনগুলোর সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।

গ্রামবাসীদের জন্যে PLFI কর্তৃক নির্মিত মন্দির

গ্রামবাসীদের জন্যে PLFI কর্তৃক নির্মিত মন্দির

অনুবাদ সূত্রঃ

http://www.hindustantimes.com/ranchi/plfi-maoists-interview/article1-1346169.aspx


সাম্রাজ্যবাদী/পুঁজিবাদী গেরিলা দল ‘কন্ট্রা’

download

গেরিলা সংগঠনের ইতিহাসে কন্ট্রা একটি ব্যতিক্রমী ধারা, যারা সমাজতন্ত্রের বিরোধিতা করে পুঁজিবাদী সমাজ নির্মাণে লড়ে গেছে। গেরিলা গোষ্ঠীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় পৃথিবীর প্রায় সব গেরিলা গোষ্ঠিই সমাজতান্ত্রিক ধ্যানধারণা নিয়ে সাম্যবাদী সমাজ বিনির্মাণের উদ্দেশ্যে গড়ে উঠেছিল। তবে নিকারাগুয়াতে ১৯৭৯ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত সক্রিয় কন্ট্রা গেরিলাদের উদ্দেশ্য ছিল এর সম্পূর্ণ বিপরীত। এটাই পৃথিবীর একমাত্র গেরিলা গোষ্ঠী যাদের উদ্দেশ্য ছিল সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে কাজ করা, সমাজতান্ত্রিক ধ্যান ধারণাকে ধূলিসাৎ করে পুঁজিবাদের ঝান্ডা ওড়ানো।

‘কন্ট্রা’ শব্দটির উৎপত্তি ল্যাতিন শব্দ কন্ট্রা হতে যার অর্থ ‘বিরোধী’। তবে কন্ট্রার অনেক সদস্য তাদের  কন্ট্রা বলে পরিচয় দিতে অস্বস্তি বোধ করেন। তারা মনে করতেন কন্ট্রা শব্দটি নেতিবাচক অর্থ বহন করে। তাই তারা নিজেদের কমান্ডোস বা লস প্রিমস বলে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। নিকারাগুয়ার ত্রাস এই গেরিলা গোষ্ঠীটি সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের নায়ক যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়ানে পরিচালিত হতো। কিন্তু কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদের ফিরে যেতে হবে গত শতকের নব্বইয়ের দশকে।

নব্বইয়ের দশকের শুরুতে নিকারাগুয়ার শাসন ক্ষমতায় আসে বামপন্থি দল সানডিনিয়ান্থে জান্তা অব ন্যাশনাল রিকন্সট্রাকশন সরকার। এতে করে আশা ভঙ্গ হয় মার্কিন প্রশাসনের । তারা অচিরেই বুঝতে পারে বামপন্থি এ সরকার কিউবা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নিকারাগুয়ায় তাদের স্বার্থের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। ফলে শুরু হয় ষড়যন্ত্র। যেটা ১৯৮২ সালে এসে অত্যন্ত কদর্য রুপ ধারণ করে। এ বছরই রিগানের প্রশাসন কন্ট্রা বিদ্রোহীদের সহায়তার জন্য প্রায় ১৯ মিলিয়ন এবং ১৯৮৪ সালে এসে প্রায় ২৪ মিলিয়ন ডলার অনুমোদন করে। মূলত স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ৪০তম প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান সরকারের প্রত্যক্ষ মদদ ও অর্থায়নে এ বিদ্রোহী গোষ্ঠীটি পরিচালিত হতো। এক কথায় কন্ট্রার বিদ্রোহীদের যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনার অর্থ প্রদান, তাদের প্রশিক্ষণ, অস্ত্র প্রদান সব কিছুই হতো মার্কিন সরকারের ইশারায়। যদিও এ দাবি সব সময় প্রত্যাখ্যান করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে পরে এটা জনসম্মুখে প্রকাশ হয়ে পড়ে এবং মার্কিন কংগ্রেস কন্ট্রার জন্য  সরাসরি সহয়তা বাতিল করলে। কিন্তু  রিগান প্রশাসন গোপনে তাদের সহায়তা কার্যক্রম অব্যাহত রাখে।

প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূল ব্যাতীত সমগ্র নিকারাগুয়ার গ্রামীণ অঞ্চলে ২৩ হাজার সদস্যের এই বিদ্রোহী গোষ্ঠী তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করত। এদের মূল লক্ষ্যই ছিল নিকারাগুয়ার সরকারের স্বার্থে আঘাত করে মার্কিন স্বার্থ রক্ষা করা। ১৯৭৯ থেকে ১৯৯০ সাল এই ১১ বছরে কন্ট্রা বিদ্রোহীরা নিকারাগুয়াতে প্রায় তেরশোর মতো বিচ্ছিন্ন আক্রমণ বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। সরকার ব্যাতীত তাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু ছিল বিভিন্ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। হামলা করে ওষুধপত্র ছিনিয়ে নেওয়া ও স্বাস্থ্য কর্মীদের অপহরণ, বেসামরিক লোক অপহরণ, তাদের সম্পত্তি লুটপাট নয়তো জ্বালিয়ে দেওয়া, নারী ও শিশু পাচারের মতো অপকর্মে লিপ্ত থাকত কন্ট্রা বিদ্রোহীরা।

১৯৮৬ সালে এফএসএলএন-সমর্থিত ডেনিয়েল ওর্তেগা সরকার কন্ট্রা বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযান শুরু করে। এরপর ১৯৮৬ থেকে ১৯৮৮ সাল এই  তিন বছরে বেশ কয়েকটি বড় বড় সামরিক অভিযানের মুখে কন্ট্রা বাহিনী ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সামরিক অভিযান তদুপরি মার্কিন প্রশাসনের সহায়তা প্রকল্প বাতিল হওয়ার ফলে কন্ট্রা বিদ্রোহীরা ১৯৮৯ সালের ডিসেম্বর মাসে কিছু শর্ত সাপেক্ষে অস্ত্র জমাদানে সম্মত হয়।

কন্ট্রা বিদ্রোহীদের দাবিদাওয়ার মধ্যে অন্যতম ছিল একটি অবাধ-সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। বিদ্রোহীদের দাবির মুখে তৎকালীন সরকার ১৯৯০ সালে নির্বাচনের আয়োজন করে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে ডেনিয়েল ওর্তেগার সরকার নির্বাচনে পরাজিত হয়। তবে ধারণা করা হয়, এই পরাজয়ের পিছনে মার্কিন প্রশাসনের হাত ছিল। এরপর বিদ্রোহীদের অনেকে বিভিন্ন দলে ঢুকে রাজনীতি শুরু করে। তবে অধিকাংশ বিদ্রোহী স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে এবং রাজনীতি থেকে দূরে চলে যায়। ১৯৯০ সালের নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে সমাপ্ত হয় কন্ট্রার ইতিহাস।


পেরুর মাওবাদী গেরিলা দল ‘শাইনিং পাথ/Shining Path’

Communist-Party-of-Peru-Shining-Path

সত্তর বা আশির দশকে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ল্যাতিন আমেরিকার যে কয়টি গেরিলা সংগঠন অদ্যবধি তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে, তাদের মধ্য কমিউনিস্ট পার্টি অব পেরু অন্যতম। এই মাওবাদী গেরিলা সংগঠনটিই সারা বিশ্বে শাইনিং পাথ নামে ব্যাপকভাবে পরিচিত। নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে দক্ষিণ পেরুর স্যান ক্রিস্টোবাল হুমাংগা ন্যাশনাল ইউনির্ভাসিটি দর্শনের অধ্যাপক এবিমিয়েল গুজমানের হাত ধরেই এর যাত্রা শুরু। কার্ল মার্ক্সের ডিকটেটরশিপ অব দ্য প্রলিতারিয়েত বা শ্রমজীবী মানুষের ক্ষমতায় আরোহণ তত্ত্বের বাস্তবায়নই ছিল এ গেরিলা দলের মূল উদ্দেশ্য।

শাইনিং পাথ গেরিলা দলের ভাষ্য মতে, গণযুদ্ধের লাইন ছাড়া এখন বিশ্বে যেসব কমিউনিস্টপন্থি দল রয়েছে এরা সবাই সংশোধনবাদীতে পরিণত হয়েছে। বুর্জোয়া শ্রেণির ছত্রছায়ায় প্রত্যেকে ক্ষমতার ছায়াতলে থাকতে চায়। এ সব সুবিধাবাদী কমিউনিস্ট দলগুলোকে সরিয়ে সমগ্র বিশ্বে কমিউনিস্ট আন্দোলনকে বেগবান করাই ছিল এদের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, এদের কর্মপন্থা, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ভারতের মাওবাদী গেরিলা সংগঠন সিপিআই(মাওবাদী)’র মতো।

মাওবাদী গেরিলা দল শাইনিং পাথের কার্যক্রমকে সময়ের তিন অংশে ভাগ করা হয়। এর প্রথম পর্যায় হচ্ছে বিশ শতকের ১৯৬০ থেকে ১৯৯২ সাল। দ্বিতীয় পর্যায় ১৯৯২ থেকে ১৯৯৯ সাল এবং তারপর একবিংশ শতকের ২০০৩ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত। যদিও ধরে নেওয়া হয় শাইনিং পাথের উত্থান নব্বইয়ের দশকের শুরুতে, তবে এর প্রতিষ্ঠা কিন্তু আরো আগে ১৯৬০ সালে। শাইনিং পাথের প্রতিষ্ঠাতা এবিমিয়েল গুজমান, স্যান ক্রিস্টোবাল অব হুমাংগা ইউনির্ভাসিটিতে দর্শন শাস্ত্র পড়াতেন। ১৬৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়কে শাইনিং পাথের আতুরঘর বলা হয়। ধারণা করা হয়, দর্শনশাস্ত্রে বোদ্ধা গুজম্যান তার লেকচারের মাধ্যমে ছাত্রদের শাইনিং পাথে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হন। তবে শাইনিং পাথ প্রথম দৃশ্যপটে আসে ১৯৮০ সালের এপ্রিল মাসে। প্রায় এক যুগের অচলাবস্থার পর একই বছর পেরুর সামরিক শাসক শ্রেণি নির্বাচনের আয়োজন করে। তবে শুরু থেকেই যে কয়টি দল নির্বাচনের বিরোধিতা করে আসছিল তাদের মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টি অব পেরু বা শাইনিং পাথ অন্যতম। কিন্তু কোনোভাবেই কোনো প্রচেষ্টায় যখন নির্বাচন প্রতিহত করা যাচ্ছিল না, তখন শাইনিং পাথ সশস্ত্র সংগ্রামের পথ বেছে নেয়। ১৯৮০ সালে এপ্রিল মাসের ১৭ তারিখে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ঠিক আগে তারা দক্ষিণ আন্দিজ পর্বতমালার পাদদেশে অবস্থিত সুসাই শহরের ভোটকেন্দ্রের ব্যালট বাক্স ও পেপার পুড়িয়ে দেয়। এটাই ছিল তাদের প্রথম প্রতিবাদ। তবে অগ্নিসংযোগকারীদের খুব দ্রুত ধরা হয়। এতে করে ঘটনাটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে জনসম্মুখে প্রকাশ পায়। এরপর  ১৯৮০ ও ১৯৮১ সালের পুরোটা সময় শাইনিং পাথ তাদের সদস্য সংগ্রহ ও বিভিন্ন এলাকায় তাদের নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করতে থাকে। এভাবে তারা দক্ষিণ পেরুর অনেকখানি অংশে তাদের প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। দক্ষিণ অঞ্চলে শাইনিং পাথ এতটাই শক্তিশালী হয়ে ওঠে যে ১৯৮১ সালের ২৯ ডিসেম্বর সরকার আন্দিজ পর্বতমালার পাদদেশীয় আয়েকচো হুয়ানক্যাভেলিকা ও অপুরিম্যাক অঞ্চলে জরুরি অবস্থা জারি করে তাদের দমনে সামরিক বাহিনী প্রেরণ করে। সামরিক বাহিনী, পুলিশ এবং রোন্ডাসের (স্থানীয় কৃষক সম্প্রদায়ের সমন্বয়ে গঠিত ও সামরিক বাহিনী কতৃক প্রশিক্ষিত এন্টি রেবেল মিলিশিয়া) ত্রিমুখী লড়াই চলে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত।

শুরুতে কৃষকরা এর বিপক্ষে থাকলেও পরে তারা এর পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে। শাইনিং পাথ গোটা দেশে বিদ্যুত বিপর্যয় ঘটানোর জন্য বিদ্যুতকেন্দ্রগুলোতে হামলা, কারখানায় বোমা বিস্ফোরণ ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ওপর হামলা করত।

এভাবেই হামলা, পাল্টা হামলার মধ্যে দিয়েই কাটে প্রায় একযুগের ও বেশি সময়। আসে ১৯৯২ সাল। এ বছরটাই শাইনিং পাথ গেরিলাদের সবচেয়ে বিপর্যয়কর বছর হিসেবে বিবেচিত। এ বছরই পুলিশের হাতে গুজমানসহ শাইনিং পাথের প্রথম সারির অনেক নেতাই ধরা পড়ে। গুজমান ধরা পড়ার পর শাইনিং পাথ অনেকটাই নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়ে। কারণ তার বিকল্প কোনো নেতাই ছিল না যিনি গেরিলাদের নেতৃত্ব দেবে। তা ছাড়া গুজমান জেলে অন্তরীণ থাকা অবস্থায় সরকার কর্তৃক সাজানো অতঃপর প্রচারিত যে গুজমানের সরকারের সঙ্গে শান্তি আলোচনার ঘোষণা দেওয়া নিয়ে শাইনিং পাথ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। একটি অংশ আত্মসমর্পণ করে। অপর একটি অংশ গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয় এবং এই অংশের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন অস্কার রামিরেজ। রামিরেজ কিছু দিন নেতৃত্ব দেওয়ার পর ১৯৯৯ সালে সরকারি বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন এবং শাইনিং পাথ আবার নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়ে।

অধ্যাপক এবিমিয়েল গুজমান

অধ্যাপক এবিমিয়েল গুজমান

তবে শাইনিং পাথ যেন ফিনিক্স পাখি। বারবার ধ্বংসের মধ্যে থেকে জেগে ওঠে। একবিংশ শতকের গোড়ার দিকে এই বাহিনীর সদস্যরা আবার একত্রিত হতে থাকে। এ সময় কমরেড আর্টিমিও এর হাল ধরে। আর্টিমিও নেতৃত্বে আসার পর শাইনিং পাথ বেশ কয়েকটি বড়বড় অপরেশন পরিচালনা করে। এরমধ্যে ২০০২ সালে পেরুর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল লিমায় যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের বাইরে গাড়ি বোমা বিস্ফোরণ, ২০০৩ সালে আর্জেন্টাইন কোম্পানি টেকইনটের ৬৮ জনের মতো কর্মীকে ও তিনজন পুলিশ সদস্যকে অপহরণ, ২০০৫, ২০০৬ ও ২০০৯ সালে সরকারি বাহিনীর ওপর অতর্কিত হামলা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ২০১২ সালে কমরেড আর্টিমিও গুরুতর জখম অবস্থায় সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। ২০১৩ সালের ৭ জুন আর্টিমিওর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা, মাদকপাচারের অভিযোগ এনে পেরুর সরকার তাকে আজীবন জেল ও প্রায় ১৮৩ মিলিয়ন ইএস ডলার জরিমানা করে। তবে এত কিছুর পরও পেরু থেকে শাইনিং পাথ যে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি, সেটাই সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়। ২০১৫ সালে এ গেরিলা গোষ্ঠী আবার আলোচনায় এসেছে।

সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই আজো জারি রেখেছে শাইনিং পাথ।

1


গেরিলা দল ‘মন্টোনেরস’ পরিচিতি –

200px-Seal_of_Montoneros.svg

Roberto-Perdia-Montoneros_CLAIMA20130607_0183_24

১৯৬০ থেকে ‘৭০ সাল পর্যন্ত আর্জেন্টিনার রাজনীতির অঙ্গন দাপিয়ে বেড়িয়েছিল মন্টোনেরস নামের একটি গেরিলা দল। ষাটের দশকের উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতির রেশ লাতিন আমেরিকার প্রায় সব কটি দেশেই। ক্ষমতাসীন জনবিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধে সরব হয়ে উঠেছিল বাম দলগুলো। তেমনি একটি গেরিলা দল মন্টোনেরস। সত্তরের দশকে আর্জেন্টিনার গণতান্ত্রিক সরকারের আড়ালে চরম আকার নেয় ফ্যাসিবাদী সরকার। প্রায় একনায়কতন্ত্রী সরকার হিসেবেই ক্ষমতার যথেচ্ছ অপব্যবহার করছিল সরকার। ফলস্বরূপ, শ্রেণীবৈষম্য ও অরাজকতা প্রকট আকার ধারণ করে। তার প্রতিবাদেই সাধারণ মানুষদের নিয়ে গড়ে ওঠে মন্টোনেরস। মূলত তরুণ ও যুবকরাই ছিল এর মূল শক্তি। প্রথম দিকে সরকারের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সমাধান করতে চাইলেও তা ডানপন্থী সরকারের অনিচ্ছায় সম্ভব হয়নি, উল্টো অনেক ক্ষেত্রেই সরকার বেইমানি করে। অবশেষে বাধ্য হয়েই জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আনুমানিক ১৯৭০ সালে গঠিত হয় মন্টোনেরস গেরিলা দলটি। সরকারের ফ্যাসিবাদী কাজে অনাস্থা জানিয়ে সরকারি ভবন ও করপোরেট কোম্পানিগুলোতে আকস্মিক হামলা চালায়। দলটির উপর্যুপরি হামলা ও জনগণের ক্ষোভের মুখে আর্জেন্টিনার স্বেচ্ছাচারী সরকার প্রায় বাধ্য হয়েই ১০ বছর পর সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা করে। ১৯৭৩ সালের ওই নির্বাচনে বাম দল জনগণের রায়ে অগ্রাধিকার পেলে ১৮ বছর নির্বাসিত হওয়া অন্যতম নেতা পেরন দেশে ফিরে আসেন। তার আগমন উপলক্ষে প্রায় সাড়ে তিন মিলিয়ন মানুষের জমায়েতে একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। যেখানে ডানপন্থী দলগুলো পূর্ব পরিকল্পিতভাবে স্নাইপারদের মাধ্যমে ওই জমায়েতের ওপর গণগুলি চালায়। যার ফলে বেশ কয়েকজন নিহত ও অসংখ্য মানুষ আহত হয়। আগে মিলিটারি হামলা চালালেও নির্বাচনের পর থেকে তা ভয়াবহ রূপ নেয়। গুপ্তহত্যা, শুট এট-সাইটসহ নির্মম অত্যাচার নিপীড়ন নেমে আসে বাম ওই গেরিলা দলটির ওপর। এক রকম নির্বিচারে ও গণহারে হত্যা করা হয় ওই দলের সব সদস্যকে। একদিকে সরকারি হত্যা, অন্যদিকে সন্ত্রাসী তকমা দিয়ে বিভীষিকা ছড়ানো- সব দিকেই সচেষ্ট ছিল ডান দলগুলো। তার খানিকটা সফলতাস্বরূপ ১৯৭৯ সাল থেকে এই নামের গেরিলা দলটির আর অস্তিত্ব পাওয়া যায় না।

 220px-Flag_of_Montoneros.svg


‘পার্টি অব লেবার অব আলবেনিয়া’ পরিচিতি-

200px-Ppshsymbol1981

the-history-of-party-of-labor-of-albania-book-in-english

বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের কথা। গোটা বলকান দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র আলবেনিয়ায় কোনো সাম্যবাদী দলের অস্তিত্ব ছিল না। সোভিয়েত ইউনিয়নের সহযোগিতায় ১৯২৮ সালে প্রথম আলবেনিয়ায় কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে ওঠে। কিন্তু জনগণের প্রত্যাশা কিংবা দেশের কোনো ন্যায্য দাবি নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিজেদের ফলপ্রসূ আত্মপ্রকাশ ঘটাতে ব্যর্থ হয়। অবশেষে এক যুগ পর যুগোস্লাভিয়ার সহযোগিতায় এই কমিউনিস্ট দলটি পূর্ণাঙ্গ রূপ নেয় ১৯৪১ সালের ৮ নভেম্বর। ‘আলবেনিয়া কমিউনিস্ট পার্টি’ নামে পরিচিত হলেও দলটির মূল নাম ছিল ‘পার্টি অব লেবার অব আলবেনিয়া’। প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান নেতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন এনভার হোক্সা। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই দলটি গেরিলা যুদ্ধ ও রাজনৈতিক দল হিসেবে কার্যক্রম শুরু করে। মূলত দলটির মিলিটারি উইং এই গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করত। জার্মানদের হটিয়ে নিজেদের সার্বভৌমত্ব এবং স্বাধীনতা অর্জনের জন্য ‘পার্টি অব লেবার অব আলবেনিয়া’ গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে। ১৯৪৪ সাল নাগাদ দলটি বিভিন্ন গেরিলা অপারেশনের মাধ্যমে নিজেদের স্বাধীনতা অর্জনে সক্ষম হয়। আলবেনিয়ার চেয়ারপারসন হিসেবে প্রথমবারের মতো ক্ষমতা নেন পার্টি অব লেবার অব আলবেনিয়ার সেক্রেটারি এনভার হোক্সা। কমিউনিস্ট মতাদর্শে আদর্শায়িত আলবেনিয়ার বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী বিভিন্ন দেশের চক্রান্ত চলতে থাকে শুরু থেকেই। তাই পার্টি অব লেবার অব আলবেনিয়ার গেরিলা উইং-কে একেবারে বন্ধ বা বিলুপ্ত করা সম্ভব হয়নি দলটির পক্ষে। দলটির নিয়মিত পত্রিকা ‘জেরি পপুলিত‘ বেশ সমাদৃত ছিল আলবেনিয়ায়। ১৯৯১ সালেই দলটি নিজেদের বিলুপ্তি ঘোষণা করে ‘সোশ্যালিস্ট পার্টি অব আলবেনিয়া’র কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে।

জেরি পপুলিত

জেরি পপুলিত


মার্কসবাদী গেরিলা দল ZPRA পরিচিতি –

9_149491

জিম্বাবুয়ে আফ্রিকান পিপলস ইউনিয়নের আর্মড উইং জিম্বাবুয়ে পিপলস রেভ্যুলুয়েশন আর্মি। রোদশিয়ার গেরিলা এ দলটি সংক্ষেপে ZPRA/জেডপিআরএ নামে অধিক পরিচিত। মূল দলের সঙ্গে কিছুটা স্বতন্ত্রতা বজায় রেখে গেরিলা দল জিম্বাবুয়ে পিপলস রেভ্যুলুয়েশন আর্মি মার্ক্সিস্ট-লেলিনিস্ট মতাদর্শে উজ্জীবিত। অন্যদিকে মূল রাজনৈতিক দল জিম্বাবুয়ে আফ্রিকান পিপলস ইউনিয়ন মাওবাদী মতাদর্শকে পাথেয় হিসেবে মেনে নিয়েছিল। রোদেশিয়ান সরকারের নৈরাজ্য আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সরব হয়ে যাত্রা শুরু করে এ গেরিলা দলটি। নিজ দেশ এবং নিজস্ব গোত্রের অস্তিত্ব ও স্বাধীনতা রক্ষার্থে সোচ্চার হয়ে ষাটের দশকেই গেরিলা দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ZPRA/জেডপিআরএ। যাত্রার শুরু থেকেই আর্মড এ উইং গেরিলা ও মিলিটারি উভয় প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষিত হয় সুদক্ষভাবে। তবে স্থানীয় জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতায় দলটি নিজেদের গুপ্ত ঘাঁটিতে বেশ বহাল তবিয়তেই ছিল। মূল রাজনৈতিক দল ছাড়াও স্থানীয় জনগণ ও এএমসির সহযোগিতা পেয়েছিল বরাবরই। ZPRA/জেডপিআরএ রোদেশিয়ান সরকারের সঙ্গে বেশ কয়েকটি গেরিলা হামলায় লিপ্ত হয়। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গেরিলা হামলা হিসেবে ধরা হয় রোদেশিয়ান বুশ ওয়্যার যুদ্ধ। এ যুদ্ধের পর পরই গেরিলা দল ZPRA/জেডপিআরএ প্রায় বিলুপ্ত হয়ে পড়ে। আশির দশকের পর থেকে এ গেরিলা দলটির কোনো উপস্থিতি টের পাওয়া যায় না। জাতীয়তাবাদী নেতা জেসন মায়োর নেতৃত্বে গেরিলা এ দলটি প্রথম আত্মপ্রকাশ করে ১৯৬৮ সালে। দীর্ঘ ১২ বছরের স্থায়িত্বকালে গেরিলা এ দলটি সর্বাধিক সচল ছিল ১৯৭৯ সালে। এ সময়ে দলটির উল্লেখযোগ্য কমান্ডার ছিল আলফ্রেড নিকিতা ম্যাঙ্গেনা ও লুকাউট মাকুসু।

51YRXxpnZXL._SY344_BO1,204,203,200_