রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে এক মহান মানুষ গড়ার কারিগর ‘কমরেড নাদেজদা ক্রুপস্কায়া’

krupskaya11

নাদেজদা ক্রুপস্কায়া

রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে
এক মহান মানুষ গড়ার কারিগর

 

 

নাদেজদা ক্রুপস্কায়া (এন. ক্রুপস্কায়া) সোভিয়েত রাশিয়ার পিটার্সবুর্গ শহরে এক ধনাঢ্য পরিবারে ১৮৬৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন।  ক্রুপস্কায়ার মা ছোট বেলায় অনাথ আশ্রমে পড়াশুনা ও জমিদার বাড়ির চাকরানীর কাজ ক’রে জীবিকা নির্বাহ করলেও তার বাবা ছিলেন তৎকালীন জার সরকারের সেনাবাহিনীর অফিসার।  বাবা কোন ধর্মে বিশ্বাস করতেন না। এবং রাশিয়ার তৎকালীন পেটিবুর্জোয়া বামপন্থী বিপ্লবী সংগঠন নিহিলিস্ট, নারোদপন্থী, তারপর নারোদোনায়া ভলিয়ার (জনগণের স্বাধীনতা) সমর্থক ছিলেন।  যার ফলে তিনি ছিলেন তৎকালীন শাসক জার সরকারের কট্টর বিরোধী।  ১৮৬৩’র পোল্যান্ড বিদ্রোহ দমনে তাকে পাঠানো হলে তার ভূমিকা জনগণের পক্ষে যায়।  এন. ক্রুপস্কায়ার জন্মের পর পুনরায় পোল্যান্ডের জনগণের জার বিরোধী বিদ্রোহ দমনে তাকে তরুণ ও দক্ষ সেনা অফিসার হিসেবে পাঠানো হলে ক্রুপস্কায়ার বাবা বিদ্রোহ দমন তো দূরের কথা, বরং তিনি পোলিয় জনগণের বিস্ফোরিত আন্দোলনকে আরো সহযোগিতা করেন।  এই অপরাধে জার শাসক তাকে সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত করে।
ক্রুপস্কায়া শৈশবে মা’র জমিদার বাড়ির চাকরানীর কাজ করা অবস্থায় জমিদার গৃহকর্ত্রীর অত্যাচার এবং কৃষকদের উপর জমিদারের যে জুলুম চলতো তার গল্প শুনতেন।  এবং একইসাথে শুনতেন জনগণের প্রতি তার বাবার অকৃত্রিম ভালবাসা ও যুদ্ধবাজ জার সরকারের প্রতি বিদ্রোহী মনোভাব ও ঘৃণার কথা।  মা-বাবার এই শর্ত তাকে প্রগতিশীল ক’রে তোলে।  ক্রুপস্কায়া তার স্মৃতিকথায় বলেন যে, ‘আমি বড় হয়ে মার্কসবাদী দর্শন দ্রুতই গ্রহণ করতে পারার কারণ হলো আমার মা-বাবার প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি।  কমিউনিস্ট ইশতেহার গ্রহণ করতে তারাই আমাকে শর্ত যুগিয়েছেন।’
বাবা সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত হবার পর বাবার বিভিন্ন শহরে চাকুরির সুবাদে তিনি বিভিন্ন শ্রেণির জনগণের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ পান।  তিনি দেখেছেন বর্বর জার সরকারের হাতে বন্দী বিদ্রোহী পোলিয় নারী, পুরুষ, শিশুদের উপর নির্যাতন, দেখেছেন বুভুক্ষু শিশুদের কোলে নিয়ে মায়েদের আহাজারি, ক্ষিদের তাড়নায় দুই টাকায় বিক্রি হয়ে যাওয়া কিশোরীদের মুখ।  আরো দেখেছেন জমিদার শ্রেণির কৃষকদের উপর শোষণ-নির্যাতন ও জমিদারের বাইজিখানায় ঘুঙুরের শব্দের সাথে তরুণী মেয়েদের আর্তচিৎকার।  ক্রুপস্কায়া তখন এই ঘুণে ধরা সমাজ ব্যবস্থাটাকেই মনে মনে বদলে দিতে চান, কিন্তু কীভাবে দিবেন তার দিশা পান না।  বাবার মতো তিনিও প্রচুর পড়াশুনা করেন। একসময় তিনি টলস্টয়ের ভক্ত হয়ে যান।  কৃষকদের সাথে একাত্ম হতে কৃষকদের কৃষি শ্রমও করেন।  কিছুদিনের মধ্যেই তিনি বুঝতে সক্ষম হন যে, টলস্টয়ের দৈহিক শ্রম ও ‘আত্মশুদ্ধি’ জনগণের মুক্তির কোন পথ নয়।  শ্রমিক ও কৃষকদের মুক্তির জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী শ্রমিক আন্দোলন।
জার শাসিত অনুন্নত পুঁজিবাদী রুশ সমাজ ব্যবস্থায় মেয়েদের জন্য উচ্চশিক্ষা নিষিদ্ধ ছিল।  জার সরকারের আইন ছিল মেয়েদের জন্য উচ্চ শিক্ষা ও ডাক্তারী পড়া নিষিদ্ধ।  মেয়েদের কাজ হচ্ছে সন্তান লালন-পালন ও স্বামীর সেবা করা। ক্রুপস্কায়া চিরাচরিত এই প্রতিক্রিয়াশীল সামন্ততান্ত্রিক আইনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন। এই সংগ্রামে তিনি সফল হন এবং পিটার্সবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।  বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের একটি পাঠচক্রে তিনি যোগ দেন।  এই পাঠচক্র-যে মার্কসবাদী পাঠচক্র, বিশ্বকে পরিবর্তন করার বিপ্লবী পাঠচক্র তা তিনি প্রথমে বুঝতে না পারলেও যখনই তাকে মার্কস-এর ‘পুঁজি’ পড়তে দেয়া হয় তখন তার মনে পড়ে যায় বাবা মাঝে মাঝে পশ্চিমা (ইউরোপ) বিশ্বের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করতেন।  মার্কস-এঙ্গেলসের কমিউনিস্ট ইস্তেহার নিয়েও অল্প-স্বল্প বলতেন।  রাশিয়ায় মার্কসবাদী বই নিষিদ্ধ থাকায় খুবই সতর্কতার সাথে ‘পুঁজি’ বইটি তাকে পাঠ করতে হয়।  মার্কস-এর ‘পুঁজি’ প্রথম খ- পড়েই তিনি মানব মুক্তির দর্শন পেয়ে যান।  এরপর তিনি উক্ত পাঠচক্রে সক্রিয়ভাবে কাজ করতে শুরু করেন।
শ্রমিক ও কৃষকদের সাথে ছাত্রদের মেলামেশা, ঘনিষ্ঠতা আইনগতভাবে নিষিদ্ধ থাকায় খুবই গোপনে শ্রমিক-কৃষকদের মধ্যে কাজ করতেন।  ১৮৯৬ সালে সুতাকল, তাঁত শ্রমিকদের ধর্মঘট ও হরতালে তিনি নেতৃত্ব দেন।  এই ধর্মঘটে বহু নেতাকর্মীর সাথে তিনিও গ্রেফতার হন।
সাইবেরিয়ায় নির্বাসনে থাকাকালীন অবস্থায় বিশ্ববিপ্লবের মহান নেতা ভ. ই. লেনিনকে তিনি বিয়ে করেন।
তৎকালীন পশ্চাৎপদ রাশিয়ায় নারীদের উচ্চশিক্ষা ও চাকরি করা ছিল নিষিদ্ধ।  নারীদের রাজনীতি করা-তো ছিল আরো কঠিন ব্যাপার।  এই আইন ও কুসংস্কারকে ধূলিসাৎ ক’রে তিনি নারীদের শিক্ষা, চাকুরি, রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করেন।  ১৯ শতকে পশ্চাৎপদ রাশিয়ায় ক্রুপস্কায়ার রাজনীতিতে অংশগ্রহণ ছিল নারীমুক্তি প্রশ্নে এক অগ্রপদক্ষেপ।  হাতেগোনা কয়েকজন বুদ্ধিজীবী নারীর মধ্যে ক্রুপস্কায়া ছিলেন অন্যতম।
রুশ কমিউনিস্ট পার্টিতে তিনি বিভিন্ন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।  তারমধ্যে ১৯০৫ থেকে ১৯০৭ সাল পর্যন্ত তিনি কেন্দ্রীয় সংস্থায় সহকারীর দায়িত্ব পালন করেন।  ১৯১৭ সালে অক্টোবর বিপ্লবের পর তিনি রুশ কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় লোকশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত হন।  এই দায়িত্ব পালনকালে তিনি লেনিন ও স্ট্যালিনের সমাজতান্ত্রিক শিক্ষানীতি কার্যকর করেন।  এবং সারা সোভিয়েত ইউনিয়নের ইয়াং পাইওনিয়ার ও কমসোমলের (শিশু, কিশোর ও তরুণদের সমাজতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি চেতনায় গড়ে তোলার সংগঠন) নির্বাহী দায়িত্বে ছিলেন।  তিনি পুঁজিবাদী শিক্ষা ব্যবস্থার মূলোৎপাটন ক’রে তরুণ, কিশোর, শিশুদের গড়ে তুলেছেন সাম্যবাদী চেতনায় ও একেকজন দেশপ্রেমিক নায়ক হিসেবে। যে নায়করা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বীরদর্পে যুদ্ধ করেছেন।
এন. ক্রুপস্কায়া তার বিভিন্ন প্রবন্ধে, নিবন্ধে তরুণ, কিশোর, শিশুদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছেন, শিক্ষকদের পরামর্শ দিয়েছেন।  বুর্জোয়া শিক্ষানীতির পরিবর্তে ব্যাপকসংখ্যক শ্রমিক-কৃষক ও তাদের সন্তানদের শিক্ষার ক্ষেত্রে সম অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন।
একইসাথে তিনি সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচির আলোকে নারীমুক্তি প্রশ্নেও কাজ করেন। কন্যা শিশুদের শিক্ষা প্রদান নিশ্চিত করা, যুব শ্রমিক সংঘে মেয়েদের প্রতিনিধিত্ব করা। কমসোমলের সারা ইউনিয়ন অষ্টম কংগ্রেসে তিনি তার ভাষণে বলেন- কমসোমলের আশু কর্তব্যের মধ্যে একটি প্রধান কাজ হলো নারীমুক্তির জন্য কাজ করা।  শিক্ষকদের এক সভায় ভাষণদানকালে তিনি শহর-গ্রামের নিরক্ষর নারীদের উদ্দেশে ভ. ই. লেনিনের সেই বিখ্যাত বাণী উচ্চারণ করেন- ‘দেশ শাসনের যোগ্য হয়ে উঠতে হবে প্রত্যেকটি রাঁধুনীকে’।  বাস্তবেই সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়ার নারীরা দেশ শাসনের যোগ্য হয়েছিলেন।  তারা বুঝেছিলেন প্রকৃত নারীমুক্তি কাকে বলে।
১৯৩৪ সালে প্যারিসে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনের সমর্থনে তিনি বিবৃতি দেন।  যখন স্ট্যালিনের সমাজতান্ত্রিক নীতির বিরুদ্ধে সংশোধনবাদী ট্রটস্কীপন্থীরা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত সেই সময়ে তিনি দৃঢ়হাতে স্ট্যালিনীয় নীতির পক্ষে দাঁড়ান এবং নারীদের উদ্দেশেও তিনি বলেন, ‘স্ট্যালিন-গঠনতন্ত্র সাম্যবাদী গঠনতন্ত্র। এই গঠনতন্ত্রে নারীদের সম্পূর্ণ অধিকার দেয়া হয়েছে।’ বিশ্বাসঘাতক সংশোধনবাদী ট্রটস্কীপন্থীদের প্রতিরোধের জন্য সমস্ত নারীদের প্রতি তিনি আহ্বান জানান।
১৯৩৮, ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে তিনি নারী দিবসের ঘোষক ক্লারাসেৎকিনকে স্মরণ করেন এবং এক বিবৃতিতে পৃথিবীর সমস্ত প্রান্তের নিপীড়িত নারীদের, বিশেষত চীন ও স্পেনের গৃহযুদ্ধে বন্দুক কাঁধে যোদ্ধা নারীদের প্রতি আহ্বান জানান সম্মিলিত ফ্রন্ট গড়ে তোলার জন্য।
এন. ক্রুপস্কায়া শিশু-কিশোর-তরুণদের গড়ে তোলার প্রশ্নে ‘শিক্ষাদীক্ষা’ ও ‘আত্মশিক্ষা সংগঠন’ নামে অতিগুরুত্বপূর্ণ দু’টি পুস্তক রচনা করেন।  এছাড়া কমিউনিস্ট বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা-প্রাভদা, যুব কমিউনিস্ট পত্রিকা, শিক্ষকদের পত্রিকা, কমিউনিস্ট শিক্ষাদীক্ষা পত্রিকায় বিভিন্ন সময়ে প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা করেছেন।
প্রখ্যাত এই কমিউনিস্ট নেত্রী, শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা ছাড়া যে নারীমুক্তি, নারী স্বাধীনতা সম্ভব নয়- এ সত্যকে বিশ্বের নিপীড়িত নারীদের কাছে তুলে ধরেছেন।  এবং প্রতিক্রিয়াশীল সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কষ্টসাধ্য, ঝুঁকিপূর্ণ ও দায়িত্বশীল নেতৃত্বকারী ভূমিকা রেখেছেন।
বিশ্বের নিপীড়িত-নির্যাতিত ও বঞ্চিত নারীদের মহান শিক্ষক কমরেড ক্রুপস্কায়ার আদর্শকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে হবে ও তাকে বাস্তব শ্রেণি সংগ্রামে রূপদান করতে হবে। তাহলেই আমাদের দেশের নারীরাও পাবে লেনিন-স্ট্যালিনের রুশ সমাজতান্ত্রিক সমাজের মতো সত্যিকার নারীমুক্তি ও নারী স্বাধীনতা।

সূত্রঃ নারী মুক্তি/৩নং সংখ্যায় প্রকাশিত ॥ ফেব্রুয়ারি, ’০৫


পেরুর গণযুদ্ধে নারী

ক্যান্টোগ্র্যান্ড জেল অভ্যন্তরে আন্তর্জাতিক নারী দিবস

ক্যান্টোগ্র্যান্ড জেল অভ্যন্তরে আন্তর্জাতিক নারী দিবস

 

পেরুর গণযুদ্ধে নারী

গণযুদ্ধে মেয়েরা সমভূমিকা পালন করছে, সে যুদ্ধের ধারণা আপনাকে আকস্মিক অভিভূত করবে। এক যুবতী কিষাণ তার চেহারায় ফুটে উঠছে বহুদিনের ক্রোধ, যন্ত্রণা আর দারিদ্রের বিরক্তি।  বুক-আড়াআড়ি রাইফেল রাখার কায়দায় প্রকাশ পাচ্ছে ওর মনের দৃঢ়তা। সে বিশ্বাসে অটল; গর্বোন্নত তার শির।  পেরুর গণযুদ্ধে মেয়েদের ভূমিকা আপনাকে নাড়া দেবে যে কোনভাবেই- অত্যাচারী অত্যাচারিত আপনি যাই হোন না কেন।
অত্যাচারী শাসকদের জন্য এ যুদ্ধ আতঙ্কজনক। ধারণার বাহিরে এ যুদ্ধের কৌশল।
নারীদের ভূমিকা সকল সংকীর্ণতা ছাড়িয়ে গেছে।  নারীসুলভ ভীরুতার হয়েছে উৎপাটন।  ওরা এখন শোষক শ্রেণির জন্য ভয়াবহ।  বন্দুকধারী নারীরা মার্কসবাদী মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ।  ওরা এখন আকাংখা ও লক্ষ্যের চেয়েও অকল্পনীয় ও দুর্দান্তভাবে এগিয়ে যাচ্ছে।  নির্যাতিত-নিপীড়িতদের দলে রয়েছে খেটে খাওয়া মানুষ।  আর মেয়েরা পালন করছে সর্বঅগ্রণী ভূমিকা। নেপাল-ফিলিপিনস-ভারতের অন্ধ্র্র-দন্ডকারণ্য-বিহার ও আমাদের দেশের নারীরাও এ সংগ্রামের অংশীদার। ওরা আমাদের মতোই।  আমাদের রক্ত, ঘাম ও কান্নার সাথী। শুধু বেঁচে থাকার প্রশ্ন নয়, বরং ওরা নতুন বিপ্লবী দিনের উন্মোচন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
পেরুর এ মেয়েরা উজ্জ্বলতর ভবিষ্যতের আলোকবর্তিকা। যেখানে ধনী-গরীবের কোন বৈষম্য নেই। যেখানে মেয়েদের প্রতি কুকুরের মতো আচরণ করা হয় না।  আর মেয়েরা তাদের কর্মকা-ে প্রমাণ করছে ভবিষ্যত সর্বহারাদেরই নিয়ন্ত্রণে। সহযোদ্ধা হিসেবে ওরা পুরুষদের মতোই সকল ঝুঁকির মোকাবেলা করছে।  পৃথিবীর সকল প্রান্তে বিপ্লবকে এগিয়ে নিতে আন্তরিক সহযোগিতা করছে।  পেরুর কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালিত পেরুর গণযুদ্ধ নারীমুক্তির প্রশ্নে অনমনীয় ও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। নারী নির্যাতনের বিরোধিতা এ সংগ্রামের সার্বিক কর্মসূচির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ (কৌশল ও চূড়ান্ত লক্ষ্য)। এ বিপ্লব যে প্রেক্ষিতে সকলের কাছে বিখ্যাত তার মধ্যে একটি বিষয়বস্তু হলো- যুদ্ধের সূচনাকাল থেকেই মেয়েদের সক্রিয় ভূমিকা ও নেতৃত্ব যা সর্বজনজ্ঞাত ও স্বীকৃত।  বিপ্লবী নেতা মাও সেতুঙ “মেয়েরা আকাশের অর্ধেক ধরে রেখেছে,” (“Women hold up half of the sky”) এই উক্তির মাধ্যমে যে কথা বুঝাতে চেয়েছেন এগুলো হচ্ছে তারই জ্বলন্ত প্রমাণ।  কেন আজ হাজার হাজার পেরুবাসী নারী গণযুদ্ধে অংশগ্রহণ করছে? চলমান শাসন ব্যবস্থাকে ভাঙতে হবে- এ ধারণা বদ্ধমূল। সমাজ ব্যবস্থাকে নিম্নধাপ থেকে উপরিধাপ পর্যন্ত পুনর্নির্মাণের জন্য শাসন ব্যবস্থার বিবর্তন অপরিহার্য।  ওরা এমন একটি সংগ্রামে লিপ্ত যে সংগ্রামের লক্ষ হ’ল বর্তমান শ্রেণি বিভক্ত সমাজ ব্যবস্থায় সর্ব বিষয়ে, সর্বস্থানে পুরুষদের পদতলে তাদের ঘৃণিত বর্তমান অবস্থান ও কঠোর নিয়মের উচ্ছেদ করা।  করুণা নির্ভর সংস্কারে বিশ্বাসী নয়। অবদমিত জীবন কিংবা মরণ ওরা চায় না।
ওরা জানে গণযুদ্ধ শাইনিং পাথের (Shining path)* গণমুক্তি বাহিনীর সেনা কর্তৃক লাঞ্ছিতা হবে না। নারী অথবা জাতিগত কারণে তাদের যুদ্ধে যোগদানে কোন বাধা নেই।  বরং তারা বিপ্লব বিষয়ে বিজ্ঞান ভিত্তিক প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের হাতে বন্দুক তুলে দেয়।  যে সমাজ ব্যবস্থায় জন্মের পর থেকে তাদের অবস্থান ছিল ঘৃণিত সেই সমাজ ব্যবস্থায় পদাঘাত করে ওরা গড়ে উঠবে আস্থাশীল নেত্রী ও যোদ্ধা হিসাবে।
৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে যারা সকল ধরনের নিগ্রহ মুক্ত নতুন সমাজ ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখছেন, পেরুর বিপ্লবী মেয়েদের দৃষ্টান্ত থেকে তারা মনোবল অর্জন করতে পারেন।  হতে পারেন তেজোদীপ্ত। কারণ ওরা বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে চলতি সকল সংগ্রামের সাথী, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ওরা যুদ্ধ করে যাচ্ছে।  অত্যাচারমুক্ত এক উজ্জ্বলতর ভবিষ্যত ওদের স্বপ্ন।  নিম্নবর্ণিত দৃশ্যপটে ফুটে উঠেছে পেরুর বিপ্লবী ধারা, বিবৃত হয়েছে গণযুদ্ধে নারীদের শক্তিমত্তা। কেমন করে ওরা খান খান করে ছিঁড়ছে নারী নির্যাতনের সকল শেকল।

গ্রামে-গঞ্জে নারী গেরিলা যোদ্ধারা

কোন কোন “গণ গেরিলা বাহিনী” অধিকাংশই মেয়েদের নিয়ে গঠিত। যেখানে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সামরিক নির্দেশনায় মেয়েরাই প্রাধান্যে।  যে দেশে সামন্ত প্রভু ও তাদের জুলুমবাজ গু-াবাহিনী মাঝে মাঝেই কৃষাণ মেয়েদের উপর বলাৎকার করে, সেই কৃষাণ নারীদের বিপ্লবী উথানে নারী দলনকারী সামন্ত প্রথা এখন এক বজ্র কঠিন হুমকির সম্মুখীন।
পেরুর গ্রাম এলাকায় চলছে বিপ্লবীদের সম্মেলন প্রস্তুতি। সাম্যবাদী কাস্তে- হাতুড়ী খচিত লাল পতাকা আর ফেষ্টুন উচানো হাতে মেয়েরা চলছে জোর কদমে। একজন নারীর নেতৃত্বে গ্রামে ফিরছে বিপ্লবী শ্লোগানে মুখরিত জনতা- “পেরুর কমিউনিস্ট পার্টি (পিসিপি)- জিন্দাবাদ!” “পেরুর গণ গেরিলা বাহিনী জিন্দাবাদ!”
এক যুবতি কন্যা, মাথায় ওর সাহেবী টুপি, পরনে স্বচ্ছন্দ চলার মতো নীল জিন্স, সংগ্রামী সাথীদের নিয়ে বসা অবস্থায় ক্রোড়ে তার আবদ্ধ বন্দুক।  তার বলিষ্ঠ কণ্ঠে উচ্চারিত- “গণ গেরিলা বাহিনীর একজন যোদ্ধা হিসাবে আমি গর্বিত ও বিপ্লবের জন্য আমি জীবন দিতে প্রস্তুত।  আর সারা দেশব্যাপী যে ক্ষমতা আমরা অর্জন করেছি তা রক্ষা করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।”
আয়াকুচোতে* চলছে আর এক সম্মেলনের প্রস্তুতি।  এখানে গণযুদ্ধ শক্তি অর্জন করে চলেছে।  এক বিশেষ বিজয় উদ্যাপনের জন্য কৃষকরা একত্র হয়েছে।  বন্দুক সজ্জিত এক যুবতী মেয়ে জনতার ভীড় ঠেলে সামনে বেরিয়ে আসে।
তার টুপির অগ্রভাগে খচিত এক ফুল।  পিঠে বাঁধা ওর কম্বল ও খাদ্য সামগ্রী।  মুখে তার অনিশ্চয়তার অভিব্যক্তি; ক্রমান্বয়ে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে।  কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোকপাতের উদ্দেশে সে মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে বলতে থাকে-
“আজ আমরা জনগণের প্রকাশ্য গণকমিটির (Open Peoples Committee) ঘোষণা দিচ্ছি। …………………….বিদ্রোহ ন্যায়সঙ্গত! আমাদের কী আছে? কিছুই না। কী আমাদের অভাব? সবকিছুরই। ধনী সম্প্রদায় বর্জিত এক নতুন সমাজ আমাদের কাম্য।
………………আমরা মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদ রক্ষা ও প্রয়োগের মাধ্যমে উজ্জ্বল চলার পথ সৃষ্টি করবো…………।”

বীরত্বের দিনে আত্মবলিদানকারী পেরুর নারীরা

১৯৮৬-এর ১৯ জুন ছিল এক বীরত্বের ও সাহসিকতার দিন।  এই দিনে পেরুর বিপ্লবী জেল বন্দীদের এক সাহসী উত্থান সরকার চালিত বর্বরোচিত ধ্বংসযজ্ঞের সম্মুখীন হয়।  লিমার নিকটবর্তী তিনটি জেলখানায় যুদ্ধ বন্দীরা সরকারি এক গণহত্যার ষড়যন্ত্রকে বাধা দেয়ার উদ্দেশে এ অভ্যুত্থান ঘটায়।  ওরা প্রচুর পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্রসহ প্রহরী ও জেলখানাগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয় এবং দাবি জানায় সরকার যেন বন্দীদের জীবনের নিরাপত্তা চুক্তিটি ভঙ্গ না করে। গণযুদ্ধকে আরও গতিশীল করার জন্য ওরা দৃঢ় সংকল্প ঘোষণা করে।
ফ্রন্টন দ্বীপের এক জেলখানায় বন্দীরা প্রধানত দেশি অস্ত্রশস্ত্র-ক্ষেপণাস্ত্র, তীর ও অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সরকারি নৌ ও হেলিকপ্টারের ভয়ানক গোলাগুলির আক্রমণকে ২০ ঘণ্টা অবধি ঠেকিয়ে রাখে। কেল্লাওর মেয়েদের জেলখানায় ৭৫ জন বন্দীর মধ্যে ২ জনকে হত্যা ও ৬ জনকে প্রচ- প্রহার করা হয়।  পেরুর কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ও সমর্থক হওয়ার অপরাধে লুরিগাঞ্চা জেলখানায় ১৩৫ জন বন্দীর সকলকে হত্যা করা হয়। এদের মধ্যে প্রায় ১০০ জনকে সরকারি ফ্যাসিস্ট বাহিনী বন্দী করে ঠান্ডা মস্তিষ্কে হত্যা করে। ফ্রন্টনে কমপক্ষে ১১৫ জন বিপ্লবীকে হত্যা করে।
এক বছর পরে ১৯৮৭ সালের জুলাই মাসে পেরুর কমিউনিস্ট পার্টি নিম্নলিখিত বক্তব্য দিয়ে এ বীরত্বের দিনটিকে অবিস্মরণীয় করে রেখেছে, “ওরা কখনো মাথা নত করেনি।  ওরা অসীম বীরত্বের সাথে সর্বশক্তি দিয়ে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যায়।  আর তাদের জীবন-পণ যুদ্ধ পেরুর পুরনো ঘুণে ধরা সমাজকে যুদ্ধের উজ্জ্বল কেন্দ্রে পরিণত করে। সমাধির অন্তরাল থেকে ওরা বিজয় অর্জন করে চলেছে।  কারণ ওরা চঞ্চল, আমাদেরই মত নব নব বিজয়ে মণ্ডিত। ওদের সতেজ ও স্থায়ী অস্তিত্বে বিষয়টি কল্পনা করুন; ওরা জ্বলছে।  বর্তমান-ভবিষ্যত ও চিরকালের জন্য এই মহান শহীদ বিপ্লবীরা আমাদের কাছে শিক্ষার আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবে।  আমরা যেন ওদের মতই পার্টি-বিপ্লব-জনগণের জন্যই জীবন উৎসর্গ করতে পারি।”
পেরুর চলমান সংগ্রামে বন্দী বিপ্লবী মেয়েরা এক বীরত্বগাথা ভূমিকা পালন করে চলেছে।  বিপ্লবের সাথে একাত্ম এ মেয়েদের উপর শাসকগোষ্ঠী চালাচ্ছে কঠোর নির্যাতন।  একদিনই ওরা ৬০০ জন নারীকে ঘেরাও করে জেলে নিক্ষেপ করেছে ।  কিন্তু সরকার নারী যোদ্ধাদের বিপ্লবী চেতনার অবসান ঘটাতে পারেনি।  জেল বন্দী নারীরা কোন মতেই আত্মসমর্পণ করেনি।  বরং ওরা বিপ্লবী চেতনা ও সংকল্পে আরও বলিয়ান হয়েছে।  জেল অভ্যন্তরে ফ্যাসিস্টদের হিংস্র নির্যাতনকে উপেক্ষা করে ভবিষ্যত সংগ্রামের লক্ষে চালিয়ে যাচ্ছে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক তৎপরতা। কারাগার পরিণত হয়েছে বিপ্লবীদের বিশ্রামাগার এবং শিক্ষাকেন্দ্রে।
সাথী পুরুষ যোদ্ধাদের মত হাজার হাজার জেলবন্দী মেয়েরা জেলখানাগুলোকে “যুদ্ধের নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্রে” পরিণত করেছে।  শাসকদের নির্যাতনে ওরা পরাজিত-অধঃপতিত কিংবা ভেঙ্গে পড়েনি। বরং আরও হয়ে উঠেছে বিপ্লব নিবেদিতা, চালিয়ে যাচ্ছে পড়াশুনা, আঁকড়ে ধরছে সঠিক বিপ্লবী পথ।  এভাবে বন্দী নারী বিপ্লবীরা পেরু ও সারা বিশ্বের নির্যাতিত মানুষের মুক্তি সংগ্রামের সহায়তা করছে।  ভয়ঙ্কর মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এক সাম্যবাদী বিশ্ব গড়ার লক্ষ্যে ওরা সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে।

বিপ্লবী সংগ্রামে জীবন-মরণ পণ

প্রায় দেড় যুগ ধরে পেরুতে সশস্ত্র সংগ্রাম চলছে।  শুরু থেকেই এ মুক্তিযুদ্ধে বিপ্লবী যোদ্ধা ও নেতৃত্বের ক্ষেত্রে নারীদের প্রায় অর্ধ সংগঠন-শক্তি রয়েছে। যুদ্ধ ক্ষেত্রে সরকারি বাহিনী অনেক নারীকে হত্যা করেছে।  শাসকগোষ্ঠী বন্দী করেছে অনেক মেয়েকে।  অসংখ্য নারীকে বন্দীশালায় অত্যাচার-নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়েছে- গুম করা হয়েছে।  বিপ্লবী যুদ্ধে নজিরবিহীন আত্মবলিদানের জন্য আজ ওরা স্মৃতিতে ভাস্বর ও সম্মানিত।
এদের মধ্যে বীর নারী শহীদ এদিথ লাগোস অন্যতম।  ১৯৮২-এর দিকে এই মেয়েটি ছিল ১৯ বছরের নবীন গেরিলাযোদ্ধা।  সে আয়াকুচো জেলখানায় গোপন গর্ত খননের কাজে একটি ছোট গেরিলা দলের নেতৃত্ব দেয়। এই গেরিলা দল সকল বন্দী বিপ্লবীদের মুক্ত করে নিরাপদে ফিরে আসে।  এই ঘাঁটি থেকে বহু সরকারি অস্ত্রশস্ত্র দখল হয়। পরবর্তীতে এদিথ লাগোস পুলিশের হাতে ধরা পড়েন।  শাসকশ্রেণি তাদেরই সৃষ্ট আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে।
বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের জন্য এদিথ লাগোস আয়াকুচোতে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন।  তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশের জন্য শেষকৃত্যানুষ্ঠানে জনতার সমাবেশকে সরকার বেআইনী ঘোষণা করে।  তবুও ৭০,০০০ জনপদ অধ্যুষিত আয়াকুচোর ৩০,০০০ লোক এদিথের বিদায়ের শোক মিছিলে যোগদান করেন।  শুধু পেরুতেই নয়- এদিথ লাগোস বিশ্বব্যাপী বিপ্লবীদের আদর্শের প্রতীকে পরিণত হন।  ’৯২ সালে জার্মানির তরুণ বিপ্লবীরা এদিথ লগোস গ্রুপ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন।  বিভিন্ন দেশে বিপ্লবী কবিতা গানে এদিথ লাগোসের বীরত্বের কথা ছড়িয়ে পড়েছে।
আর এক মহান বিপ্লবী নারী যোদ্ধা হচ্ছেন লোরা জ্যাম্বানো পাছিলা নামে একজন স্কুল শিক্ষিকা।  যিনি মিচি নামেই সর্বাধিক পরিচিত।  ১৯৮৪ সালে তাকে বন্দী করে ১০ বছরের সাজা দেয়া হয়।  শাসকগোষ্ঠী মিচি’র বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে রাজধানী লিমা অঞ্চলে পার্টি সংগঠনে রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার জন্য। ১৯৮১ সালের মার্চে জারিকৃত তথাকথিত সন্ত্রাস বিরোধী ৪৬ ধারা অনুসারে তাকে দোষী বলে সিদ্ধান্ত নেয়।  প্রেসিডেন্ট এই অধ্যাদেশ বলে পেরুর কমিউনিস্ট পার্টি (পিসিপি)-কে বেআইনী ঘোষণা করে।  তারা সন্ত্রাস শব্দটির একটি আইনগত সংজ্ঞা প্রদান করে- যার অর্থ হ’ল, পিসিপি চালিত সশস্ত্র সংগ্রামের পক্ষে যেকোন মন্তব্যই সন্ত্রাসের আওতাধীন। লন্ডন থেকে প্রকাশিত “বিশ্ব বিজয়” (A World to win- AWTW) পত্রিকায় ১৯৮৫ সালে মিচি’র একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছিল। সে বিবৃতিতে মিচি বিশ্ববাসীকে বলেছিলেন- “যে পুরনো ঘুণে ধরা শোষণনীতি, অত্যাচারী আইন ও বিচার ব্যবস্থা কার্যকর করা হয়েছে তা এই রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার প্রতিবিপ্লবী বৈশিষ্ট্যকেই তুলে ধরেছে। এমনকি এই আইনী ব্যবস্থার অন্ধ ও অমানবিক খুঁটিনাটি দিকগুলোকেও নগ্নভাবে প্রকাশ করে দিয়েছে।  কিন্তু আইনের নামে এই কশাইখানার শাস্তি ও শোষণ নীতি বিপ্লবীদের দমন করতে পারেনি।  ওরা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে এবং বিপ্লবী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সকল কালাকানুন প্রত্যাখ্যান করেছে।
২০ জুলাই দু’জন মহিলা পুলিশ আমাকে আটক করে।  ২৩ জুলাই পর্যন্ত সিভিল গার্ডের নিয়ন্ত্রণে থাকি।  সে কয়দিন প্রতিক্রিয়াশীল চক্র আমাকে সকল ধরনের নির্যাতন চালায়।  ওরা আমার সকল মনোবল চুরমার করে দিতে চেষ্টা করে। মিথ্যা স্বীকারোক্তির জন্য আমার উপর অত্যাচার চালায়।  সবচেয়ে জঘন্য ও বিকৃত নির্যাতনের মাধ্যমে আমার বিপ্লবী নৈতিকতাকে দুর্বল করার চেষ্টা করে। সেখান থেকে আমাকে সন্ত্রাস দমনকারী পুলিশ বাহিনীর কাছে পাঠানো হয়। যেখানে ৪ আগষ্ট শনিবার পর্যন্ত আমাকে তাদের মাটির নিচে কারাকক্ষে থাকতে হয়।  আমাকে তিন ধরনের নির্যাতন সহ্য করতে হয়।
() মানসিক নির্যাতন- যাতে ছিল নিদ্রাহীন ও বিশ্রামহীন অবস্থায় একনাগাড়ে চারদিন দাঁড়িয়ে থাকা, সর্বক্ষণ প্রহরীর দৃষ্টির আওতায় আতঙ্কিত ও নির্যাতিত অবস্থায়।
() এভাবে ওদের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হলে, আমার দেহের বিভিন্ন অংশ পিটাতে আরম্ভ করে।  বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ কিডনী, ফুসফুস ও মস্তিষ্কে।
() তারপর পিঠ মুড়ে হাত বেঁধে আমাকে শিকল দিয়ে শূন্যে ঝুলিয়ে রাখা হয়।  আর আমার সর্ব অঙ্গে চলতে থাকে প্রহার।  তারপর এসিড কিংবা পায়খানার মলের মধ্যে ডুবিয়ে রাখা হয়।  কারণ ওরা আমাকে শারীরিকভাবে ধ্বংস করে দিতে চেষ্টা করে। রক্তপাত ঘটিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল চক্র বিপ্লবকে ধ্বংস করার স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু যতই রক্তপাত ঘটছে বিপ্লব ততই তীব্র হচ্ছে। ঝরে যাওয়া রক্তে বিপ্লব তলিয়ে যায় না বরং ছড়িয়ে পড়ে। এই প্রতিক্রিয়াশীল হায়েনার দল জনগণের লাশ খাওয়ার স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু সশস্ত্র সংগ্রামের লেলিহান শিখা তাদের পুড়িয়ে ছাই ভস্মে পরিণত করবে। আমাদের লক্ষ্য পৃথিবীকে পরিবর্তন করা।  নয়া বিশ্ব পুরনো দুনিয়াকে পরাজিত করবেই।”

জেল অভ্যন্তরে আন্তর্জাতিক নারী দিবস
স্থানঃ ক্যান্টোগ্র্যান্ডে
সময়ঃ মার্চ, ১৯৯২

লিমার (লিমা পেরুর রাজধানী- অনু) অন্যতম কারাগার।  কঠোরতম বেষ্টনীতে আবদ্ধ বিপ্লবী কারাবন্দী মেয়েরা এখানে সুশৃংখল ও সংগঠিত। ওরা নিজেরাই খাবার রান্না করে এবং নিজেরাই পরিবেশন করে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে, রাজনৈতিক পড়াশুনা করে, ভলিবল-বাস্কেটবল খেলে। বন্দীদের বাসগৃহের দেয়ালে দেয়ালে হাতে আঁকা মার্কস-এঙ্গেলস, লেনিন ও মাও-এর ছবি।  কারাগার অঙ্গনের প্রশস্ত দেয়াল গণযুদ্ধ ও পার্টি নেতার বিচিত্র রঙ্গে অসংখ্য চিত্রে সজ্জিত।
আন্তর্জাতিক নারী দিবসে নারী বন্দীরা একটি তেজোদীপ্ত ও বিস্তারিত কর্মসূচির পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নের জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছে।  বন্দীরা দীর্ঘ সারি বেঁধে নিজ নিজ হাতে তৈরি কালো প্যান্ট ও সবুজ খাকি শার্ট ও মাও-টুপি লাগিয়ে উন্নত শিরে কুচকাওয়াজের তালে তালে কারাগার প্রদক্ষিণ করে।  হাতে ওদের বড় বড় লাল পতাকা, আর কুচকাওয়াজের তালে তালে প্রত্যেকের হাতেই আন্দোলিত হচ্ছে লাল রূমাল। ওরা বহন করছে পার্টি-নেতার বৃহদাকার প্রতিকৃতি (ছবি)।
বাদ্যের তালে তালে বন্দীদের কণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছিল বিপ্লবী গণসঙ্গীত। কারাগারের উঁচু দেয়াল ডিঙ্গিয়ে সেই বলিষ্ঠ কণ্ঠের সঙ্গীত ধ্বনি- বিপ্লবী যোদ্ধা ও অগ্রণী জনতা, ক্ষুধা ও শোষণের বিরুদ্ধে আমাদের এ সশস্ত্র সংগ্রাম।  আমরা মানব জাতির শত্রু সাম্রাজ্যবাদকে উৎখাত করবোই, বিজয় আজ জনতার, বিজয় আজ অস্ত্রের, বিজয় আজ গণ নারী আন্দোলনের। ……………আমরা আলোকজ্জ্বল পথের অনুসারী, শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করে যাবো, নতি স্বীকার না করার প্রশ্নে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।”
ওরা ব্যঙ্গ রচনা পঠন ও নারী মুক্তি সম্পর্কে মার্কস-লেনিন-মাওয়ের উদ্ধৃতি প্রদর্শন করে হাতে তৈরি কাঠের বন্দুক উঁচিয়ে ধরে ওরা মাও সেতুঙ ও চীনে সমাজতন্ত্র বিনির্মাণের সঙ্গীত পরিবেশন করে।
কারাবন্দী মেয়েদের এক প্রতিনিধি বলেন, আমরা হলাম যুদ্ধ বন্দী।  গণ গেরিলা বাহিনীর যোদ্ধাদের মত আমরা তিনটি কাজ করি- () সরকারের বন্দী গণহত্যার নীল নক্সার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রাম; () জেল বন্দীদের অধিকার আদায়ে সংগ্রাম এবং () মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী আদর্শিক রাজনীতিতে সজ্জিত হওয়ার জন্য সংগ্রাম। আমরা সর্বদাই আত্মনির্ভরশীল হতে চেষ্টা করি যাতে জনগণের ওপর বোঝা না হয়ে পড়ি।

ক্যান্টোগ্র্যান্ডের বীর সন্তানগণ

আন্তর্জাতিক নারী দিবসের দু’মাস পর ১৯৯২ সালের মে মাসের ৬ তারিখে পেরুর খুনী সরকারি বাহিনী ক্যান্টোগ্রান্ডে জেলখানায় ৫০০ বিপ্লবী জেল বন্দীকে আক্রমণ করে।  সারা দুনিয়ার মাওবাদী কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের ঐক্যের কেন্দ্র বিপ্লবী আন্তর্জাতিকতাবাদী আন্দোলন (আর আই এম) কমিটির এক বিবৃতি থেকে এ সম্পর্কে জানা যায়।
যে দু’টি জেলখানায় মেয়ে ও ছেলে বিপ্লবীরা বসবাস করতো সরকারি বাহিনী তা অবরোধ করে রাখে।  ফলে বন্দীরা খুবই সতর্ক হয়ে পড়ে এবং গোপনে সারা বিশ্বে প্রচার করে দিতে সক্ষম হয় যে, সরকারি বাহিনী জেলখানার নিয়ন্ত্রণ পনুরুদ্ধারের জন্য বন্দী হত্যার ফন্দি আঁটছে।  আর বিপ্লবী বন্দীদের পরস্পর থেকে বিছিন্ন রাখার জন্য বিভিন্ন জেলে বদলি করার চেষ্টা করছে।
এপ্রিল মাসে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পেরুর প্রেসিডেন্ট কুখ্যাত ফুজিমোরি, সরকারের নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ নিজ হাতে গ্রহণ করে। এজন্য দেশি-বিদেশি পৃষ্টপোষকদের কাছে ফুজিমোরির নিজের ক্ষমতা প্রমাণ করা এবং তার বিরুদ্ধবাদীদের ছায়া দূর করার জন্য এমন একটা গণহত্যাযজ্ঞ প্রয়োজন ছিল।
ভারী অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত সেনাবাহিনী ও পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তাগণ ৬ মে মেয়েদের জেলখানা ঘেরাও করে।  তারা আশা করেছিল প্রথমে মেয়েদের এবং পরে ছেলেদের আটক করবে।  কিন্তু তা পারেনি। যে কারাগার ওরা তৈরি করেছিল সেই কারাগারই ওদের রুখে দাঁড়াল।  ঘন সিমেন্টের প্রলেপ দেয়া দেয়াল ও উঁচু ছাদের উপর দাঁড়িয়ে মেয়েরা বন্দুক-গোলাগুলি-বিস্ফোরণ-ধোঁয়া, টিয়ার গ্যাস, জলকামানের বৃষ্টির মধ্যেও যাদের কিঞ্চিত দেখা যাচ্ছিল- হাতের কাছে যার যা ছিল তাই
আক্রমণকারীদের ছুঁড়ে মারল। বাড়িতে তৈরি গ্যাস মুখোশ পড়ে বন্দীরা প্রতিরোধ সংগ্রাম চালিয়ে গেলেন। এতে কমপক্ষে দু’জন পুলিশ নিহত হয়।  যে দালানে পুরুষ বন্দীদের রাখা হয়েছিল মেয়েরা সে দালান দখল করে ফেললো। তারপর মেয়ে পুরুষ উভয় মিলে ৯ মে অবধি সংগ্রাম চালিয়ে পুলিশদের তাড়িয়ে দিল।  অবশেষে আধ ঘণ্টা ব্যাপী এক স্থায়ী যুদ্ধে প্রতিক্রিয়াশীল চক্র সম্ভাব্য সকল ভারী অস্ত্র কাজে লাগিয়ে বিপ্লবীদের পরাজিত করলো।
১০ মে এক কুৎসিত বিজয় উৎসব পালনের উদ্দেশে স্বয়ং খুনী ফুজিমোরিকে জেল পরিদর্শনে আনা হলো।  ঘাড়ের পিছনে হাত মোড়া ও অধঃমুখী অবস্থায় কারাবন্দীদের তার পেছনে দেখা গেলো।  বেত ও মুগুর দিয়ে ওদের প্রহার করা হলো, উন্মত্ত কুকুরগুলোকে বিপ্লবীদের দিকে লেলিয়ে দেয়া হলো।  তথাপিও দেখা গেল বন্দীরা বিপ্লবী সংগীত গেয়ে চলেছে।
ক্যান্টোগ্র্যান্ডিতে ৪০ জনেরও বেশি বন্দীকে হত্যা করা হয়; ১০০ জনেরও বেশি বন্দীকে আহত করা হয়।  যুদ্ধের পর বিপ্লবী নেতাদের অনেককে পৃথক করে ফাঁসির মঞ্চে চড়ানো হয়।

সংগ্রামী এলাকায় নতুন শক্তি ও নতুন মেয়েদের অবস্থান

পল্লী অঞ্চলের ঘাঁটি এলাকাগুলোতে গণযুদ্ধে নতুন জনশক্তি গড়ে উঠেছে।  জনগণ নতুন নতুন সংগঠন, নতুন রেজিমেন্টে সংগঠিত এবং নতুন বিপ্লবী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে।  মেয়েদের জীবনে এ কর্মসূচি প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলছে। নারী নির্যাতনের মূলভিত্তি উচ্ছেদের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, নারী নেতৃত্ব এগিয়ে যাচ্ছে, প্রতিটি বিষয়ে নারী ও পুরুষের চিন্তাধারায় পরিবর্তন আসছে।  যার মধ্যে রয়েছে সামাজিক সম্পদ ও সম্পর্কের কথা।
গণকমিটি নির্বাচিত হচ্ছে। তাদের নেতৃত্বে সংগঠিত হচ্ছে উৎপাদন ব্যবস্থা, নতুন সংস্কৃতি, বিচার ব্যবস্থা, জনগণের পারস্পরিক সম্পর্ক।  গণ প্রতিনিধিগণ এক নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা উন্নয়নের মাধ্যেমে পুরনো ঘুণে ধরা উৎপাদন ও বিনিময় সম্পর্ক উচ্ছেদ করে নতুন পদ্ধতি চালু করেছে।  অতীতে বড় বড় সামন্ত প্রভু ও মাদক ব্যবসায়ীদের খবরদারীতে উৎপাদন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত হ’ত।  এখন গণযুদ্ধের অনুকূলে যৌথ শ্রম ও আত্মনির্ভরশীলতার ভিত্তিতে নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সংঘটিত।  জমিদারদের জমি দখল করে ভূমিহীন ও গরীব চাষীদের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হচ্ছে।  জমি শুধু পরিবার প্রধান পুরুষের নামে দেয়া হয়নি, পরিবারের সকল সদস্যদের নামে বরাদ্দ করা হয়। সম্পত্তির উপর মেয়েদের সমান অধিকার ও নিয়ন্ত্রণ থাকে।  প্রত্যেক পরিবারকে ভিন্ন ভিন্ন জমি বরাদ্দ করা হলেও চাষাবাদ ব্যবস্থা/পদ্ধতি পরিবার ভিত্তিক নয়।  চাষের কাজ যৌথভাবে পরিচালিত হয়। যেখানে সার্বিক সমাজ কল্যাণে সকলকেই অংশগ্রহণ করতে হয়।  দাবি জানালে বিবাহ বিচ্ছেদের অনুমতি প্রদান করা হয়।  নারী ও সন্তানেরা স্বামী কিংবা পিতার সম্পত্তি নয়।  পিতা অথবা স্বামীর অনুমতি ছাড়াই মেয়েরা ইচ্ছা করলে গেরিলা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারে।  গণকমিটিগুলো বেশ্যাবৃত্তি, মাদকাশক্তি, স্ত্রী পিটানো বন্ধ করে দিয়েছে।  বিধবা ও বয়স্করা সমাজের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সাহায্য সহযোগিতা পেয়ে থাকে। শিক্ষা সুবিধা সকলের জন্য সহজলভ্য। সামন্ত ও পুঁজিবাদী প্রথায় জবরদস্তিমূলকভাবে কৃষকদের যে অবস্থায় বাস করতে বাধ্য হতে হতো- এসব ব্যবস্থা তার সম্পূর্ণ বিপরীত।
সংগ্রামী এলাকাগুলোতে সর্বক্ষেত্রেই অভিনব রূপান্তর কার্যক্রমের পৃষ্ঠপোষকতা চলছে।  এভাবেই গণযুদ্ধ সমগ্র জাতির রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের পথকে প্রস্তুত করে দিচ্ছে।
১৯৮২ সালে এল কাল্লাওতে এক নারী বন্দীর সাক্ষাতকারে নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা বিপ্লবী কর্মকান্ডে মেয়েদের ভূমিকার গুরুত্বকে তুলে ধরে।  লিলিয়ান টয়েছ ছিলেন লিমার রাজপথের ফেরিওয়ালা।  গণযুদ্ধে যোগদানের অপরাধে তাকে জেল বন্দী করা হয়।  তিনি বলেন, প্রথম যখন রো আমাকে পার্টিতে যোগদানের প্রস্তাব আনে, তখন আমি কিছুটা আতঙ্কিত হয়ে পড়ি।  কিন্তু পরিশেষে আমি যখন বুঝতে পারলাম, আমি শুধু পেরুর জন্য যুদ্ধ করছি না, আমি যুদ্ধ করছি সারা বিশ্বকে শৃংখল মুক্ত করার জন্য, বিশ্ববিপ্লবের জন্য। তখন আমি আতঙ্কমুক্ত হলাম। অবশেষে বুঝলাম আমার বাঁচা-মরার কিছু উদ্দেশ্য আছে।
তখন আমি বাজারের সবজির মত বেচাকেনা হতে অস্বীকার করলাম।  এমনি ধারণায় সজ্জিত হয়ে অসংখ্য মেয়ে যোদ্ধা বিপ্লবকে শক্তিশালী ও বিজয়মণ্ডিত করতে এগিয়ে আসছে।

শেষ করার আগে

মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদে সজ্জিত পেরুর নারী গেরিলারা গ্রাম ও শহর-কারাগার সর্বত্রই কাঁধে বন্দুক হাতে লাল পতাকা নিয়ে শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে।  সামন্তবাদের সৃষ্ট পুরুষতন্ত্র ও ধর্মীয় সংস্কারের পুরনো সামাজিক মূল্যবোধকে দুমড়িয়ে-মুচড়িয়ে ধ্বংস করে নতুন বিপ্লবী মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম এগিয়ে নিচ্ছে।  এ প্রক্রিয়ায় পেরুর নারী বিপ্লবীরা নয়া গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে সকল প্রকার শোষণ উচ্ছেদ করবেই।

[নোটঃ আমেরিকা থেকে প্রকাশিত বিপ্লবী পত্রিকা- রেভ্যুলিউশনারী ওয়ার্কার, লন্ডন থেকে প্রকাশিত “বিশ্ব বিজয়” (AWTW) এবং বৃটেনের টিভি চ্যানেল ফোর কর্তৃক প্রচারিত পেরুর যুদ্ধের প্রামাণ্যচিত্র সহ বিভিন্ন প্রগতিশীল পত্র-পত্রিকা অবলম্বনে লিখিত।]

সূত্রঃ  বিপ্লবী নারী মুক্তি কর্তৃক প্রকাশিত ॥ জানুয়ারি, ’৯৯


নেপালের বিপ্লবী নারী: গোরখা জেল-পলাতক বাহিনী-প্রধান ‘ভূজেল (শীলু)’

নেপালের মাওবাদী নারী যোদ্ধা

নেপালের মাওবাদী নারী যোদ্ধা

নেপালের বিপ্লবী নারী

গোরখা জেল-পলাতক বাহিনী-প্রধান
উমা ভূজেল (শীলু)

নোট: উমা ভুজেল নেপাল গণযুদ্ধের এক বীর নারী। তিনি বিপ্লবী বাহিনীর একজন গেরিলা ছিলেন।  ’৯৯ সালে তিনি গ্রেফতার হন ও জেলে বন্দী ছিলেন।  কিন্তু আরো কিছু সহবন্দীসহ তিনি এক অসম সাহসী জেল-পালানো অভিযানের নেতৃত্ব দেন এবং পুনরায় বিপ্লবী বাহিনীতে যোগ দেন।  এই সাক্ষাতকারটি অনুবাদ করা হয়েছে ‘দিশাবোধ’ নামক একটি মাসিক পত্রিকা থেকে।  পত্রিকাটি নেপালের রাজধানী কাঠমন্ডু থেকে প্রকাশিত হয়। এখানে যেসব তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে তা নেপালি ক্যালেন্ডারের।  অনুবাদের সময় নেপালি ও ইংরেজি ক্যালেন্ডার একত্রে পাওয়া যায়নি।  এ কারণে কাছাকাছি ইংরেজি তারিখ অনুমান করা হয়েছে।  যা ব্রাকেটে দেয়া আছে।

[প্রখ্যাত উমা ভূজেল ওরফে শিলু হলেন গোরখা জেলভাঙ্গা পলাতক দলের প্রধান।  ছয়জন নারী বিপ্লবীর জেল-পালানোর সাথে সাথেই উমা ভূজেলের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।  তারা গোরখা জেল থেকে এক সুড়ঙ্গপথ খনন করে পালান এবং পার্টির লোকদের সাথে যোগাযোগ করেন। বিপ্লবীদলের সদস্য হিসেবে উমার নাম পূর্ব থেকেই সুপরিচিত।  তাছাড়া তিনি ছিলেন প্লাটুন কমান্ডার কমরেড ভীমসেন পোখরেলের স্ত্রী।  কমরেড ভীমসেন সিপিএন (মাওবাদী)-র পলিট ব্যুরোর সদস্য কমরেড সুরেশ ওয়াগালের সাথে শহীদ হন।  তাদের মৃত্যুর কিছুদিনের মধ্যেই তেইশ বছর বয়স্কা উমা গ্রেফতার হন। ]

১নং প্রশ্ন: কখন ও কোথায় আপনি গ্রেফতার হলেন?
উত্তর: ১০ কার্তিক (২৫ অক্টোবর, ১৯৯৯) আরুঘাটে পুলিশ আমাকে আটক করে। সে সময় গোরখা জেলার টেন্ড্রাঙ্ক অঞ্চলের এক কৃষক বাড়িতে অবস্থান করছিলাম।
২৫ অক্টোবর আমাকে আম্বুখারানীতে এনে ২৫ জানুয়ারি, ২০০০ অবধি একাকী নির্জন অবস্থায় রাখা হয়। ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০০০ সালে আমাকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ রাখার মিথ্যে অভিযোগে জেলে পাঠানো হয়।

২নং প্রশ্ন: জেল পালানোর ধারণা কখন থেকে আপনার মধ্যে কাজ করে?
উত্তরঃ গ্রেফতার হওয়ার মুহূর্ত থেকে প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও আমি একটা উপযোগী সময়ের অপেক্ষায় ছিলাম, কিন্তু পাইনি।  ১ মার্চ, ২০০০, সহযোদ্ধা কমরেড কমলা নাহাকারমিকেও জেলে আনা হয়।  আমরা (উভয়ে) একত্রে জেল-পালানোর সংকল্প করি।  কিন্তু সহায়ক ব্যক্তি-শক্তির অভাবে তা সম্ভব হয়নি। সমা, মীনা, রীতা এসে আমাদের সাথে একত্রিত হওয়ায় আমাদের প্রত্যেকের বুদ্ধি সমন্বিত হয়ে কিছু কৌশল নির্ধারিত হয়।  ওদের সকলকে ধন্যবাদ।
একটি সুড়ঙ্গ খনন করে তিন মাসের মধ্যে জেল-পালানোর একটি পরিকল্পনা করি।

৩নং প্রশ্নঃ তিন মাসের এ পরিকল্পনাটি কেমন ছিল?
উত্তরঃ খননের কাজ আরম্ভ করার পূর্বে যথাসাধ্য আলাপ-আলোচনার দ্বারা আমরা কিছু কার্যকরী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। সিদ্ধান্তগুলো ছিল- সুড়ঙ্গ খনন আরম্ভ করার সময় নির্ধারণ, পরিকল্পিত কাজটিকে কয়েক অংশে ভাগ করা, আদর্শগত মানসিক ও দৈহিক প্রস্তুতি, শত্রুদের ব্যবহার করে তাদের কাজ-কর্মের মধ্যে জড়িয়ে পড়া ইত্যাদি ইত্যাদি।  এ সিদ্ধান্ত অনুসারে আমরা তিন মাস পরে পালানোর পরিকল্পনা করি।  ২৬ ডিসেম্বর থেকে সুড়ঙ্গ খনন শুরু করার সিদ্ধান্ত নিই; উপলক্ষ ছিল কমরেড মাওয়ের মৃত্যুবার্ষিকী।  আর তখনই পরিকল্পনা করি, গণযুদ্ধ-সূচনার বার্ষিকী উদযাপনকালে জেল থেকে পালাবো।  তেমনি মানসিক শক্তি ও উৎসাহ উদ্দীপনা সৃষ্টি ও প্রস্তুতির জন্য বিশ্বের ও নেপালের কিছু সাহসিক ও গভীর গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার ওপর পড়াশুনা ও আলোচনা করি।  শারীরিক প্রস্তুতির জন্য নিয়মিত কঠোর শরীরচর্চা করি।  খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে মনোযোগী হই।  শত্রুদের কাজে লাগানোর জন্য তাদের সাথে নমনীয় ও খাতির জমানোর কৌশল অবলম্বন করি- তাদের সন্দেহমুক্ত ও অনুগত করার জন্য পার্টির রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে আলোচনা করি।

৪নং প্রশ্নঃ জেল পালানোর বিষয়ে বাহির থেকে পার্টির কোন অনুপ্রেরণা ছিল কি?
উত্তরঃ মোটেই না; এ উদ্দীপনা ও পরিকল্পনা একান্তই আমাদের।

৫নং প্রশ্নঃ সুড়ঙ্গ খনন করে পালানোর মত জটিল কাজের প্রারম্ভে কি আপনার মৃত্যুর ভয় হয়নি?
উত্তরঃ মৃত্যুভয় পরিহার করেই আমরা পরিকল্পনা গ্রহণ করি। আমরা বাঁচি কিংবা মরি, আমরা মনে করি- এটা হবে একটা ঐতিহাসিক ঘটনা। বিফল হব, সে ভয়ে কিছু না করে কিছু করতে গিয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হওয়া কি ভাল না?

৬নং প্রশ্নঃ পরিকল্পনা গ্রহণকালে কি সফলতার বিষয়ে নিশ্চিত ছিলেন?
উত্তরঃ সম্পূর্ণ সফল হবো- এ বিবেচনায়ই আমরা পরিকল্পনা করি। আমরা সকলে মিলে রাজি হই যে, যদি আমরা ব্যর্থ হই এবং ঘটনাক্রমে আমাদের মরতেও হয় তবুও শত্রুর কাছে মাথা নত করে মরবো না; নির্ভীক মৃত্যুই আমাদের জন্য সুখের মৃত্যু, এবং তা হবে গৌরবের।

৭নং প্রশ্নঃ খনন-কাজ কি করে, কিভাবে আরম্ভ হয়?
উত্তরঃ সীমানা দেয়ালের কাছাকাছি, জেলখানার খোলা মাঠে মাও-এর মৃত্যু-দিবস পালন করে বিকেল সাড়ে তিনটায় সুড়ঙ্গ খননের কাজ আরম্ভ করি।

৮নং প্রশ্নঃ কাজের দায়িত্ব কিভাবে ভাগ করা হয়?
উত্তরঃ কাজের দায়িত্ব ভাগ ছিল- সুড়ঙ্গ খনন, পাথর ও মাটি সরানো, প্রহরী সংরক্ষণ (প্রবেশ-দ্বারে), অন্যান্য কয়েদী ও নিরাপত্তা প্রহরীদের কাজে লাগানো, বাহিরের অবস্থা বিষয়ে সতর্ক নজর দেয়া, এবং প্রয়োজনীয় যোগাযোগ রক্ষা করা।

৯নং প্রশ্নঃ সুড়ঙ্গ খননকালে যে-সব সমস্যা দেখা দেয় সে-সব সমস্যার সমাধান কিভাবে করা হয়?
উত্তরঃ দেড়ফুট লম্বা লোহার দন্ড দিয়ে প্রায় অধিকাংশ সুড়ঙ্গ খননের কাজ চলে।  আশপাশ পরিষ্কার করতে গিয়ে রডটা পাওয়া যায়।  তিন তিনটি সিমেন্টের দেয়াল ভাঙ্গতে অনেক সময় লেগে যায়।  এ ছাড়াও বহু সমস্যা দেখা দেয়।  বেশ কয়েকবার জেলের নিরাপত্তা প্রহরীরা সুড়ঙ্গের খুব কাছাকাছি চলে আসে।  তাদের মনোযোগ পরিবর্তনের জন্য আমরা নানা কৌশলের আশ্রয় নিই।  সুড়ঙ্গের কাজ এগিয়ে গেলে আমরা কাঠ ও মাটি দিয়ে তা ঢেকে দিই এবং তার ওপর কিছু শাক-সবজি, ফল, ফুলের গাছ লাগাই।  তারপর, আরও নিরাপত্তার জন্য, তার ওপর একটা ক্যারমবোর্ড স্থাপন করি। সুড়ঙ্গ খননের প্রথম থেকেই আমরা প্রতিদিন সমস্যার সম্মুখীন হই, কিন্তু আমরা ধৈর্যচ্যুত হইনি।  শান্ত স্বাভাবিক থেকে সকলে মিলে সমস্যার সমাধান করি।  পুলিশদের সাথে ভাই-বন্ধুর মতো ব্যবহার করি।  পরিস্থিতিও স্বাভাবিক হয়ে আসে।  খননের কাজ একমাস অগ্রসর না হতেই জেল প্রশাসন একটি টয়লেট নির্মাণ শুরু করে যা আমাদের ফাল্গুন মাস নাগাদ পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনাকে ব্যাহত করে।

১০নং প্রশ্নঃ জেল পালানো দিনকার ঘটনাবলীর বিষয়ে কি কিছু বিষদ বিবরণ দেবেন?
উত্তরঃ সুড়ঙ্গ খননের কাজ শেষ হলে আমরা ২০০১ সালের মার্চ মাসের ৩০ তাং রাত ১২টা থেকে ২টার মধ্যে জেল-পালানোর সিদ্ধান্ত নিই।  সেদিন সন্ধ্যার দিকে খুব চড়া আওয়াজে টিভি চালাই এবং সন্ধ্যা ৬টার দিকে জানালার একটি রড কাটতে আরম্ভ করি।  একমাত্র একটি রড কাটতেই ৯টা বেজে গেল। পৌনে একটার দিকে সেই জানালার ফাঁকে মাথা গলিয়ে আমি বাইরে চলে আসি।  তারপর একে একে অন্যান্য কমরেডগণ বেরিয়ে আসেন। এ সফলতার জন্য আমরা পরস্পর করমর্দন করি এবং দু’দলে বিভক্ত হয়ে সুড়ঙ্গে প্রবেশ করি।  সুড়ঙ্গের বাইরে এসে আবার সাফল্যের জন্য করমর্দন করি।  সুড়ঙ্গপথে হামাগুড়ি দিয়ে অগ্রসর হওয়ার সময় পুলিশ দু’বার আমাদের দিকে গুলি ছোড়ে, আর দু’বার গুলি ছোঁড়ে উন্মুক্ত আকাশের দিকে।  আমি সকলকে সতর্ক করে দিলাম, “তোমরা ঘেরাও হয়ে পড়েছো, আশা ত্যাগ কর”! ওরা ইতস্তত করছিল, ঠিক সে মুহূর্তেই আমরা সফলভাবে পালিয়ে আসি।  সেদিন এক কৃষকের বাড়িতে আশ্রয় নিই।  দু’দিন পর পার্টির সংস্পর্শে চলে যাই।  

সূত্রঃ নারী মুক্তি/২নং সংখ্যায় প্রকাশিত ॥ ফেব্রুয়ারি, ’০৪


মহান চীন বিপ্লবের নেত্রীঃ কমরেড মাদাম চিয়াং চিং

মাদাম চিয়াং চিং

 

মহান চীন বিপ্লবের নেত্রী

মাদাম চিয়াং চিং

পশ্চাৎপদ সামন্ততান্ত্রিক চীনা কৃষক নারীরা যখন শোষণ-নিপীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে পুনর্জন্মে কুকুর হয়ে জন্মগ্রহণ করতে চাইতেন সেই পশ্চাৎপদ সমাজে সানতু প্রদেশের এক শ্রমজীবী পরিবারে ১৯১৪ সালে কমরেড চিয়াং চিং জন্মগ্রহণ করেন।
শৈশব থেকে দারিদ্র্য ও অনাহারে বেড়ে ওঠা চিয়াং চিং প্রথমে ক্ষুধা নিবারণের জন্য একটি নাট্যদলে যোগদান করেন এবং পরবর্তীতে রাজধানী পিকিং চলে আসেন।  এখানেই তার জীবনের মোড় পরিবর্তন হতে শুরু করে, যখন কিনা জাপানি সাম্রাজ্যবাদীরা মাঞ্চুরিয়া দখল করে নেয়।  ১৯৩১ সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টি দ্বারা পরিচালিত বামপন্থী নাট্যদলে যোগদান করেন। এবং ১৯৩৩ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন।  কমরেড চিয়াং চিং-এর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তেমন না থাকলেও এ সময় তিনি মার্কসবাদ-লেনিনবাদের ওপর প্রচুর অধ্যয়ন করেন।  লাইব্রেরিতে চাকরিরত অবস্থায় সমাজবিজ্ঞানের উপর ব্যাপক পড়াশোনা ও গবেষণা করেন।
১৯৩৩-এর বসন্তে তাকে সাংহাইতে নিয়োগ করা হলো, যখন কিনা মাও-লাইনের প্রধান রাজনৈতিক বিরোধী ওয়াং মিং ও তার শহরকেন্দ্রিক লাইনের প্রভাবে পার্টি কাঠামো ধ্বংসপ্রায় এবং সুবিধাবাদ ছড়িয়ে পড়েছিল।  চিয়াং চিং সাংহাইতে প্রথম কাজ শুরু করেন মঞ্চ অভিনেত্রী হিসাবে।  এখানে তিনি কয়েকটি প্রগতিশীল নাটক মঞ্চস্থ করেন।  এতে দরিদ্র শ্রেণির জনগণের মাঝে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়।  একইসাথে তিনি নারী শ্রমিকদের মাঝেও কাজ করেন।  শ্রমিকদেরকে তিনি সচেতন করে তোলেন যে কীভাবে বৃটিশ ও জাপানি মালিকানাধীন কাপড়ের মিল ও সিগারেটের কারখানাগুলোতে শ্রমচুক্তির দুরবস্থা চলছে।  এখান থেকেই তিনি শত্রুর হাতে গ্রেফতার হন। আট মাস জেল খেটে তিনি জেলরক্ষীদের বোকা বানিয়ে পালিয়ে আসেন।
চিয়াং চিং যখন দেখেন যে, ২/৪টি চলচ্চিত্র বাদে সমস্ত চলচ্চিত্র পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রতিক্রিয়াশীল কেন্দ্র হলিউড দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, তখন তিনি আওয়াজ তোলেনঃ “জাতীয় বিপ্লবের জন্য জনগণের সাহিত্য”।  শিল্পকলার ক্ষেত্রে কমরেড মাও এই আওয়াজকে অনুমোদন করেন।  সাংহাই শহর জাপানিরা আক্রমণ করলে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির অষ্টম রুট বাহিনীতে তিনি যোগ দেন এবং ৩০০ মাইল পাহাড় পায়ে হেঁটে ইয়েনানে পৌঁছান।
১৯৩৮ সালের শেষের দিকে চিয়াং চিং মাও-এর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।  পরবর্তীতে তাদের একটি কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করে।
এর পরবর্তী বছরগুলোতে চিয়াং চিং চীনা পার্টিতে একাগ্রচিত্তে কাজ করেছেন এবং শত্রুর বিরুদ্ধে মাও-এর পাশে থেকে লড়াই করেছেন। ১৯৪৯ সালে চীনা পার্টি ক্ষমতায় এলে তথা সর্বহারা শ্রেণির নেতৃত্বাধীন রাষ্ট্রক্ষমতা কায়েম হলে কমরেড চিয়াং চিং সাংহাইতে ভূমি সংস্কার কর্মসূচিতে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন।  এ ক্ষেত্রেও তিনি নারীদেরকে অসম ভূমি, খারাপ ও পতিত ভূমি দেয়ার পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে ব্যাপক সংগ্রাম পরিচালনা করেন।  ১৯৫০ সালে চিয়াং চিং-এর গবেষণা ও অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল হিসাবে পশ্চাৎপদ চীনা নারীদের জন্য চীনা পার্টিতে সরকারিভাবে বিবাহ সংস্কার, স্বামী নির্বাচন, নারীদের তালাক দেয়ার অধিকার আইন গৃহীত হয়।
৬০-এর দশকের পূর্ব পর্যন্ত তিনি চীনা শিল্পকলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।  প্রতিক্রিয়াশীল শিল্পকলাতে তিনি আমূল বিপ্লবী রূপান্তর ঘটাতে সক্ষম হন।
১৯৬৬ থেকে ’৭৬ এই দশ বছর মাও-এর নেতৃত্বে পরিচালিত মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবে তিনি ছিলেন মাও-এর পাশে অন্যতম বলিষ্ঠ নেতৃত্ব।  চীনা কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যকার ঘাপটি মেরে থাকা বুর্জোয়া মতাদর্শধারীরা যদিওবা শর্তারোপ করেছিল চিয়াং চিং সরকারি কোন পদে অধিষ্ঠিত হতে পারবেন না।  কিন্তু চিয়াং চিং তার যোগ্যতা ও মাও-এর লাইনের প্রতি আনুগত্যতায় ঐ বুর্জোয়া পথগামীদের জবাব দিয়েছেন যখন তিনি ’৬৯ ও ’৭৩ সালে নবম ও দশম পার্টি কংগ্রেসে পলিটব্যুরোর সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৭৬ সালে ৯ সেপ্টেম্বর মাও সেতুঙ-এর মৃত্যুর পর মাও সেতুঙ-এর চিন্তাধারাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা ও অব্যাহতভাবে সাংস্কৃতিক বিপ্লব চালিয়ে যাওয়ার তত্ত্ব শক্ত হাতে তুলে ধরলে এক মাসের মাথায় অক্টোবরে মাও-এর আদর্শ বর্জনকারী তেং-হুয়া চক্র ক্যু-দেতা করে চীনা পার্টি ও রাষ্ট্রের সমস্ত ক্ষমতা দখল করে।  তারা চিয়াং চিংসহ সাংস্কৃতিক বিপ্লবে মাও-এর প্রধান চার সহযোগী নেতৃত্বকে মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করে বন্দী করে।  এই ভণ্ডরা ’৭৬ সালের তিয়েন-আন-মেন স্কোয়ারের দাঙ্গায় নগ্নভাবে উসকানি দিয়েছিল।  তারাই আবার এই দাঙ্গার জন্য চিয়াং চিং-কে অভিযুক্ত করে।
সংশোধনবাদী চক্র মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পতাকা বহনকারী মহান নেত্রী চিয়াং চিংকে ‘কুচক্রী’ আখ্যা দিয়ে মাও-লাইন তুলে ধরার নামে মাও-এর লাইনের প্রতি এক সর্বব্যাপী আক্রমণ চালায়। ’৮০/ ’৮১ সালব্যাপী এ প্রহসনমূলক বিচার চলে।  তেং চক্র আদালতে তার দোষ স্বীকার করতে বললে চিয়াং চিং বলেন, আদালতে আমি যদি কিছু স্বীকার করি তাহলে আমি বলবো ’৬৬ থেকে ’৭৬ এই দশ বছর সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে মরণপণ সংগ্রাম করেছি এবং তা মাও-এর নেতৃত্বেই।  আমি যা করেছি মাও তা সমর্থন করেছেন।

প্রসিকিউটর চিয়াং চিং-এর মৃত্যুদণ্ডের আবেদন করলে চিয়াং চিং দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, চেয়ারম্যান মাও একজন সেরা নারী কমরেডের মাঝে ৫টি গুণের সমাবেশ দেখতে চাইতেন-

. পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার ভয়ে কখনও ভীত হয়ো না;

. যে পদে অধিষ্ঠিত হয়েছো সেখান থেকে চ্যুত হওয়ার ভয় পেয়ো না;

. বিবাহ বিচ্ছেদকে ভয় পেয়ো না;

. কারারুদ্ধ হতে হলেও ভীত হয়ো না;

. ফাঁসীর দড়িতে ঝুলতে হলেও তা হাসিমুখে বরণ করে নিও।

মহান মাও-এর এই পাঁচটি নির্দেশের চারটি আমি ইতিমধ্যেই পালন করেছি।  পঞ্চমটি বরণ করার জন্য আমি প্রস্তুত হয়েই আছি।  তিনি তেং-হুয়া চক্রের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে বলেন- তোমাদের সাহস থাকলে তিয়েন-আন-মেন স্কোয়ারে দশ লক্ষ জনগণের সামনে আমাকে ফাঁসি দাও।
দুই বছরেরও অধিক সময় বিচার চলার পর ’৮৩ সালে চিয়াং চিং-কে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়।
’৯০ সালে তেং চক্র প্রচার দেয় যে, চিয়াং চিং আত্মহত্যা করেছেন।
তেং চক্রের এই মিথ্যা প্রচারে বিশ্বের মাওবাদী পার্টি ও সংগঠনগুলো চিয়াং চিংকে বন্দী অবস্থায় হত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় এবং সংশোধনবাদী তেং চক্রের বিরুদ্ধে ধিক্কার জানায়।
বিশ্বের মাওবাদী কমিউনিস্ট বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাসে এক মহিয়সী নেত্রীর নাম মাদাম চিয়াং চিং।

সূত্রঃ [নারী মুক্তি, ১নং সংখ্যায় প্রকাশিত ॥ ফেব্রুয়ারি, ’০৩], দেশে দেশে বিপ্লবী নারী সংকলন, বিপ্লবী নারী মুক্তি প্রকাশনা


কলম্বিয়ার মার্কসবাদী ‘ফার্ক’ এর নারী গেরিলাদের কিছু বিরল ছবি –

জুলিয়ানাকে তার প্রেমিক অ্যালেক্সিসের সঙ্গে দেখা যাচ্ছে৷ ১৬ বছর বয়সে জুলিয়ানের সৎ বাবা তাকে ধর্ষণ করলে সে পালিয়ে গিয়ে ফার্কে যোগ দেয়৷ এ মুহূর্তে ফার্কের সঙ্গে সরকারের যুদ্ধবিরতি চলছে৷ অচিরেই একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হতে পারে৷ এমন শান্তিপূর্ণ পরিবেশের কারণে ফার্ক গেরিলাদের জঙ্গলের জীবন সম্পর্কে এ সব বিরল ছবি ও বিষয় জানা গেছে৷

জুলিয়ানাকে তার প্রেমিক অ্যালেক্সিসের সঙ্গে দেখা যাচ্ছে৷ ১৬ বছর বয়সে জুলিয়ানের সৎ বাবা তাকে ধর্ষণ করলে সে পালিয়ে গিয়ে ফার্কে যোগ দেয়৷ এ মুহূর্তে ফার্কের সঙ্গে সরকারের যুদ্ধবিরতি চলছে৷ অচিরেই একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হতে পারে৷ এমন শান্তিপূর্ণ পরিবেশের কারণে ফার্ক গেরিলাদের জঙ্গলের জীবন সম্পর্কে এ সব বিরল ছবি ও বিষয় জানা গেছে৷

 

প্রায় সাত হাজার ফার্ক গেরিলাদের মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ নারী৷ গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, সরকারি সেনাদের গতিবিধি শনাক্তকরণ – এ সব কাজ করে নারী গেরিলারা৷ তবে কিউবায় চলা শান্তি আলোচনা সফল হলে পরবর্তীতে কীভাবে জীবন কাটাবে সেই পরিকল্পনা করছে গেরিলারা৷ জুলিয়ানার ইচ্ছা রাজনীতিতে ঢোকা৷

প্রায় সাত হাজার ফার্ক গেরিলাদের মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ নারী৷ গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, সরকারি সেনাদের গতিবিধি শনাক্তকরণ – এ সব কাজ করে নারী গেরিলারা৷ তবে কিউবায় চলা শান্তি আলোচনা সফল হলে পরবর্তীতে কীভাবে জীবন কাটাবে সেই পরিকল্পনা করছে গেরিলারা৷ জুলিয়ানার ইচ্ছা রাজনীতিতে ঢোকা৷

 

ফার্ক নারী গেরিলারা অন্য মেয়েদের মতোই ঠোঁটে লিপস্টিক আর নখে নেইলপলিশ দেয়৷ কিন্তু তারা নাকি বেশ কঠোর! কলোম্বিয়ার এক সরকারি সেনা ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’-কে বলেন, ফার্কের হাতে ধরা পড়লে আপনাকে এই প্রার্থনা করতে হবে যেন পুরুষ গেরিলাদের হাতে ধরা পড়েন৷ কেননা নারী গেরিলারা বেশ কঠোর আচরণ করে৷

ফার্ক নারী গেরিলারা অন্য মেয়েদের মতোই ঠোঁটে লিপস্টিক আর নখে নেইলপলিশ দেয়৷ কিন্তু তারা নাকি বেশ কঠোর! কলোম্বিয়ার এক সরকারি সেনা ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’-কে বলেন, ফার্কের হাতে ধরা পড়লে আপনাকে এই প্রার্থনা করতে হবে যেন পুরুষ গেরিলাদের হাতে ধরা পড়েন৷ কেননা নারী গেরিলারা বেশ কঠোর আচরণ করে৷

 

ইনার নাম ইরা কাস্ত্রো৷ ফার্কের মধ্যম পর্যায়ের এই কর্মী অন্য নারী গেরিলাদের কাছে মেন্টরের মতো৷ ছবিই বলে দিচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে তার একটা বেশ সখ্যতা রয়েছে৷ কিউবায় তিন বছর ধরে চলা সরকারের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় তিনি অংশ নিচ্ছেন৷

ইনার নাম ইরা কাস্ত্রো৷ ফার্কের মধ্যম পর্যায়ের এই কর্মী অন্য নারী গেরিলাদের কাছে মেন্টরের মতো৷ ছবিই বলে দিচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে তার একটা বেশ সখ্যতা রয়েছে৷ কিউবায় তিন বছর ধরে চলা সরকারের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় তিনি অংশ নিচ্ছেন৷

 

ছবিগুলো তোলা হয়েছে কলোম্বিয়ার গহীন জঙ্গলে অবস্থিত অ্যান্টিওকিয়া ক্যাম্প থেকে৷ ঐ জঙ্গলে বিষধর সাপ সহ রয়েছে প্রায় ২০ প্রজাতির উদ্ভট ধরনের ব্যাঙ৷ এখানে পরিবেশের কারণে নারী এবং পুরুষ গেরিলারা একসাথেই গোসল/স্নান করেন-

ক্যাম্পের পরিবেশ – ছবিগুলো তোলা হয়েছে কলোম্বিয়ার গহীন জঙ্গলে অবস্থিত অ্যান্টিওকিয়া ক্যাম্প থেকে৷ ঐ জঙ্গলে বিষধর সাপ সহ রয়েছে প্রায় ২০ প্রজাতির উদ্ভট ধরনের ব্যাঙ৷ এখানে নারী এবং পুরুষ গেরিলারা কোন রকম সংকোচ ছাড়াই একসাথেই গোসল/স্নান করেন। 

 

পিস্তলটি পরিষ্কারের পর বৃষ্টির পানি আর আর্দ্রতা থেকে বাঁচাতে কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে রাখছে সিন্ডি৷ ১৮ বছর বয়সে ফার্কে যোগ দেয়া সিন্ডি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হলে তার পরিবারের কাছে ফিরে যেতে চায়৷ এরপর রাজনীতিতে যোগ দিতে চায়৷ আর চায় জনগণকে শিক্ষিত করে তুলতে৷

পিস্তলটি পরিষ্কারের পর বৃষ্টির পানি আর আর্দ্রতা থেকে বাঁচাতে কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে রাখছে সিন্ডি৷ ১৮ বছর বয়সে ফার্কে যোগ দেয়া সিন্ডি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হলে তার পরিবারের কাছে ফিরে যেতে চায়৷ এরপর রাজনীতিতে যোগ দিতে চায়৷ আর চায় জনগণকে শিক্ষিত করে তুলতে৷

 

ছবিই বলে দিচ্ছে সব...৷

ছবিই বলে দিচ্ছে সব…৷ অস্ত্রের সঙ্গে বসবাস

 

একজন সন্তানসম্ভবা গেরিলা মা

একজন সন্তানসম্ভবা গেরিলা মা


ইতিহাসের অন্তরালের ক’জন নারী বিপ্লবী

Revolution

ইতিহাস রচিত হয় ক্ষমতাবানদের হাতে। আর তাই, ক্ষমতা সম্পর্কের নিরিখেই নির্মিত হয় ঐতিহাসিক বাস্তবতা। নিজ নিজ সময় আর সম্পর্ক সূত্রকে অতিক্রম করে সমাজে ন্যায় আর সমতা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নিজেদের জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করতে কুন্ঠাবোধ করেননি যারা; তাদের মধ্যে রয়েছেন নারীরাও। তবে ক্ষমতাশালীদের ইতিহাসের পুরুষতান্ত্রিক বয়ানে তারা মোটামোটি উপেক্ষিতই বলা চলে। সেসব নারীদের কেউ বিপ্লব করেছেন অস্ত্র হাতে, কেউবা আবার সঙ্গী করেছিলেন লেখনীকে। শারীরিক মৃত্যুর পাশাপাশি পুরুষতান্ত্রিকতার বলয়ে হয়তো ইতিহাস থেকে মুছে গেছে সেইসব নারী-বিপ্লবীর নাম।

r

কন্সট্যান্স মার্কিভিজ
অ্যাংলো-আইরিশ এ কাউন্টেস একাধারে ছিলেন সিন ফেইন এবং ফিয়ানা ফেইল দলের রাজনীতিবিদ, বিপ্লবী এবং সমাজকর্মী। ১৯১৬ সালে ইস্টার বিপ্লব থেকে শুরু করে আইরিশদের বিভিন্ন স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। ইস্টার বিপ্লবের সময় এক ব্রিটিশ স্নাইপারকে আহত করেন তিনি। ৭০ এর দিকে তিনিই ছিলেন একমাত্র নারী যাকে নির্জন কারাবাস দেয়া হয়েছিল। তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলেও তা কার্যকর করা হয়নি। এ নিয়েও নানা অপব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করে প্রসিকিউটিং কাউন্সিল। তাদের দাবি, নারী হওয়ার কারণে প্রাণভিক্ষা দেয়া হয়েছে তাকে। মার্কিভিজই প্রাণক্ষিা চেয়েছেন বলেও দাবি করেন তারা। তবে কোর্ট রিপোর্ট বলে অন্য কথা। তিনি আসলে বলেছিলেন, ‘আমি কামনা করছি আমাকে গুলি করার মত যোগ্যতা তোমাদেও থাকুক।’ মার্কিভিজ হলেন পৃথিবীর প্রথম নারী যিনি মন্ত্রিসভার সদস্য হয়েছিলেন। ১৯১৯ সাল থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত আইরিশ শ্রমমন্ত্রী ছিলেন মার্কিভিজ। একইসঙ্গে তিনিই প্রথম নারী যিনি ১৯১৮ সালে ব্রিটিশ হাউজ অব কমন্সে নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। অবশ্য সিন ফেইনের নীতির কারণে সে পদ প্রত্যাহার করে নেন তিনি।

j

নাদেজদা ক্রুপসকায়া
বেশিরভাগ মানুষই ক্রুপসকায়াকে ভ্লাদিমির লেনিনের স্ত্রী হিসেবেই চিনে থাকেন। কিন্তু ক্রুপসকায়া নিজেই ছিলেন একজন বলশেভিক বিপ্লবী ও রাজনীতিবিদ। বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল তাঁর। বলশেভিক বিপ্লবের পর নিজেকে শিক্ষা উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত করেন ক্রুপসকায়া। শ্রমিক এবং কৃষকদের শিক্ষা সুবিধা দেয়ার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন তিনি। সবার হাতের নাগালে গ্রন্থাগার পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করেছেন ক্রুপসকায়া। ১৯২৯ সাল থেকে শুরু করে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অর্থাৎ ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের উপ-শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন এ বিপ্লবী।

k

পেত্রা হেরেরা
মেক্সিকো বিপ্লবের সময় নানা গঞ্জনা উপেক্ষা করে পুরুষ সেনাসদস্যদের পাশাপাশি রণক্ষেত্রে যোগ দিয়েছিলেন নারী যোদ্ধারা। এমনই এক সৈনিকের নাম পেত্রা হেরেরা। তবে যুদ্ধক্ষেত্রে নারী হিসেবে যাননি তিনি। নিজের পরিচয় গোপন করে পুরুষ সেজে যোগ দিয়েছিলেন যুদ্ধে। এর জন্য নিজের নামও পাল্টাতে হয়েছিল তাকে। পেত্রা হেরেরা থেকে তিনি হয়ে উঠেছিলেন পেদ্রো হেরেরা। রণক্ষেত্রে শক্তিশালী নেতৃত্বের কারণে ব্যাপক সম্মান কুঁড়িয়েছেন তিনি। আর সময়ের সাথে সাথে নিজের সত্যিকার পরিচয় প্রকাশে সমর্থ হয়েছিলেন পেত্রা। থেমে থাকেনি তাঁর বিপ্লবী চেতনাও। ১৯১৪ সালের ৩০ শে মে আরও প্রায় ৪শ’ নারী যোদ্ধার সঙ্গে দ্বিতীয় তোরিয়ন যুদ্ধে অংশ নেন এ বিপ্লবী। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে কোন নারী যোদ্ধাকে কৃতিত্ব দিতে এবং জেনারেলের কাছে তাকে পরিচিত করাতে ইচ্ছুক ছিলেন না দলের নেতা পানচো ভিলা। আর তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে ভিলার বাহিনী ছেড়ে সকল নারী ব্রিগেডদের নিয়ে নিজস্ব একটি বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন পেত্রা।

k

নোয়ানইরুয়া
নাইজেরিয়ার ইগবো গোত্রে জন্ম নেয়া এ নারী ছোটখাটো যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে। পশ্চিম আফ্রিকায় ঔপনিবেশিক সময়ে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে বিশাল চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছিলেন নোয়ানইরুয়া। ঘটনার সূত্রপাত, ১৯২৯ সালের ১৮ই নভেম্বর। মার্ক ইমেরিউয়া নামে এক জরিপকারী যখন নোয়ানইরুয়াকে ছাগল, ভেড়াসহ পরিবারের সদস্য সংখ্যার হিসেব দিতে বললেন তখনই ক্ষোভে ফেটে পড়েন এ বিপ্লবী। সেসময় নারীদের উপর কর আরোপের নিয়ম না থাকলেও নোয়ানইরুয়া বুঝতে পারলেন, তাদের উপর অন্যায়ভাবে কর আরোপের পাঁয়তারা চলছে। আর তখনই শুরু। গোত্রের অন্যান্য নারীদের সঙ্গে নিয়ে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ডাক দেন নোয়ানইরুয়া। দুই মাস ধরে স্থায়ী থাকা এ বিক্ষোভে যোগ দেন অঞ্চলের প্রায় ২৫ হাজার নারী। একইসঙ্গে কর আরোপ আর ওয়ারেন্ট প্রধানদের ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে তাদের কন্ঠ। শেষ পর্যন্ত নোয়ানইরুয়াদের চাপের মুখে নতি স্বীকার করে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ। কর আরোপের পরিকল্পনা প্রত্যাহারসহ অনেক ওয়ারেন্ট প্রধান তখন পদত্যাগে বাধ্য হন।

f

লক্ষ্মী সেহগাল
ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের এক বিপ্লবীর নাম লক্ষ্মী সেহগাল। ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির এ কর্মকর্তা। ৪০ এর দশকে ঝাঁসি রাণি রেজিমেন্টকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন লক্ষ্মী। মূলত ভারতীয় উপনিবেশে ব্রিটিশ রাজত্ব ঠেকাতেই গড়ে তোলা হয়েছিল এ রেজিমেন্ট। ১৮৫৭ সালে ভারতীয় বিপ্লবে নেতৃত্বদানকারী নারী বিপ্লবী লক্ষ্মী বাইয়ের নামে রেজিমেন্টটির নামকরণ করা হয়েছিল যা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার হাতে গোণা নারী রেজিমেন্টগুলোর একটি। পরবর্তীতে আজাদ হিন্দ সরকারের নারী বিষয়ক মন্ত্রী হয়েছিলেন লক্ষ্মী সেহগাল।

o

সোফি স্কল
জার্মান বিপ্লবী সোফি স্কল ছিলেন নাৎসীবিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলনের সংগঠন হোয়াইট রোজের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ক্রমাগত লিফলেট আর গ্রাফিতি ক্যাম্পেইনের মধ্য দিয়ে হিটলারের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল সংগঠনটি। ১৯৪৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে, মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে লিফলেট বিতরণ করতে গিয়ে গ্রেফতারের শিকার হয়েছিলেন সোফিসহ আরও বেশ ক’জন। একই বছরের শেষ নাগাদ অনেকগুলো লিফলেট ‘মিউনিখের শিক্ষার্থীদের মেনিফেস্টো’ এমন শিরোনামে জার্মানির বাইরে চলে যায়। পরে মিত্র বাহিনী বিমান থেকে লাখ লাখ লিফলেট জার্মানিতে ছুঁড়ে ফেলে ।

e

সেলিয়া স্যানশেজ
কিউবার বিপ্লবী নেতা বলতেই সবাই এক বাক্যে চে গুয়েভারা কিংবা ফিদেল কাস্ত্রোর কথা বললেও সেলিয়া স্যানশেজের নাম শুনেছেন এমন মানুষ বোধহয় কমই আছেন। কিউবার বিপ্লবের প্রাণ ছিলেন এ নারী। এমনকি তিনি এ বিপ্লবের মূল সিদ্ধান্ত গঠনকারী ছিলেন বলেও শোনা যায়। ১৯৫২ সালের ১০ই মার্চ অভ্যুত্থানের পর বাতিস্তা সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যোগ দেন সেলিয়া। ‘২৬ শে জুলাই মুভমেন্টের’ প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি। বিপ্লবের পুরো ভাগজুড়ে কমব্যাট স্কোয়াডের নেতৃত্ব দেন তিনি। ১৯৫৬ সালের নভেম্বরে বাতিস্তা সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ৮২ জন যোদ্ধা নিয়ে মেক্ষিকো থেকে কিউবায় আসা রণতরীটি ‘গ্র্যানমা’-কে নিরাপদে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেছিলেন সেলিয়া। বিপ্লবের পর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কাস্ত্রোর সঙ্গেই ছিলেন তিনি।

t

আসমা মাহফুজ
আধুনিক সময়কার বিপ্লবী নারী আসমা মাহফুজ। ২০১১ সালের জানুয়ারিতে একটি ভিডিও ব্লগ পোস্টের মধ্য দিয়ে মিশরের তাহরীর স্কয়ারে সরকারের বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলনে যোগ দিতে সবাইকে উৎসাহিত করেন তিনি। আর তাতে সাড়া দিয়ে সে বিক্ষোভে যোগ দিয়েছিলেন লাখ লাখ মিশরীয় নাগরিক। তাকে মিশর বিপ্লবের এক পরাক্রমশালী সৈন্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।

 

সূত্রঃ http://www.priyo.com/2015/04/12/1426856-%E0%A6%85%E0%A6%9A%E0%A7%87%E0%A6%A8%E0%A6%BE-%E0%A6%95%E2%80%99%E0%A6%9C%E0%A6%A8-%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%80-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B2%E0%A6%AC%E0%A7%80%E0%A6%B0-%E0%A6%95%E0%A6%A5%E0%A6%BE