মেয়েদের রাজনৈতিক শিক্ষা

29C1CD9A00000578-3130307-image-m-5_1434660552551

মস্কো শহরে আমদের পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি কর্তৃক নিখিল রাশিয়া শ্রমিক নারী ও কিষাণদের কংগ্রেস আহ্বানের পর পাঁচ বছর কেটে গিয়েছে। দশ লক্ষ গতর খাটানো মেয়েদের এক হাজারেরও অধিক প্রতিনিধি এই কংগ্রেসে সমবেত হয়েছিল। মেহনতকারী মেয়েদের মধ্যে আমাদের পার্টির কর্ম তৎপরতায় এই কংগ্রেস নতুন যুগের সূচনা করে। আমাদের রিপাবলিকের শ্রমিক নারী ও কিষাণ মেয়েদের রাজনৈতিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি স্থাপন করে কংগ্রেস অপরিমেয় কৃতিত্বের পরিচয় দেয়। অনেকে মনে করতে পারেন, এ আর কি ব্যাপার? কারণ পার্টি নারীসহ জনসাধারণের মধ্যে সবসময়েই রাজনৈতিক শিক্ষা বিস্তার করে এসেছে। আবার অনেকে এমনও ভাবতে পারেন, মেয়েদের রাজনৈতিক শিক্ষার এমন কি গুরুত্ব থাকতে পারে; কারণ শীঘ্রই আমাদের মধ্যে শ্রমিক ও কিষাণদের সমবেত কর্মীদলসমূহ গড়ে উঠবে। এই ধরনের মতগুলি সম্পূর্ণরূপে ভ্রান্ত।

শ্রমিক ও কিষাণদের হাতে শাসন ক্ষমতা চলে আবার পর মেহনতকারী মেয়েদের রাজনৈতিক শিক্ষার সবচেয়ে জরুরি প্রয়োজন উপস্থিত হয়েছে। আমি এর কারণটা দেখাতে চেষ্টা করছি। আমাদের দেশের লোকসংখ্যা প্রায় ১৪ কোটি; তন্মধ্যে কমপক্ষে অর্ধেকই নারী। নারীদের মধ্যে অধিকাংশই অনগ্রসর, পদদলিত ও অতি অল্প রাজনৈতিক চেতনা যুক্ত শ্রমিক ও কিষাণ নারী।

আমাদের দেশ যদি রীতিমতো উৎসাহ দিয়ে নতুন সোভিয়েট জীবন গড়ে তোলার কাজ আরম্ভ করে থাকে, তাহলে নিশ্চয়ই ইহা সুস্পষ্ট হবে যে, মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নিয়ে গঠিত এই দেশের নারীসমাজ যদি ভবিষ্যতেও অনগ্রসর, পদদলিত ও রাজনীতির দিক থেকে অজ্ঞ থেকে যায় তাহলে তারা প্রগতিমূলক যে কোন কাজকে ব্যাহত করবে না কি?

নারী শ্রমিকরা পুরুষ শ্রমিকের সঙ্গে একযোগে কাজ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। আমাদের শিল্প সংগঠনের সার্বজনীন কাজে পুরুষদের সঙ্গে একযোগেই তারা কাজ করছে। তাদের যদি রাজনৈতিক চেতনা থাকে ও তারা রাজনৈতিক শিক্ষা পায়, তাহলে তারা এই সার্বজনীন কাজে বেশ সাহায্য করতে পারে। কিন্তু যদি তারা পদদলিত ও অনগ্রসর থেকে যায়, তাহলে নিজেদের দুষ্টবুদ্ধিবশত নয়, যেহেতু তারা অনগ্রসর সেইজন্য, এই সর্বসাধারণের কাজ পণ্ড করে ফেলতে পারে।

কিষাণ মেয়েরাও দাঁড়িয়ে রয়েছে পুরুষ কৃষকদের সঙ্গে একযোগে কাজ করার জন্য। পুরুষদের সঙ্গেই তারা আমাদের কৃষির উন্নতি, সাফল্য ও সমৃদ্ধি সাধন করছে। তারা যদি অনগ্রসরতা ও অজ্ঞতা থেকে মুক্ত হয়, তাহলে তারা এক্ষেত্রে প্রভূত কাজ করতে পারে। কিন্তু এর বিপরীত অবস্থাও ঘটতে পারে। ভবিষ্যতেও যদি তারা অশিক্ষার গোলাম থেকে যায় তাহলে তারা কাজের বাধাস্বরূপ হয়ে পড়তে পারে।

পুরুষ শ্রমিক ও কিষাণ পুরুষদের মত নারী শ্রমিক ও কিষাণ নারীরা সমান অধিকারপ্রাপ্ত স্বাধীন নাগরিক। মেয়েরা আমাদের সোভিয়েট ও সমবায় প্রতিষ্ঠানসমূহ নির্বাচন করে এবং এইগুলোয় নিজেরা নির্বাচিত হতে পারে। নারী শ্রমিক ও কিষাণ মেয়েরা যদি রাজনৈতিক জ্ঞানযুক্ত হয় তাহলে তারা আমাদের সোভিয়েট ও সমবায় প্রতিষ্ঠানসমূহে সংস্কার সাধন এবং ঐগুলোর শক্তি ও আয়তন বাড়াতে পারে। কিন্তু তারা যদি অনগ্রসর ও অজ্ঞ থেকে যায় তাহলে এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করে, পণ্ড করে ফেলতে পারে।

চরম কথা হচ্ছে এই যে, শ্রমিক নারী ও কিষাণ নারীরা আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ তরুণদের জননী আর তাদেরকে মানুষ করার দায়িত্বও তাদের ওপর ন্যস্ত রয়েছে। তারা হতাশার মনোবৃত্তি জুগিয়ে শিশুদের খর্বতা সাধনও করতে পারে, আবার তাদের মনকে সতেজ ও স্বাস্থ্যসম্পন্ন করে তাদের দ্বারা আমাদের দেশের অগ্রগতির ব্যবস্থাও করতে পারে। সোভিয়েত ব্যবস্থা সম্বন্ধে আমাদের নারী ও জননীদের সহানুভূতি আছে, না তারা পুরোহিত, ধনী চাষি ও বুর্জোয়াদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলেছে, এই সমস্ত তারই ওপর নির্ভর করছে।

সেইজন্য শ্রমিক ও কিষাণরা যখন নতুন জীবন গড়ে তোলার দয়িত্ব গ্রহণ করেছে, সেই সময় আজ বুর্জোয়াদের ওপর প্রকৃত জয়লাভ সম্পর্কে শ্রমিক নারী ও কিষাণ মেয়েদের রাজনৈতিক শিক্ষা সর্বপ্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্যে পরিণত হয়েছে। সেইজন্য মেহনতকারী মেয়েদের রাজনৈতিক শিক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠিত শ্রমিক ও কিষাণ নারীদের প্রথম কংগ্রেসের মূল্য ও গুরুত্ব সত্য সত্যই অপরিমেয়।

পাঁচ বছর আগে এই কংগ্রেস নতুন সোভিয়েত জীবন গড়ে তোলা সম্পর্কে লক্ষ লক্ষ মেহনতকারী মেয়েদের টেনে আনা পার্টির চলতি কর্তব্যরূপে গণ্য হয়েছিল। এই কর্তব্যের পুরোভাগে দাঁড়িয়েছিল কারখানা অঞ্চলসমূহ থেকে আগত শ্রমিক মেয়েরা; কারণ মেহনতকারী মেয়েদের মধ্যে তারাই ছিল সবচেয়ে জীবন্তু চেতনাযুক্ত। গত পাঁচ বছরের মধ্যে এ সম্বন্ধে যে অনেক কিছু করা হয়েছে তা বেশ বলা যেতে পারে, যদিও করণীয় অনেক কিছুই এখনও পড়ে আছে।

আজ পার্টির আশু করণীয় কর্তব্য হচ্ছে আমাদের সোভিয়েত জীবন গড়ে তোলার কাজে নিযুত কিষাণ মেয়েদের টেনে আনা। 
পাঁচ বছরের কাজের ফলে কিষাণদের ভেতর থেকে বহুসংখ্যক অগ্রগামী কর্মী গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে।

আশা করি নতুন নতুন রাজনৈতিক চেতনাযুক্ত কিষাণ মেয়েরা এসে অগ্রগামিনী কিষাণ নারীদের সংখ্যা বাড়িয়ে তুলবে। আশা করি, আমাদের পার্টি এই সমস্যারও সমাধান করতে পারবে।

– স্ট্যালিন, প্রথম শ্রমিক ও কিষাণ নারী কংগ্রেসের পঞ্চবার্ষিকী উপলক্ষে প্রদত্ত বক্তৃতা, ১৯২৩।


কমরেড মাও এর কাছে কমরেড স্ট্যালিনের টেলিগ্রাম(ইংরেজি থেকে অনুবাদ)

Staline espionne Mao Zedong, histoire du soir

১০ জানুয়ারি ১৯৪৯।

কমরেড মাও জেদং,

৯ জানুয়ারি আমরা নানজিং সরকারের একটা চিঠি পেয়েছি। চিঠিতে নানজিং সরকার ও চিনা কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যকার যুদ্ধবিরতি ও শান্তি প্রক্রিয়া নিয়ে সিদ্ধান্তে পৌছার ক্ষেত্রে মধ্যস্ততা করার জন্য সোভিয়েত সরকারকে অনুরোধ করা হয়েছে।একই সময়ে, একই প্রস্তাব দেয়া হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্স সরকারের কাছে। তাদের কাছ থেকে নানজিং সরকার এখনো কোন প্রতিউত্তর পায়নি। সবদিক বিবেচনায় এটাই নিশ্চিত , এই প্রস্তাব মার্কিনীদের নির্দেশেই করা হয়েছে। উদ্দেশ্য, নানজিং সরকারকে যুদ্ধ বন্ধ ও শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবক রুপে প্রতিষ্ঠা করা, চিনা কমিউনিস্ট পার্টিকে যুদ্ধবাজ হিসেবে পরিচিত করা যদি তারা সরাসরি নানজিদের সাথে শান্তি আলোচনা প্রত্যাখ্যান করে। আমরা এভাবেই তাদের প্রস্তাবের জবাব দেয়ার কথা বিবেচনা করছি : সোভিয়েত সরকার চিনে যুদ্ধ বন্ধ ও শান্তি প্রতিষ্ঠার পক্ষে তার অবস্থান চলমান রাখবে। কিন্তু মধ্যস্থতা করার পুর্বে তাকে অবশ্যই অন্যপক্ষ, চিনা কমিউনিস্ট পার্টির মতামত জানতে হবে, তারা সোভিয়েত সরকারের মধ্যস্থতা মেনে নিতে রাজি আছে কিনা। এ লক্ষ্যে সোভিয়েত সরকার চায়, নানজিং সরকার শান্তি প্রক্রিয়া নিয়ে চিনা কমিউনিস্ট পার্টিকে অবগত করুক এবং সোভিয়েত সরকারের মধ্যস্থতা নিয়ে তাদের মতামত নিক। আমরা এভাবেই জবাব দেয়ার চিন্তা করছি এবং আপনাদের প্রতি অনুরোধ এতে আপনাদের মত/ ভিন্নমত যাই হোক, জানাবেন।

একইভাবে আমাদের মনে হয়, আপনাদের সম্ভাব্য জবাব( যদি আপনাদের জিজ্ঞেস করা হয়), মোটামুটি এরকমই হতে পারে:

কমিউনিস্ট পার্টি সবসময় চীনে শান্তির পক্ষে কেননা চীনের এই গৃহযুদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টি শুরু করেনি, শুরু করেছে নানজিং সরকার। যুদ্ধের সামগ্রিক ফলাফলের জন্য তারাই দায়ী । চীনা কমিউনিস্ট পার্টি কুউমিনতাং এর সাথে আলোচনা করতে প্রস্তুত কিন্তু সে সব যুদ্ধাপরাধী ব্যতীত যারা চীনে গৃহযুদ্ধ উসকে দিয়েছে। চীনা কমিউনিস্ট পার্টি কুউমিনতাং এর সাথে কোন প্রকার মধ্যস্থতাকারী ছাড়াই কথা বলতে প্রস্তুত। যেসব বিদেশী তাদের আকাশ শক্তি ও নৌ শক্তি নিয়ে ‘চাইনিজ পিপলস লিবারেশন আর্মির’ বিরুদ্ধে চীনের গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে তারা কখনওই যুদ্ধ বন্ধে মধ্যস্থতাককারী হিসেবে নিরপেক্ষ ও নৈবর্ত্তিক হবেনা। আমরা মনে করি, আপনাদের জবাব মোটামুটিভাবে এমনটিই হওয়া উচিৎ।

যদি এতে আপনারা রাজী না হন, আপনাদের মতামত অবশ্যই জানাবেন।

আমরা আপনার মস্কো সফর নিয়ে ভাবছি। আমাদের মনে হয় বর্ত্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে আপনার বিদেশ সফর বাদ দেয়া উচিৎ। এমন পরিস্থিতিতে, আপনার মস্কো সফরকে শত্রুপক্ষ চীনা কমিউনিস্ট পার্টির অযোগ্যতা, মস্কোর উপর আস্থাবান ও নির্ভরশীল হিসেবে প্রচার চালাতে পারে। এটা নিশ্চিতভাবে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি ও সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য সুবিধাজনক হবেনা।

আপনার উত্তরের অপেক্ষায়,
ফিল্লিপভ।

 

অনুবাদঃ সাইফুদ্দিন সোহেল

মুল সুত্র:http://www.revolutionarydemocracy.org/rdv3n2/maostal.htm


১৯তম পার্টি(CPSU) কংগ্রেসে দেয়া কমরেড স্তালিনের সর্বশেষ প্রকাশ্য বক্তৃতা

১৯৫২ সালের ১৪ই অক্টোবর কমিউনিস্ট পার্টি অব সোভিয়েত ইউনিয়নের(CPSU)  ১৯তম পার্টি কংগ্রেসে দেয়া কমরেড স্তালিনের সর্বশেষ প্রকাশ্য বক্তৃতা –

Comrades!

Permit me, in the name of our Party Congress, to express our thanks to all fraternal parties and organizations whose representatives have honoured our Party Congress by their presence, or who have sent our Party Congress greetings of friendship, for their wishes for our further success and for their confidence. (Stormy, prolonged applause that became an ovation.)

For us, this trust is especially valuable as it signifies their readiness to support our Party in its struggle for a better future for the people, in its struggle against war, in its struggle to keep peace. (Stormy, prolonged applause.)

It would be a mistake to believe that our Party, which has become a mighty power, does not need more support. That would be wrong. Our Party and our country need the continuous trust, sympathy and support of fraternal peoples outside our borders, and will always need it.

The special quality of this support lies in that every support of the peace endeavours of our Party by each fraternal party, simultaneously signifies the support of their own people in their struggle to keep peace. As the English workers in the years 1918-1919, during the armed attack of the English bourgeoisie on the Soviet Union, organized their struggle against the war under the slogan “Hands off Russia!”, was a support, it was above all a support of the struggle of their own people for peace, and then, also, a support of the Soviet Union. If Comrade Thorez or Comrade Togliatti declare that their people do not want to be led into a war against the people of the Soviet Union, (stormy applause), – then that is a support, above all a support for the French and Italian workers and peasants who struggle for peace, and then, also, a support of the peace endeavours of the Soviet Union. The special quality of the present support is thus explained, that the interests of our Party are not only not against the interests of the peace-loving people, but on the contrary, blend with them. (Stormy applause.) Where the Soviet Union is concerned, its interest in the matter of world peace cannot be separated from the cause of peace in the whole world.

It is understood that our Party must do its duty by its fraternal parties and support them and their peoples in the struggle for liberation and in their struggle for keeping peace. This is what the Party does. (Stormy applause.) After the seizure of power by our Party in 1917, and after our Party took real measures to eliminate the yoke of capitalists and landlords, the representatives of the’ fraternal parties, inspired by our daring and the success of our Party, gave it the name “Shock Brigade” of the revolutionary movement and the workers’ movement of the world. Thereby they expressed the hope that the success of the “Shock Brigade” would alleviate the sufferings of the people in the situation of being under the capitalist yoke. I think that our Party has fulfilled these hopes, especially in the time of the second world war, as the Soviet Union smashed the German and Japanese fascist tyranny and liberated the European and Asian peoples from the danger of fascist slavery. (Stormy applause.)

Of course it was very difficult to fulfil this honourable task as long as there was only one “Shock Brigade,” as long as it stood alone, the avant-garde in the fulfillment of this task. But that is in the past. Now it is completely different. Now, from China and Korea to Czechoslovakia and Hungary, new “Shock Brigades” have appeared on the map, in the form of people’s democracies; now the struggle has been eased for our Party and also the work proceeds better. (Stormy, prolonged applause.)

Special attention must be paid to the communist, democratic or worker and peasant parties that are not yet in power and which must carry out their work under the yoke of strict, bourgeois rule. Of course their work is more difficult. But their work is not so difficult as it was for us Russian Communists in the time of the Tsar, as the smallest step forward was declared a serious crime. The Russian Communists nevertheless held firm, did not retreat from difficulties and came to victory. The same will be the case with these parties.

Why is it that these parties do not have such difficult work as the Russian Communists had in the times of Tsarism?

Because, first of all, they have the example of the struggle and success, as in the Soviet Union and in the people’s democratic countries, before them. Consequently, they can learn from the mistakes and successes of these countries and thus ease their work.

Because, secondly, the bourgeoisie itself, the arch-enemy of the freedom movement, has become different, has essentially changed, has become more reactionary, has lost the cooperation of the people and thus has been weakened. It is understood that these circumstances must likewise ease the work of the revolutionary and democratic parties. (Stormy applause.)

Earlier, the bourgeoisie presented themselves as liberal, they were for bourgeois democratic freedom and in that way gained popularity with the people. Now there is not one remaining trace of liberalism. There is no such thing as “freedom of personality” any more, – personal rights are now only acknowledged by them, the owners of capital, – all the other citizens are regarded as raw materials, that are only for exploitation. The principle of equal rights for people and nations is trodden in the dust and it is replaced by the principle of Full rights for the exploiting minority and the lack of rights of the exploited majority of the citizens. The banner of bourgeois democratic freedom has been flung overboard. I think that you, the representatives of communist and democratic parties must pick up this banner and carry it forward if you want to gain the majority of the people. There is nobody else to raise it. (Stormy applause.)

Earlier, the bourgeoisie, as the heads of nations, were for the rights and independence of nations and put that “above all.” Now there is no trace left of this “national principle.” Now the bourgeoisie sell the rights and independence of their nations for dollars. The banner of national independence and national sovereignty has been thrown overboard. Without doubt, you, the representatives of the communist and democratic parties must raise this banner and carry it forward if you want to be patriots of your countries, if you want to be the leading powers of the nations. There is nobody else to raise it. (Stormy applause.)

That is how matters stand at present.

It is understood that all these circumstances must ease the work of the communist and democratic parties that are not yet in power.

Consequently, there is every ground for the success and victory of the fraternal parties in the lands of capitalist rule. (Stormy applause.)

Long live our fraternal parties! (Prolonged applause.)

Long life and health to the leaders of the fraternal parties! (Prolonged applause.)

Long live the peace between the peoples!

(Prolonged applause.)

Down with the arsonists of war! (Everyone stood up. Stormy, prolonged applause that became an ovation. There were shouts of “Long live Comrade Stalin!” “Long live the great leader of the working people of the world, Comrade Stalin!” “The, great Stalin!” “Long live peace between the peoples!”)

(Speech at the 19th Party Congress of the C.P.S.U., Dietz Press, Berlin 1952, Pp. 5 – 15)


কমরেড স্তালিনের শেষকৃত্যানুষ্ঠান


অনন্য বিপ্লবী রাষ্ট্রনায়ক কমরেড স্তালিন

stalin_5001

আজ ১৮ই ডিসেম্বর, কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান কমরেড জে ভি স্তালিনের জন্মদিবস। দুনিয়ার সর্বত্র এই দিনটিতে মেহনতী জনগণ কমরেড স্তালিনের মহান অবদানগুলোকে স্মরণ করে শ্রেণী সংগ্রামকে তীব্র করে তোলবার শপথ নিচ্ছেন। এই অবসরে কমরেড স্তালিনের জীবন ও শিক্ষাকে আরও একবার অনুশীলনের মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে ক্রমশ জয়ের লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে যে‍‌তে হবে।

রুশ বিপ্লবের অন্যতম প্রধান রূপকার কমরেড লেনিন বলেছেন : কোন ব্যক্তি, বিষয়, আন্দোলন অথবা কর্মকাণ্ডের মূল্যায়ন পর্যালোচনা করতে হলে তৎকালীন বাস্তব পরিস্থিতি, আন্তর্জাতিক ও জাতীয় অবস্থা, শ্রমিকশ্রেণীর অবস্থান, শোষকশ্রেণী ও শোষিত শ্রেণীগুলোর পারস্পরিক শক্তির অবস্থা এবং সর্বহারা শ্রেণীর চরম লক্ষ্য ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা বিষয়ের তৎকালীন আশু কর্মসূচীর বিশ্লেষণ করতে হবে। এই ধরনের বিচারেই সঠিক মার্কসবাদী মূল্যায়ন বা পর্যালোচনা বেরিয়ে আসে। ইতিবাচক ও নেতিবাচক কতগুলি ঘটনার যোগ ও বিয়োগ ফলের দ্বারা তা হয় না। মার্কসবাদী দৃষ্টিতে একটা সামগ্রিক, সার্বিক ও অখণ্ড চিন্তা বেরিয়ে আসবে, নতুবা খণ্ডিত বা আংশিক বিচার হয়ে যায়।

কমরেড লেনিনের এই শিক্ষার আলোতেই তাঁর সুযোগ্য সহকারী কমরেড স্তালিনের বিপ্লবী জীবনের শিক্ষাগুলোকে আয়ত্ত করতে হবে। এবং শ্রেণী আন্দোলন ও গণ-আন্দোলন বিকাশের ক্ষেত্রে তার সঠিক প্রয়োগ ঘটাতে হবে।

রাশিয়ার বুকে জার স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে বলশেভিক পার্টি গড়ে তোলা, শোষিত শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে সফল করে তোলবার জন্য সংগ্রাম, ট্রটস্কিবাদের বিরুদ্ধে তীব্র আদর্শগত সংগ্রাম, বিপ্লবোত্তর পরিস্থিতিতে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখবার সংগ্রাম, কমরেড লেনিনের জীবনাবসানের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক অগ্রগতিকে অব্যাহত রাখবার সংগ্রাম এবং সর্বোপরি হিংস্র উন্মত্ত ফ্যাসিবাদের কবল থেকে মানবজাতিকে রক্ষার সংগ্রামে ব্যাপৃত ছিল কমরেড স্তালিনের সমগ্র জীবন। শুধু তাই নয়, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন ও জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের মধ্যে আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে অটুট রাখতে তিনি পুঁজিবাদী ও ঔপনিবেশিক দেশগুলোতে কমিউনিস্ট পার্টি গঠনে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনে এক অনবদ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

কমরেড স্তালিনই সর্বপ্রথম কমরেড লেনিনের শিক্ষা ও তত্ত্বগুলোকে সূত্রবদ্ধ করে সৃষ্টি করেন — ‘লেনিনবাদ’। এর সংজ্ঞা নির্ধারিত করে তিনি বলেছিলেন : লেনিনবাদ হলো সাম্রাজ্যবাদ ও শ্রমিক-বিপ্লবের যু‍‌গের মার্কসবাদ। আরও সঠিকভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, লেনিনবাদ হলো সাধারণভাবে শ্রমিক-বিপ্লবের মতবাদ ও রণকৌশল এবং বিশেষভাবে এ হলো শ্রমিকশ্রেণীর মতবাদ ও রণকৌশল।

লেনিনবাদকে মার্কসবাদের আরও বিকশিত রূপ হিসেবে উল্লেখ করে তার অসামান্য বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন কমরেড স্তালিন। সর্বহারারা যখন বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, শ্রমিক-বিপ্লব যখন কার্যক্ষেত্রে আশু ও অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠেনি সেই প্রাক্‌-বিপ্লব যুগে মার্কস আর এঙ্গেলস তাঁদের কার্যকলাপ চালাতেন। আর মার্কস-এঙ্গেলসের উত্তরসূরি কমরেড লেনিন তাঁর কাজ চালিয়েছেন বিকশিত সাম্রাজ্যবাদের যুগে, শ্রমিক বিপ্লবের বিকাশের যুগে — যখন শ্রমিক বিপ্লব একটি দেশে ইতোমধ্যেই জয়যুক্ত হয়েছে, বুর্জোয়া গণতন্ত্রকে চূর্ণ করে, শ্রমিকশ্রেণীর গণতন্ত্রের, সোভিয়েততন্ত্রের যুগের সূত্রপাত করেছে।

এইভাবে মার্কসবাদ-এর তত্ত্বকে বিকশিত করে তুলে‍‌ছিলেন কমরেড স্তালিন। তিনিই লেনিনবাদের প্রবক্তা। ১৯২৪-এ প্রকাশিত কমরেড স্তালিনের ‘লেনিনবাদের ভিত্তি’ এবং ১৯২৬-এ ‘লেনিনবাদের সমস্যা’ পুস্তক দুটিতে লেনিনবাদের আরও ব্যাপক বিস্তৃত আদর্শগত ব্যাখ্যা রয়েছে।

দুনিয়ার মুক্তিকামী মানুষের প্রিয় নেতা, শিক্ষক কমরেড লেনিনের জীবনাবসানের পর সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরে তীব্র মতাদর্শগত বিরোধ দেখা দেয়। কমরেড লেনিনের ‍‌জীবদ্দশাতেই ১৯২২ সালের ৩রা এপ্রিল পার্টি’র কেন্দ্রীয় কমিটির পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে কমরেড লেনিনের প্রস্তাবে কমরেড স্তালিন পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। উল্লেখ্য, একই বছরে গঠিত হয়েছিল ‘ইউনাইটেড সোভিয়েত সোস্যালিস্ট রিপাবলিক’ সংক্ষেপে ইউ এস এস আর। কমরেড লেনিন নেই। একদিকে নবগঠিত সোভিয়েতে সমাজতান্ত্রিক নির্মাণকাজকে চালু রাখা, অন্যদিকে পার্টির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ট্রট‍‌স্কি-বুখারিন-জিনোভিয়েভ-কামেনেভ-রাডেক চক্রের পার্টি, কমরেড স্তালিন ও সোভিয়েত সরকারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই চলতে থাকা কার্যকলাপ নবগঠিত এই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পক্ষে চরম বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির এই কার্যকলাপ কমরেড স্তালিনকে এতটুকু বিচলিত করতে পারেনি। এই সঙ্কটের মধ্যেই তিনি লেনিনবাদের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করে তীব্র আন্তঃপার্টি সংগ্রাম গড়ে তুলে তাঁর সমস্ত বিরোধীদের তত্ত্বগতভাবে ধরাশায়ী করেছিলেন। যার পরিণতিতে পরবর্তীকালে ট্রটস্কি ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা পার্টির কাছে নিজেদের ভুল স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন।

কমরেড স্তালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েতে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯২৮-৩২) ছিল সার্বিক অগ্রগতির এক উৎসমুখ। পুঁজিবাদী দুনিয়ার মাতব্বর সংবাদপত্রগুলো কমরেড স্তালিনের এই পরিকল্পনাকে নিয়ে অনেক ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করেছিল। অথচ এই পরিকল্পনার প্রথম চার বছরেই কৃষি, শিল্প, শিক্ষাসহ সবকটি মৌলিক ক্ষেত্রেই গড়পড়তা ৯৩ শতাংশ সাফল্য দেখা দিয়েছিল। এককথায় দুরন্ত অগ্রগতি। তখন ঐসব কুৎসা রটনাকারী সংবাদপত্রগুলো তার প্রশংসায় সরব হতে বাধ্য হয়েছিল। এই সময়ে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো পুঁজিবাদী দুনিয়ার তীব্র সঙ্কট। প্রথম পরিকল্পনার চার বছরে সোভিয়েতে যখন শিল্পোৎপাদন বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে উঠেছে তখন পুঁজিবাদী দেশ যথাক্রমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তা কমেছে শতকরা ৫৭ ভাগ, ব্রিটেনে কমেছে শতকরা ১৮ ভাগ, জার্মানিতে কমেছে শতকরা ৪০ ভাগ এবং ফ্রান্সে কমেছে শতকরা ৩০ ভাগ। পুঁজিবাদের এই সর্বব্যাপী সঙ্কটের যুগে কমরেড স্তালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েতে সমাজতন্ত্রের জয়যাত্রা অব্যাহত ছিল। প্রথম পরিকল্পনায় রাশিয়ার কৃষি সমস্যার সম্পূর্ণ সমাধান না হওয়াতে দ্বিতীয় পরিকল্পনায় (১৯৩৩-৩৭) কৃষিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিল যাতে ১৯৩৫ সালের গোড়াতেই শতকরা ৮৫ ভাগ জমি যৌথ খামারের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল এবং উৎপাদিত পণ্য বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছিল শতকরা ২৬৯ ভাগ।

১৯৩৬ সালে সোভিয়েতের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে এক আমূল পরিবর্তন ঘটে গিয়েছিল। শিল্প, কৃষি, শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসহ সর্বক্ষেত্রেই উন্নতির ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। এই ব্যাপক উন্নয়নের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সংবিধান-এর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেওয়ায় ১৯২৪ সালে সোভিয়েত প্রণীত সংবিধানকে নতুন রূপ দেওয়া হয়। কমরেড স্তালিনের সভাপতিত্বে মোট ৩১ জনের একটি বিশেষজ্ঞ দল ১৯৩৬ সালে রচনা করেন সোভিয়েতের নতুন সংবিধান। এই সংবিধানে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের তুলনায় আরও অনেক বেশি গণতান্ত্রিক অধিকার দেওয়া হলো। এই সংবিধানে ঘোষণা করা হয়েছিল গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র অজেয়। মনীষী রোঁমা রোলাঁ এই সংবিধানকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছিলেন : ‘স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের আদর্শ এতকাল ছিল মানুষের স্বপ্নের বস্তু মাত্র। এই সংবিধান থেকে তারা প্রাণ পেল।’ চীন থেকে সান ইয়াৎ সেনও অভিনন্দিত করেছিলেন এই সংবিধানকে। ইতিহাসে এই সংবিধান স্তালিন সংবিধান নামে পরিচিত হয়ে আছে। ১৯৩৮ সালে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির অনুমোদনক্রমে কমরেড স্তালিন রচনা করেন ‘সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টি (বলশেভিক)-র ইতিহাস — সংক্ষিপ্ত পাঠ’। ঐ একই বছরে তিনি লেখেন ‘দ্বন্দ্বমূলক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ’ যা মার্কসীয় দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের এক অমূল্য দলিল।

২২শে জুন, ১৯৪১। হিটলার সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করলো। কমরেড স্তালিন ঘোষণা করলেন : . . . কেবল আমাদের দেশকেই মুক্ত করা নয়, ফ্যাসিস্ত প্রভুত্বে নিপীড়িত জনগণকেও আমরা মুক্ত হতে সাহায্য করব। . . . এ যুদ্ধ সমগ্র মানবজাতির মুক্তি ও গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপান্তরিত হবে।

কমরেড স্তালিনের আহ্বানে নাৎসি জল্লাদদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লেনিনগ্রাদে ৩ লক্ষ লালফৌজের পাশে এসে সমবেত হয় সমগ্র লেনিনগ্রাদের জনসাধারণ। প্রবল প্রতিরোধের মুখে পিছু হটতে হয়েছিল হিটলারের ২ লক্ষ সেনা, ৮৪৬টি বিমান এবং ৪০০টি ট্যাঙ্ককে। হিটলারের মস্কো দখলের পরিকল্পনা ‘অপারেশন টাইফুন’ মুখ থুবড়ে পড়েছিল। লালফৌজের সবচেয়ে গৌরবজনক লড়াই ছিল স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধ। এর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মার্শাল জুকভ। শুরুতে নাৎসিরা স্তালিনগ্রাদের শতকরা ৭৫ ভাগ অংশই দখল করে ফেলেছিল। স্তালিনগ্রাদের জনসাধারণ ঐক্যবদ্ধভাবে বীরত্বপূর্ণ লড়াই-এর মধ্য দিয়ে পুরোটাই তাদের হাত থেকে কেড়ে নেয়। লেনিনগ্রাদ, মস্কো, স্তালিনগ্রাদের লড়াইতে লালফৌজের কাছে আত্মসমর্পণ হিটলারের কাছে খুব বড় আঘাত হয়ে উঠেছিল। ১লা মে, ১৯৪৫ কমরেড স্তালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত লালফৌজ বার্লিনের রাইখ্‌স্ট্যাগে রক্তপতাকা উড়িয়ে মানবজাতির চরমতম শত্রু ফ্যাসিবাদের পরাজয় ঘোষণা করেছিলেন।

ফ্যাসি-বিরোধী যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল প্রথম স্থানে। এই যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছিলেন ২ কোটি সোভিয়েত জনগণ। যুদ্ধের সময় শিশুসহ ৫০ হাজারের বেশি মানুষকে জার্মানিতে দাস শ্রমিক হিসেবে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। যুদ্ধ চলাকালীন সোভিয়েতে ৫৩ লক্ষ যুদ্ধবন্দীর মধ্যে যুদ্ধের শেষে মাত্র ১০ লক্ষকে জীবিত পাওয়া গিয়েছিল। ফ্যাসিস্তদের আক্রমণে চরম ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছিল সোভিয়েতের ছোট-বড় মিলিয়ে ১ হাজারেরও বেশি শহরকে, ৭০ হাজার গ্রামকে, ৩২ হাজার শিল্প সংস্থাকে এবং ৯৮ হাজার যৌথ ও রাষ্ট্রীয় খামারকে। যুদ্ধ যখন চলছে, মিত্রশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েতকে ৬০০ কোটি ডলার ঋণ দেবার প্রতিশ্রুতি দেয়। তখন রুজভেল্ট ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। রুজভেল্টে’র জীবনাবসানের পর ট্রুম্যান মার্কিন প্রেসিডেন্ট হয়েই সেই প্রতিশ্রুতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। এতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র প্রকাশ হয়ে পড়ে। অবশ্য কমরেড স্তালিন তাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হননি। তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বে সমস্ত যুদ্ধকালীন ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রমাণ করে দিয়েছিল তার সমাজতান্ত্রিক দৃ‌ঢ়তা। শুধু তাই নয়, পূর্ব ইউরোপের সদ্য মুক্ত হওয়া দেশগুলোতে সমাজতান্ত্রিক গঠনকার্যেও সোভিয়েত তার সমগ্র শক্তিকে ব্যবহার করেছিল। এইভাবে যুদ্ধে বীভৎসা কাটিয়ে কমরেড স্তালিনের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে দুনিয়ার তাবৎ শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অন্যতম হয়ে উঠেছিল।

অক্টোবর, ১৯৫২-তে সোভিয়েত বলশেভিক পার্টির ঊনবিংশতম কংগ্রেসের ভাষণে কমরেড স্তালিন বলেছিলেন : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান ও জাপানী ফ্যাসিস্ত বর্বরতাকে চূর্ণ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন ইউরোপ এবং এশিয়ার জনগণকে ফ্যাসিস্ত দাসত্বের বিপদ থেকে মুক্ত করেছে। . . . যে সকল কমিউনিস্ট শ্রমিক-কৃষক ও গণতান্ত্রিক পার্টি আজও বুর্জোয়া শাসনের চাপে শোষিত ও বঞ্চিত, তাদের দিকে আমাদের বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে।

এই পার্টি কংগ্রেস ভবিষ্যতে সোভিয়েতকে যেকোন বিপদের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ মোকাবিলার আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান করে তুলেছিল। এটাই ছিল কমরেড স্তালিনের জীবনের শেষ পার্টি কংগ্রেস। ৫ই মার্চ, ১৯৫৩ সোভিয়েত তথা সমগ্র দুনিয়ার শোষিত জনগণের মুক্তিকামী নেতা কমরেড স্তালিন চিরনিদ্রামগ্ন হন।

তবে, জীবনের শেষপর্বে কমরেড স্তালিনের কিছু ভুল হয়েছিল যা একজন মার্কসবাদী-লেনিনবাদী হিসেবে সতর্কভাবে তাঁর এড়িয়ে চলা উচিত ছিল। কিন্তু এই মহান বিপ্লবীর সমগ্র জীবনচর্চায় দেখা যায় মার্কসবাদ-লেনিনবাদের মৌলিক তত্ত্ব ও তার বিকাশ তথা শোষণহীন সমাজ গঠনে শোষিত মানুষের মুক্তি সংগ্রামকে জয়ী করতে কমরেড স্তালিনের নিরলস প্রয়াস তাঁর এই ভুলগুলোর তুলনায় বহুগুণ বড় হয়ে উঠেছে। কমরেড স্তালিনের এইসব ভুলগুলোকে বিশ্লেষণ করতে হবে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে।

দুনিয়ায় শ্রেণীহীন সমাজ গঠনের সংগ্রাম যতদিন ধরে চলবে, নিপীড়িত হৃদয়ের প্রতি স্পন্দনে অনুপ্রেরণার স্ফূলিঙ্গ হয়ে রইবেন কমরেড স্তালিন।

সূত্রঃ http://ganashakti.com/bengali/news_details.php?newsid=17898

ভাষা, শ্রেণী এবং স্ট্যালিন : ৬০ বছরের পূর্বানুবৃত্তি

8587839

ত্রিশ-চল্লিশের দশকে ভাষা নিয়ে এক ঝড় উঠেছিল সোভিয়েত ইউনিয়নে। শ্রেণী বিপ্লব হয়েছে, ক্ষমতায়ন ঘটেছে সর্বহারা শ্রেণীর, চলছে রাষ্ট্র ও সমাজের সবকিছু ঢেলে সাজানোর কাজ। এরকম কর্মযজ্ঞের মধ্যে একদল ভাষাবিদ তুলে ধরলেন শ্রেণী ভাষার ধারণা। ভাষাকেও হয়ে উঠতে হবে শ্রেণীর ভাষা,- এককথায় এটিই ছিল সে ঝড়ের মূল বার্তা। ঝড়ের সেই ঝাপটা স্পর্শ করে জোসেফ স্ট্যালিনকেও, যিনি ছিলেন তখন সেই প্রথম ও নতুন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রটির নির্মাণযজ্ঞের প্রাণকেন্দ্রে। ভাষা সমাজের কোনো কাঠামোভুক্ত কি না, শ্রেণিভাষা হতে পারে কি না ইত্যাদি বিষয়গুলি নিয়ে ভাষাবিতর্কের এক পর্যায়ে স্ট্যালিনও অংশ নেন। ‘প্রাভদা’ পত্রিকায় ১৯৫০ সালে বিভিন্ন প্রশ্ন ও চিঠির উত্তরে জোসেফ স্ট্যালিন যা লিখেছিলেন, সেগুলো নিয়ে পরে ১৯৫২ সালে, বাংলা ভাষা আন্দোলনের বছরে, প্রকাশ পায় ‘ মার্কসিজম অ্যান্ড প্রবলেমস অব লিঙ্গুয়িস্টিক্‌স’ নামের গ্রন্থটি। ইংরেজি ভাষার পাঠকদের কাছে বইটি পৌঁছায় আরও দু বছর পর – ১৯৫৪ সালে।
কালপর্বের হিসেবে সোভিয়েত রাশিয়ায় ভাষাবিতর্কের সময় বাংলাদেশেও (তৎকালীন পূর্ববঙ্গে) চলছে মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। স্ট্যালিন এই রক্তঝরা আন্দোলন সম্পর্কে কী ভেবেছেন, জানা নেই আমাদের। তবে ভারতের অবমুক্ত হওয়া দুটি কূটনৈতিক নথিপত্র থেকে এটুকু বোঝা যায়, সোভিয়েত রাশিয়ার ওই ভাষাবিতর্কের সময় স্ট্যালিন চেষ্টা করেছেন ভারত ও পাকিস্তানের ভাষাগুলি সম্পর্কে ধারণা পাবার। সোভিয়েত রাশিয়ার ওই ভাষাবিতর্ক তুলে ধরেছে এমন সব ধারণা ও প্রসঙ্গ, যা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ভাষাচিন্তায় এখনও অর্থবহ। শ্রেণি-অঞ্চল-অর্থনীতি-প্রযুক্তি-সমাজ ইত্যাদির বিভিন্ন পরিবর্তনের সূত্রে ভাষায় নতুন নতুন যে-সব উপাদান সঞ্চারিত হয়, সেগুলি নিয়ে প্রায়ই কৃত্রিম বিতর্ক সৃষ্টি করা হয়, খণ্ডিত ভাবনা থেকে সেগুলিকে জনগোষ্ঠী ও পাঠকশ্রেণির ওপর চাপিয়ে দিয়ে আসলে ভাষার প্রাণপ্রবাহকেই শ্লথ ও রুদ্ধ করে দেয়া হয়। স্ট্যালিনের ওইসব লেখাগুলি প্রকাশের পর প্রায় ৬০ বছর পেরিয়ে গেলেও তাই সেগুলি প্রকাশের প্রেক্ষাপট, বিষয়বস্তু ও উপসংহার এখনও অর্থবহ।
সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাষাবিতর্ক স্ট্যালিনের নজরে আনেন জর্জিয়ান সেন্ট্রাল কমিটির প্রধান সম্পাদক ক্যানডিড শার্কভিয়ানী (Kandid Charkviani)। যার মাধ্যমে এই বিতর্ক শুরু হয়েছিল, সেই নিকোলাই ইয়াকভলেভিচ মার (১৮৬৪-১৯৩৪) অবশ্য অনেক আগেই মারা গিয়েছিলেন। কিন্তৃ ১৯২৪ সাল থেকে শুরু করে জীবনের শেষ পর্যন্ত নিকোলাই ইয়াকভলেভিচ মার (Nikolay Yakovlevich Marr) কাজ করে গেছেন ‘মার্কসীয় ভাষাবিজ্ঞানের’ কাঠামো নির্মাণের লক্ষ্যে। নিকোলাইয়ের ‘মার্কসীয় ভাষাবিজ্ঞান’ নিয়ে আপত্তি তোলায় ভাষাবিদদের অনেককেই হয়রানির শিকার হতে হয়েছে, অভিযুক্ত হতে হয়েছে নানাভাবে। কিন্তু সদ্য প্রতিষ্ঠিত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে শ্রেণিতাড়না এত তীব্র ছিল যে, জীবদ্দশায় বিতর্কিত হতে হয়নি ককেশিয় ভাষাসমূহের বিশেষজ্ঞ নিকোলাই ইয়াকভলেভিচকে।
নিকোলাই মার ভাষাকে দেখেছিলেন আদর্শ বা ইডিওলোজিরই একটি ফর্ম হিসেবে। বলেছিলেন, ভাষা অবকাঠামোর অংশ, প্রতিনিধিত্ব করে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি বা শ্রেণিসমূহের। ভাষার নতুন এক ব্যবহারিক দিক তুলে ধরেন তিনি; সমাজের মূল কাঠামোর বিভিন্ন আদর্শ ও ধারণা প্রতিষ্ঠার জন্যে, বহমান রাখার জন্যে, অবকাঠামোর অংশ হিসেবে ভাষার ভূমিকা নির্ধারণ করেন তিনি।
মার-এর এই শ্রেণিভাষার ধারণা ভাষাবিজ্ঞানে পরিচিত ‘জ্যাফেটিক তত্ত্ব’ নামে। জ্যাফেটিক শব্দটি নিকোলাই নেন নোয়াহ বা নূহের এক ছেলে জ্যাফেথের নাম থেকে। ককেসাস অঞ্চলের কার্টভেলিয় ভাষাগুলির সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের সেমেটিক ভাষাগুলির সম্পর্ক দেখানোর লক্ষ্যে তিনি এ তত্ত্বায়ন করেছিলেন। কার্টভেলীয় ভাষাগুলির মধ্যে জর্জিয়ার ভাষাই ছিল একমাত্র লিখিত ভাষা। সম্ভবত এজন্যেই পরবর্তী সময়ে প্রসঙ্গটি বিশেষভাবে চোখে পড়ে সেখানকার কমিউনিস্ট নেতা শার্কভিয়ানীর। মার ধারণা দেন, ককেসিয়, সেমেটিক-হেমেটিক এবং বাসকিউ ভাষার উৎস অভিন্ন। এই তত্ত্বের আংশিক রূপরেখা তিনি তৈরি করেন অক্টোবর বিপ্লবের আগে। কিন্তু তা ভিন্ন এক পরিণতির দিকে এগোয় অক্টোবর বিপ্লবের পর। মার তাঁর তত্ত্বকে সম্প্রসারিত করেন ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগুলির মূল ভিত্তির সন্ধানে, দাবি করেন যে এসব ভাষা আসার আগে ইউরোপ জুড়ে চালু ছিল জ্যাফেটিক ভাষাগুলি। খুঁজলে এসব ভাষাকে এখনও পাওয়া যাবে- এগুলো টিকে রয়েছে ভাষার উপস্তর হিসেবে, যার ওপর প্রতিস্থাপিত হয়েছে ইন্দোইউরোপীয় ভাষাগুলি। ভাষার এর মডেল ব্যবহার করার মধ্যে দিয়ে মার উদ্যোগী হন ভাষাবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মার্কসীয় তত্ত্ব প্রয়োগের এবং মত দেন যে ভাষার বিভিন্ন স্তর বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করছে। তিনি, এমনকি এমন দাবিও করেন, ভাষাবিজ্ঞানের দিক থেকে দেখতে গেলে, বিভিন্ন দেশের একই ধরণে বিন্যস্ত সামাজিক শ্রেণির ব্যবহূত ভাষার কথ্য সংস্ড়্গরণ অনেকটাই কাছাকাছি, যদিও তা অন্যান্য শ্রেণিগুলির ভাষার কথ্য সংস্করণের চেয়ে দূরবর্তী। ঠিক তেমনি বিভিন্ন দেশের অন্যান্য শ্রেণির ভাষাগুলির কথ্য সংস্করণ আবার অনেকটাই কাছাকাছি। এইভাবে মার একটি জনগোষ্ঠীর শ্রেণিনির্বিশেষে সকল মানুষের অভিন্ন ভাষার ধারণাটিকে বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী ভ্রান্ত ধারণা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন।
নিকোলাই মার-এর মৃত্যু হয় ১৯৩৪ সালে। কিন্তু তারপরও অবস্থা একই থাকে। তাঁর অনুসারী ভাষাবিদরা গুরুর ধ্যানধারণাই পল্লবিত করতে থাকেন সোভিয়েত রাশিয়া জুড়ে। এর মধ্যে শুরু হয় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, টালমাটাল এক সময়ের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলে নতুন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। কিন্তু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর আবারও এ নিয়ে তর্ক বাধে এবং কোরিয়া যুদ্ধের উন্মাত্তাল সময়টিতে এ ব্যাপারে মুখ খোলেন জোসেফ স্ট্যালিন। সোভিয়েত রাশিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রগুলি অবশ্য এ বিতর্ককে এবং তাতে স্ট্যালিনের অংশগ্রহণকে সন্দেহ ও সংশয়ের চোখেই বিবেচনায় নেয়। কেননা ঠিক ওই সময়েই শুরু হয় কোরিয়ার যুদ্ধ – যাকে কেন্দ্র করে বিশ্বের পরাশক্তিগুলি বিভক্ত হয়ে পড়েছিল।
তবে বিরোধী পরাশক্তিগুলি এ বিতর্ককে যেভাবেই দেখুক না কেন, মূল ঘটনা ছিল অন্যরকম। নিকোলাই মার-এর অনুসারী জর্জিয়ারই এক ভাষাবিদ আরনল্ড স্টেপানোভিচ শিকোবাভার (Arnold Stepanovich Chikobava) ভাষাবিষয়ক কয়েকটি নিবন্ধ স্ট্যালিনের কাছে পাঠিয়েছিলেন জর্জিয়ান সেন্ট্রাল কমিটির প্রথম সম্পাদক ক্যানডিড শার্কভিয়ানী। লেখাগুলির সঙ্গে ছিল তাঁর ব্যক্তিগত উদ্বেগ – ভাষাকে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে নিকোলাইয়ের পদ্ধতি কি সত্যিই মার্কসবাদসম্মত? প্রশ্ন তুলেছিলেন শার্কভিয়ানী, সব ভাষা যদি শ্রেণিভিত্তিকই হয়, তা হলে কি ভাবে বিশ্লেষণ করা হবে শ্রেণিহীন সময়ের, আদিম সাম্যবাদী পর্ব বিকাশের সময়কার ভাষা-ব্যবহারকে? প্রধান উৎপাদন পদ্ধতির সঙ্গে, পৃথক পৃথক জাতীয় সংস্কৃতিগুলির সঙ্গে ভাষার সংশ্লিষ্টতাকেই বা ব্যাখ্যা করা হবে কীভাবে?
এরকম প্রশ্নের মুখে স্ট্যালিন ডেকে পাঠান ভাষাবিদ শিকোবাভা এবং জর্জিয়ার কম্যুনিস্ট পার্টির সেন্ট্রাল কমিটির সাদারণ সম্পাদক ক্যানডিড শার্কভিয়ানীকে। দু পক্ষের ভাষ্য শোনার পর স্ট্যালিন শিকোবাভাকে বলেন, ভাষাবিজ্ঞান সম্পর্কে তাঁর এ ধারণা প্রাভদার মাধ্যমে সবার সামনে তুলে ধরতে। ৯ মে ১৯৫০-এ প্রাভদা পত্রিকায় প্রকাশ পায় শিকোবাভার অভিমত। এরপর প্রাভদা পত্রিকা এ নিয়ে উন্মুক্ত আলোচনার জন্যে প্রতি সপ্তাহে বরাদ্দ করে দু’টি পাতা। সম্পাদকের পক্ষ থেকে এ বিভাগের ব্যানারহেডিং-এর সঙ্গে নোট রাখা হয়, ‘সমালোচনা ও আত্মসমালোচনার মধ্যে দিয়ে সোভিয়েত ভাষাবিজ্ঞান বিকাশের প্রতিবন্ধকতাগুলি অতিক্রম করতে প্রাভদায় আয়োজিত মুক্ত আলোচনা।’ বেশ কয়েক সপ্তাহ নিকোলাইয়ের ওই তত্ত্বের পক্ষে বিপক্ষে আলোচনা চলে পত্রিকাটিতে। তারপর ২০ জুন, ১৯৫০-এ একদল সোভিয়েত ছাত্রের কয়েকটি প্রশ্নের উত্তরে ’অন মার্কসিজম ইন লিঙ্গুয়িস্টিকস’ লেখাটির মধ্যে দিয়ে এ বিতর্কে অংশ নেন জোসেফ স্ট্যালিন। অবশ্য, কট্টর স্ট্যালিনবিরোধীদের বলে থাকেন, স্ট্যালিন নন, কোনও এক ভুতুড়ে-লেখকই এইসব লেখা লিখেছেন এবং তাঁর শিকোবাভা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি!

দুই
স্ট্যালিনের অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়ে সোভিয়েত রাশিয়ার ভাষা বিতর্ক একটি উপসংহার খুঁজে পায়। স্ট্যালিন বলেন, ভাষা সামাজিক ভিত্তির কোনও অবকাঠামো নয়। সমাজের ভিত্তি হলো অর্থনৈতিক কাঠামো এবং সমাজের প্রতিনিধিত্বশীল রাজনৈতিক, দার্শনিক, আইনগত, ধর্মীয়, শিল্পসাংস্কৃতিক বিভিন্ন মত ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসমূহ সেই অর্থনৈতিক কাঠামোর অবকাঠামো। এ কারণে কাঠামো যখন পাল্টায়, তখন অনিবার্য কারণেই অবকাঠামোও পাল্টায় বা পর্যায়ত্ক্রমে অপসৃত হয়। নতুন কাঠামোর প্রতিনিধিত্ব করে নতুন এক অবকাঠামো। কিন্তু ভাষা এরকম পরিবর্তনশীলতার স্রোতে পড়ে না, কেননা ভাষা অবকাঠামোর চেয়ে রেডিক্যালি আলাদা। ভাষার এই রেডিক্যাল দিক তুলে ধরেন স্ট্যালিন সোভিয়েত রাশিয়ার সমাজ বিপ্লবের উদাহরণ দিয়ে। তিনি বলেন, এখানে বিপ্লব হয়েছে, বিপ্লবপূর্ব পুঁজিবাদী কাঠামো ও অবকাঠামোগুলিও অপসৃত হয়েছে, কিন্তু রাশিয়ার ভাষার তেমন কোনও পরিবর্তন হয়নি, পরিবর্তন হয়নি সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্য কোনও ভাষার। নতুন এক রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা, উৎপাদন ব্যবস্থা এবং নতুন সামাজিক সম্পর্ক ও নৈতিকতার কারণে, তা ছাড়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিকাশের সঙ্গে সম্পৃক্তি ঘটায় বিভিন্ন ভাষার শব্দভাণ্ডারে অবশ্য অনিবার্যভাবেই যুক্ত হয়েছে নতুন অনেক শব্দ, নতুন অনেক প্রকাশভঙ্গিমা। সামাজিক বিপ্লবের ফলে সমাজের শব্দভাণ্ডারে সংযুক্ত এসব নতুন শব্দের মধ্যে দিয়ে সমাজ সমৃদ্ধ হয়েছে, যোগাযোগের মাধ্যম খুঁজে পেয়েছে। ঠিক একইভাবে এর ফলে অনেক শব্দ ও প্রকাশভঙ্গিমার অর্থ পাল্টে গেছে, অনেক শব্দ নতুন করে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে এবং কিছু শব্দ বাদও পড়ে গেছে শব্দের ভাণ্ডার থেকে। কিন্তু তার মানে এই নয়, ভাষা বদলে গেছে, কেননা ভাষার বুনিয়াদ নির্মিত হয় তার মৌলিক শব্দভাণ্ডার ও ব্যাকরণ পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে, যা সমাজ-রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিবর্তনের পরও কোনও গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ছাড়াই নিজের সামগ্রিকতা সংরক্ষণ করতে পারে।
কাঠামো ও অবকাঠামোর বিবরণ ছাড়া স্ট্যালিন তাঁর যুক্তিকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারতেন না। স্ট্যালিনের লেখায় তাই রয়েছে কাঠামো ও অবকাঠামোর ভাষার সংক্ষিপ্ত ও সামগ্রিক বিবরণ। অবকাঠামের সঙ্গে ভাষার পার্থক্য খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেছেন তিনি বিভিন্ন দিক থেকে এবং দেখেছেন অন্তত তিনটি দিক থেকে ভাষা রেডিক্যালি আলাদা। প্রথমত• ভাষা কোনও সুনির্দিষ্ট সমাজের নতুন অথবা পুরানো এক অথবা একাধিক ভিত্তির উৎপাদন নয়। ভাষা সৃষ্টি হয় বহু শতাব্দী ধরে সমাজ ও তার কাঠামোসমূহের ইতিহাসের সামগ্রিক ধারা থেকে। কোনও সুনির্দিষ্ট শ্রেণি একে সৃষ্টি করে না, তাকে সৃষ্টি করে পুরো সমাজ, সৃষ্টি করে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণিগুলি আর তা সৃষ্টি হয় শ শ প্রজন্মের প্রচেষ্টার মধ্যে দিয়ে। ঠিক তেমনি এটি কোনও সুনির্দিষ্ট শ্রেণির প্রয়োজন মেটানোর জন্যে নয়, বরং পুরো সমাজের জন্যে, সমাজের সকল শ্রেণির প্রয়োজন মেটানোর জন্যেই সৃষ্টি হয়ে থাকে। কারণ ভাষার সৃষ্টি সমাজের জন্যে। সমাজের সকল সদস্যের একক ও অভিন্ন ভাষা হিসেবেই তা সৃষ্টি হয়ে থাকে। একটা শ্রেণি আরেকটা শ্রেণির ওপর প্রভূত্ব করবে, কর্তৃত্ব করবে,- এ জন্যে ভাষা গড়ে ওঠে না। ভাষা গড়ে ওঠে জনগণের মধ্যে যোগাযোগের সংযোগ হিসেবে, সমানভাবে গোটা সমাজের ও সমাজের সকল শ্রেণির সেবার করতে। এ কারণেই এটি কোনও আদর্শগত অবকাঠামোর অন্তভুক্ত হতে পারে না। নিজেকে আদর্শগত অবকাঠামোর বাইরে রাখতে সক্ষম বলেই ভাষা পারে একই সঙ্গে পুরনো ও মরমর ব্যবস্থা এবং নতুন ও উঠতি ব্যবস্থার, পুরনো ও নতুন কাঠামোর এবং শোষক ও শোষিত উভয়ের সঙ্গেই যোগাযোগ-সংযোগ ঘটাতে। ভাষার সৃষ্টি হয়েছে, ভাষার অস্তিত্ব নির্ভর করছে সমগ্র সমাজকে সেবা করার ওপর, জনগণের যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কার্যকর থাকার ওপর, সমাজের সকল সদস্যের কাছে সাধারণ ও একক একটি ভাষা হয়ে ওঠার মধ্যে দিয়ে শ্রেণিঅবস্থান ও শ্রেণিমর্যাদা নির্বিশেষে সমাজের সকল সদস্যের সমান সেবা করার ওপর। স্ট্যালিন বলেন, ভাষা তার এই অবস্থান থেকে, সমগ্র মানুষের সাধারণ ও একক ভাষা হয়ে ওঠা থেকে বিচ্যুত হয় তখন যখন এটি বিশেষ কোনও গোষ্ঠীকে সমাজের অপরাপর সামাজিক গোষ্ঠীগুলির ওপর কর্তৃত্ব করার ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেয় ও সমর্খন করে। তখন সে তার শক্তি হারায়, সমাজের জনগোষ্ঠীগুলির যোগাযোগের উপায় না হয়ে প্রতিবন্ধক হয় এবং বিশেষ কোনও সামাজিক গোষ্ঠীর অপভাষা বা জার্গনে পরিণত হয়।
ভাষার দ্বিতীয় রেডিক্যাল দিকটি হলো এর দীর্ঘস্থায়িত্ব। অবকাঠামো সম্পৃক্ত সেটির অর্থনৈতিক কাঠামোর সঙ্গে। এই দিক থেকে তা একটি বিশেষ যুগের উৎপাদন, একটি বিশেষ অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিপূরক। ওই অর্থনৈতিক কাঠামোটি যখন পাল্টে যায়, তখন অনিবার্যভাবেই অবকাঠামোও পাল্টায়। কিন্তু, স্ট্যালিন দেখেছেন, ভাষা, এসবের বিপরীতে, গড়ে ওঠে যুগ যুগ ধরে; দিনের পর দিন তা সমৃদ্ধ হয়, বিকশিত হয়। কাজেই কোনও ভাষার স্থায়িত্ব কোনও অবকাঠামোর চেয়েও অনেক বেশি। তিনি মন্তব্য করেন, সামাজিক জীবনে চূড়ান্ত এক নৈরাজ্য সংঘটনের মাধ্যমেই কেবল সম্ভব হতে পারে একটি ভাষাকে বিনাশ করা এবং ডন কুইকজোট ছাড়া আর কেউই নিজেকে এ ধরণের কাজে জড়াবে না।
ভাষার তৃতীয় রেডিক্যাল দিক হলো উৎপাদনের সঙ্গে এর প্রত্যক্ষ সংযুক্তি। স্ট্যালিন দেখতে পান এবং আমাদেরও দেখান, ভাষা উৎপাদনের সঙ্গে, মানুষের উৎপাদনশীল কার্যক্রমের সঙ্গে সংযুক্ত; অন্যদিকে অবকাঠামো উৎপাদন ও মানুষের উৎপাদনশীল কার্যক্রমের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সংযুত্ত্ন থাকে না। এসবের সঙ্গে তার সংযুক্তি ঘটে অপ্রত্যক্ষভাবে, অর্থনীতির মাধ্যমে, কাঠামোর মাধ্যমে। ভাষা উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত বলেই ভাষা, আরও এগিয়ে দেখতে গেলে এর শব্দের ভাণ্ডার এক নিরবচ্ছিন্ন পরিবর্তনপ্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলে। কেননা মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে, শিল্পে ও কৃষিতে, বাণিজ্য ও পরিবহনে, প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন ঘটছে এবং সেই পরিবর্তন তাদের কার্যক্রমের জন্যে প্রতিনিয়ত ভাষার কাছে নতুন নতুন শব্দ ও প্রকাশভঙ্গিমা দাবি করে চলেছে। ভাষাকে তাদের সেই প্রয়োজন সরাসরি মেটাতে হচ্ছে তার ব্যাকরণগত পদ্ধতিকে আরও যথাযথ করে তুলে, তার শব্দভাণ্ডারে নতুন নতুন শব্দ সংযুক্তির মাধ্যমে।

তিন
অবকাঠামোর অংশ হিসেবে ভাষার অস্তিত্ব নাকচ করার মধ্যে দিয়ে স্ট্যালিন নাকচ করে দিয়েছিলেন ভাষার শ্রেণি চরিত্রের প্রশ্ন, শ্রেণিভাষার প্রশ্ন। ক্ল্যান-ভাষা থেকে ট্রাইব-ভাষা, ট্রাইব-ভাষা থেকে জাতিসত্বাসমূহের ভাষা এবং জাতিসত্বাসমূহের ভাষা থেকে জাতীয় ভাষা,- ভাষা বিকাশ ও উত্তরণের প্রতিটি পর্বেই, সমাজের জনগণের মধ্যেকার যোগাযোগের উপায় হিসেবে ভাষা ছিল ওই সমাজের সাধারণ ও একক ভাষা, যা তাদের সামাজিক মর্যাদা নির্বিশেষে সকল সদস্যের সমানভাবে সেবা করবে। শ্রেণি ভাষার প্রশ্নটিকে নাকচ করতে গিয়ে স্ট্যালিন ভাষার সর্বশ্রেণিগামিতাকেই সামনে নিয়ে এসেছিলেন।
তবে স্ট্যালিন এ-ও জানান, ভাষা জনগণের সঙ্গে যোগাযোগের উপায় হিসেবে সকল শ্রেণির প্রতি সমদৃষ্টিসম্পন্ন হলেও বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠী ও শ্রেণির জনগণ ভাষার প্রতি সমভাবাপন্ন না-ও হতে পারে। এরকম অবস্থার সৃষ্টি হয়, কেননা মানুষ চায় ভাষাকে নিজস্ব স্বার্থে ব্যবহার করতে এবং তাই বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণি ও গোষ্ঠী ভাষার ওপর প্রয়োগ করার চেষ্টা করে তাদের বিশেষ ভাষাবাক্য, বিশেষ পদবাচ্য, বিশেষ প্রকাশভঙ্গিমা। জনগণ থেকে বিচ্যুত বিত্তবানদের উঁচ্চতর স্তরের ব্যক্তিরা, অভিজাত ও বুর্জোয়ার স্তরভুক্ত ব্যক্তিরা ভাষার বিভিন্ন মানদণ্ড হাজির করে চলেন নিজেদের পৃথকসত্বা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। এভাবেই স্ট্যালিনের মতে, দেখা দেয় বহুল আলোচিত ‘শ্রেণি’ ডায়ালেক্ট, অপভাষা, উঁচু শ্রেণির ভাষা ইত্যাদি। এবং এইসব ডায়ালেক্ট আর অপভাষাগুলি প্রায় সময়ই ভুলবশত সাহিত্যে চালিয়ে দেয়া হয় ভাষা হিসেবে – কখনো অভিজাত অথবা বুর্জোয়া ভাষা হিসেবে, কখনো আবার এর বিপরীতে প্রোলেতারিয়েত কিংবা কৃষকের ভাষা হিসেবে, গণমানুষের ভাষা হিসেবে।
এ ধরণের ডায়ালেক্ট বা উপভাষা ও অপভাষাকে ভাষা হিসেবে দেখতে রাজি হননি স্ট্যালিন। কেননা, তিনি বলেছেন, এ ধরণের ডায়ালেক্ট ও অপভাষার কোনও ব্যাকরণগত পদ্ধতি থাকে না এবং নেই কোনও মৌল শব্দের ভাণ্ডার – এ কারণে তাদের নির্ভর করতে হয়, প্রতিনিয়ত ধার করতে হয় জাতীয় ভাষার ব্যাকরণ ও শব্দের ভাণ্ডারকে। আরও একটি কারণে এগুলিকে স্ট্যালিন ভাষার পর্যায়ভুক্ত করার সম্ভাবনা নাকচ করেছেন। তিনি দেখেছেন, এ ধরণের ডায়ালেক্ট ও অপভাষাসমূহ একটি সংকীর্ণ পরিসরে সীমাবদ্ধ, একটি শ্রেণীর উচুঁ স্তরেই ঘূর্ণায়মান এবং সমগ্র সমাজের মানুষের মধ্যে যোগাযোগের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অনুপযোগী। উপভাষা ও অপভাষাসমূহের স্বাধীন ভাষা হিসেবে বিকাশের প্রচেষ্টা স্ট্যালিনের কাছে মনে হয়েছে ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে, মার্কসীয় অবস্থান থেকে বিচ্যুত হওয়ার প্রবণতা।
বুর্জোয়াদের ভাষা আলাদা, প্রলেতারিয়েতের ভাষা আলাদা এরকম যারা বলতেন, তাদের অন্যতম সহায় ছিল মার্কসের একটি নিবন্ধ ‘সেইন্ট ম্যাক্স’ – যাতে তিনি লিখেছেন, বুর্জোয়াদের ‘নিজস্ব এক ভাষার’ কথা, লিখেছিলেন যে বুর্জোয়াদের ওই ভাষা ‘মধ্যবিত্ত শ্রেণির উৎপাদন’ (ফ্রান্সে, লেখাই বাহুল্য, এই মধ্যবিত্ত শ্রেণিই সংগঠিত করে বুর্জোয়া বিপ্লব)। কিন্তু স্ট্যালিন বুর্জোয়াদের ‘নিজস্ব ভাষা’র অস্তিত্ব নাকচ করে দিয়েছেন, কেননা, তার মতে, এ ধরণের ভাষা বলতে যা বোঝানো হচ্ছে তা ভাষার চৌহদ্দিতে প্রবেশ করেছে ‘বাণিজতন্ত্র ও ফেরিওয়ালার স্পিরিট নিয়ে।’ তিনি লিখেছেন, মার্কসের এ লেখা থেকে যারা উদ্ধৃত করতে ভালবাসেন, তারা একটু এগিয়ে গেলেই দেখতে পেতেন একই নিবন্ধেই মার্কস একক জাতীয় ভাষাসমূহের উত্থানের প্রসঙ্গ স্পর্শ করেছেন, কথা বলেছেন, ‘রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কেন্দ্রিকতার ফলে ডায়ালেক্টসমূহের একটি একক জাতীয় ভাষায় কেন্দ্রীভূত’ হওয়া নিয়ে। মার্কস আলোচনাক্রমে ‘সেইন্ট ম্যাক্স’ লেখাটিতে একক জাতীয় ভাষার আবশ্যকতাকে উচ্চতর পর্যায়ে এবং ডায়ালেক্টকে তার অধীনস্থ নিম্নবর্তী স্তর হিসেবে সনাক্ত করেছেন। এর অর্থ দাঁড়ায় এই যে মার্কস বুর্জোয়াদের ভাষাকে ‘বুর্জোয়াজি বা মধ্যবিত্ত শ্রেণির উৎপাদন’ বলে আসলে সেটির অপভাষাগত দিকটিই তুলে ধরেছেন। স্ট্যালিনের এই বোধগম্যতায় কোনও ভুল নেই যে মার্কস বুঝাতে চেয়েছেন, এই তাদের বাণিজ্যতান্ত্রিক ও ফেরিওয়ালার চেঁচামেচি জাতীয় ভাষা দিয়ে একক জাতীয় ভাষাকে নোংরা করে চলেছে। বুর্জোয়াদের উত্থানের ইতিহাস ও রাজনৈতিক ভূমিকার সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে বুর্জোয়াদের এই ভাষা আর ভাষার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান জাতীয় কিছু মনে হয় না, বরং তার অপভাষাগত দিকই সুস্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে।
শুধু মার্কস নয়, স্ট্যালিনের লেখা থেকে দেখা যাচ্ছে, এঙ্গেল্‌সের একটি লেখাকেও শ্রেণিভাষার সমর্থকরা যুক্তি হিসেবে টেনে নিয়ে আসেন। এঙ্গেল্‌স তার একটি লেখায় ইংল্যান্ডের শ্রমিক শ্রেণির অবস্থা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিখেছিলেন, ব্রিটেনে ‘••• শ্রমজীবী শ্রেণিটি ক্রমান্বয়ে ইংলিশ বুর্জোয়াজির (মধ্যশ্রেণি) থেকে সম্পূর্ণ আলাদা একটি রেস হয়ে উঠছে।’ তিনি লিখেছিলেন, শ্রমিকরা কথা বলছে ওইসব বুর্জোয়াজি বা মধ্যবিত্ত শ্রেণির চেয়ে আলাদা ডায়ালেক্টে, তাদের চিন্তা ও আইডিয়ালসমূহ আলাদা, আলাদা তাদের কাস্টমস ও নৈতিকতার নীতিগুলি, আলাদা হয়ে পড়ছে ধর্মের দিক থেকে, রাজনীতির দিক থেকে। এঙ্গেলসের এই কথাগুলিকেই ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয় সোভিয়েত ইউনিয়নে, দাঁড় করানো হয় শ্রেণিভাষার সপক্ষের যুক্তি হিসেবে। এঙ্গেলসের এই বাক্যগুলিকে ভিত্তি করে তখন দাবি করা হয়, তার মানে তিনি একটি সাধারণ, জাতীয় ভাষার প্রয়োজনীয়তাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং ভাষার ‘শ্রেণিচরিত্রে’র কথাই বলে গেছেন। কিন্তু এঙ্গেল্‌সের বাক্যগুলি মন দিয়ে পড়লেই দেখা যায় তিনি এখানে ভাষার কথা বলেননি, ডায়ালেক্টের কথা বলেছেন। আর এর পেছনে এই উপলব্ধি কাজ করেছে যে, জাতীয় ভাষার প্রশাখা হওয়ার কারণে ডায়ালেক্ট বা উপভাষা জাতীয় ভাষার স্থান অধিকার করতে পারে না। তা ছাড়া এই পরিস্থিতি বর্ণনার সময় এঙ্গেলসের মূল বিবেচনা ভাষা ছিল না, ছিল মূলত শ্রেণিচিন্তা, শ্রেণিআদর্শ, নৈতিকতা, ধর্ম ও রাজনীতি।
একইভাবে, শ্রেণিভাষাপন্থীরা যুক্তি খোঁজার চেষ্টা করেছেন ভ• ই• লেনিনের লেখা থেকে, পল লাফার্গের লেখা থেকে। দাবি করা হয়, পল লাফার্গ তাঁর প্যাম্পলেট ‘দ্য ফ্রেঞ্চ ল্যাঙ্গুয়েজ বিফোর অ্যান্ড আফটার দ্য রেভ্যুলুশান ’-এ ভাষার শ্রেণিচরিত্র সনাক্ত করেছেন। লাফার্গের ওই প্যাম্পলেটও বিশ্লেষণ করেন স্ট্যালিন। দেখান, লাফার্গ প্রকারান্তরে একটি সাধারণ ভাষার অস্তিত্ব ও প্রয়োজনীয়তার কথাই বলে গেছেন। যারা তাঁকে ভাষা বিতর্কের মধ্যে টেনে এনেছিলেন, তারা এটি বিবেচনায় নেননি যে, লাফার্গ কথা বলেছেন অভিজাতদের ভাষাদম্ভ এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের ‘অপভাষা’ নিয়ে। ভাষা ও অপভাষার মধ্যেকার পার্থক্য নিয়ে লাফার্গ আগ্রহ দেখাননি। ভাষার কৃত্রিমতা নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। লাফার্গ তাঁর লেখায় ব্যবহূত উদ্ধৃতিগুলি দিয়ে তুলে ধরেছিলেন একটি বিশেষ সময়কে, যখন ইংল্যান্ডে সামন্ত শ্রেণির মানুষরা কথা বলত ফরাসি ভাষায়, যদিও ইংরেজ জনগণ কথা বলতো ইংরেজি ভাষাতে। কিন্তু এর মানে এই দাঁড়ায় না যে শোষকের ভাষা আর শোষিতের ভাষা আলাদা। যুক্তি হিসেবে এই পরিস্থিতিকে উপস্থাপনের চেষ্টা তাই নাকচ করে দিয়েছিলেন স্ট্যালিন। বলেছিলেন তিনি, এটি কোনও যুক্তি নয়, এটি বরং অ্যানিকডট। কেননা প্রথমত, সব সামন্তই তখন ফরাসি ভাষায় কথা বলতেন না, কোর্ট এবং কাউন্টির আসনগুলির ইংরেজ সামন্ত লর্ডদের একটি ক্ষুদ্র উচ্চতর অংশই কেবল ফরাসি ভাষায় কথা বলতেন। দ্বিতীয়ত, যে ভাষায় তারা কথা বলতেন, সেটি কোনও বিশেষ ‘শ্রেণিভাষা’ নয়, বরং সেটি ফরাসি জনগণের সাধারণ ভাষা। তৃতীয়ত, সামন্তদের ব্যবহূত ওই ফরাসি ভাষা কালক্রমে সমগ্র ইংরেজ জনগণের সাধারণ ভাষার মধ্যে কোনও গভীর চিহ্ন না রেখেই হারিয়ে গেছে। এই ক্ষেত্রে রাশিয়ার উদাহরণও স্ট্যালিনের পক্ষে ছিল। কেননা এক সময় রাশিয়ার অভিজাতরাও সমাজের বিশেষ উঁচু স্তরে এবং জারের কোর্টে শখ করে ফরাসি ভাষায় কথা বলেছেন। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, ক্ষমতাধরদের ভাষা হওয়াতে তখন রাশিয়ায় সর্বপ্রচলিত রুশ ভাষা তখন অবদমিত হয়েছিল, ফিকশনে পরিণত হয়েছিল এবং ‘শ্রেণি ভাষা’ই হয়ে উঠেছিল বাস্তবতা।
শ্রেণিভাষা, শ্রেণিব্যাকরণ এইসব প্রত্যয় দিয়ে নিকোলাই মারের অনুসারীরা ভাষাসংক্রান্ত যে-সংশয়াচ্ছন্নতা তৈরি করেছিলেন, তার সপক্ষে আরও এক যুক্তি ছিল লেনিন বর্ণিত বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়েত সংস্কৃতি। বুর্জোয়া আর সর্বহারার সংস্কৃতি ভিন্ন সংস্কৃতি – এই উপসংহারের সূত্র ধরে শ্রেণিভাষাপন্থীরা তখন বলেছিলেন, পুঁজিবাদের অধীনে জাতীয় সংস্কৃতির শ্লোগান একটি জাতীয়তাবাদী শ্লোগান, ঠিক তেমনি যারা জাতীয় ভাষা বা ভাষাসমূহের পক্ষে কথা বলছে তারাও প্রকৃতপক্ষে জাতীয়তাবাদের ঘেরটোপে বন্দি হয়ে রয়েছেন। কেননা বুর্জোয়া ও সর্বহারার সংস্কৃতি যেমন ভিন্নরকম, তাদের ভাষাও ভিন্নরকম। এ যুক্তির উত্তর খুঁজতে গিয়ে স্ট্যালিনকে যেতে হয়েছিল লেনিনেরই লেখার কাছে, যাতে তিনি লিখেছেন :
ভাষা হলো মানুষের যোগাযোগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপায়। একটি মুক্ত ও বৃহৎ জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন আলাদা আলাদা শ্রেণির বিভিন্ন অংশের জন্যে, আধুনিক পুঁজিবাদের উপযোগী প্রকৃতই মুক্ত ও ক্রমবর্ধিষ্ণু বাণিজ্যিক যোগাযোগের জন্যে ভাষার ঐক্য এবং এর অব্যাহত বিকাশ একটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত পূরণ করে।
আর এ কারণেই নাজিপন্থী বানডিস্টরা যখন লেনিনকে জাতীয় ভাষার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার এবং সংস্কৃতিকে ‘না-জাতীয়’ হিসেবে দেখার জন্যে অভিযুক্ত করেছিলেন, তখন লেনিন খুব জোর দিয়ে প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, জাতীয় ভাষার বিরুদ্ধে নয়- তিনি সংগ্রাম করছেন বুর্জোয়া সংস্কৃতির বিরুদ্ধে। জাতীয় ভাষা বা ভাষাসমূহের প্রয়োজনীয়তা ছিল তাঁর কাছে তর্কাতীত একটি বিষয়।
এমনকি খোদ স্ট্যালিনকেই যুক্তি হিসেবে উত্থাপন করা হয়েছিল জ্যাফটিক তত্ত্বানুসারীদের পক্ষ থেকে। কমিউনিস্ট পার্টি অব সোভিয়েত ইউনিয়ন (বলশেভিক)-এর ১৬তম কংগ্রেসে দেয়া স্ট্যালিনের একটি লাগসই বক্তব্য খুঁজে এনেছিলেন তাঁরা। ওই বক্তব্যে স্ট্যালিন বলেছিলেন, যখন সমাজতন্ত্র সুসংহত হবে এবং প্রাত্যহিক জীবনের অংশ হয়ে উঠবে তখন জাতীয় ভাষাগুলিও অপরিহার্যভাবে একটি অভিন্ন সাধারণ ভাষায় পরিণত হবে, যেটি, নিঃসন্দেহে রুশ অথবা জার্মান না হয়ে নতুন কোনও ভাষাই হবে। এর উত্তরে স্ট্যালিন পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে মার্কস এবং এঙ্গেলসের বিভিন্ন উপসংহারও যে নাকচ হয়ে গেছে, তা তুলে ধরে বলেছিলেন, সোভিয়েত রাশিয়ার রুশ, ইউক্রেনিয়, বেলারুশিয় এবং অন্যান্য সব সংস্কৃতিই এখন কনটেন্টের দিক থেকে সমাজতন্ত্রী কিন্তু ফর্মের দিক থেকে, উদাহরণত ভাষার দিক থেকে জাতীয়।

চার
ভাষাচিন্তাকে সমৃদ্ধ করতে স্ট্যালিন যে ভারত, চীন ও তৎকালীন পাকিস্তানের দিকেও দৃষ্টি দিয়েছিলেন সেটি জানা যায়, স্ট্যালিন ও ভারতের রাষ্ট্রদূতদের মধ্যে ১৯৫০ সালের কয়েকটি কথোপকথনের বিবরণ থেকে। ভারতের রাষ্ট্রদূত সারভেপল্লী রাধাকৃষ্ণন ১৫ জানুয়ারি ১৯৫০-এ স্ট্যালিনের সঙ্গে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের আন্তঃসম্পর্ক ও বিশ্বের পরাশক্তিগুলির স্নায়ুযুদ্ধের ক্ষেত্রে ভারতের নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়ে লন্ডনে নেহেরুর পুনর্ঘোষণা সম্পর্কে আলোচনা করতে যান। ওই সময় স্ট্যালিন কথা প্রসঙ্গে ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্ক সম্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে পাকিস্তানের অধিবাসীদের ভাষাপ্রসঙ্গ তোলেন। তিনি ভারতের ভাষা নিয়েও কথা বলেন। জানতে চান, ভারতের ভাষাগুলির মধ্যে কোনটির বেশি প্রাধান্য। হিন্দি একটি ফোনেটিক ভাষা- তা জেনে স্ট্যালিন আশ্বস্ত হন এবং জানান, হায়রোগ্লিফিক ভাষা হলে চীনের জনগণের মতো খবরের কাগজ পড়া শিখতেই পাঁচ বছর লেগে যেত! রাধাকৃষ্ণন তার কূটনৈতিক বিবরণীতে এ সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু লেখেননি। কৃষ্ণনের বিবরণ থেকে জানতে পারছি, আলোচনার শেষদিকে গিয়ে তিনি আবারও জানতে চাইছেন, ভারতের আদালতের ভাষার সঙ্গে ভারতীয় কোনও ভাষার সাদৃশ্য বা সম্পর্ক আছে কি না।
১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৩-তে ভারতের নতুন রাষ্ট্রদূত কে পি এস মেনন যখন স্ট্যালিনের সঙ্গে দেখা করতে যান, তখন স্ট্যালিন আবারও কথা তোলেন ভারত ও তৎকালীন পাকিস্তানের ভাষা নিয়ে। স্ট্যালিন মেননের কাছে জানতে চান, ভারতের প্রধান ভাষা কোনটি- উর্দু না হিন্দি (স্ট্যালিন অবশ্য বলেছিলেন ‘হিন্দু’)? সবগুলি ভাষাই একই উৎস থেকে আসা কি না? আর কিভাবে সেগুলির ক্ষেত্রে পৃথক পৃথক বিকাশ ঘটেছে? আলোচনার শেষদিকে পাকিস্তান প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে স্ট্যালিন আবার ভাষা প্রসঙ্গ টেনে আনেন। তিনি মেননের কাছে জানতে চান, এটি কি সত্যি যে পাকিস্তান তাদের একটি নিজস্ব ভাষার উদ্ভাবন ঘটিয়েছে? জবাবে মেনন তাকে বলেন, উর্দু ভারতের ভাষাগোত্রের একটি ভাষা হিসেবেই বিকশিত হয়েছে, কিন্তু পাকিস্তান এতে অনেক ফারসি ও আরবি শব্দ যুক্ত করেছে। শুনে স্ট্যালিন বলেছিলেন, ‘তা হলে এটি সত্যিকারের জাতীয় ভাষা হতে পারে না।’ স্ট্যালিনের ভাষাসংক্রান্ত কৌতূহল মেননের কাছে পুরোপুরি খাটিই মনে হয়েছিল। কিন্তু এক বছর আগে ভাষা নিয়ে পাকিস্তানে যে রক্তঝরা আন্দোলন হয়েছিল, কথোপকথনের এই বিবরণ থেকে মনে হয়, তা তাদের আলোচনায় উঠে আসেনি।

তবে ভাষা সম্পর্কে স্ট্যালিনের ওই সময়ের অবস্থান থেকে বোঝা যায়, তত্ত্বগতভাবে তিনি পূর্ববাংলার ভাষা আন্দোলনকারী জনগণেরই পক্ষে ছিলেন। স্ট্যালিনের পর ভাষাবিজ্ঞান আরও বিকশিত হয়েছে, সমৃদ্ধ হয়েছে। যেমন, দেরিদা তাঁর রুশো ও লেভি-স্ট্রাউস পাঠের মধ্যে দিয়ে, তাঁদের তীক্ষ্ণ ও কোনও কোনও সময় বিদ্রুপাত্মক সমালোচনার মধ্যে দিয়ে অবনির্মাণবাদী এক কৌশলের বিকাশ ঘটান। তাঁর বিশ্লেষণাত্মক সমালোচনার মুখে পড়েন প্রতীতীবাদ বা ফেনোমেনোলোজির দার্শনিক এডমান্ড হুর্সেল এবং ফার্ডিনান্ড দ্য স্যসুরও। অবনির্মাণবাদী মতাদর্শের রাজনৈতিক রক্তপ্রবাহ লুকিয়ে রেখে দেরিদাকে পশ্চিমে বাজারজাত করা হয় সুপরিকল্পিতভাবে। কিন্তু ভাষাকে প্রতিনিয়ত সময়ের ফাক গলে বিচরণে সক্ষম অস্থির বিচিত্রময়ী হিসেবে উপস্থাপন করায়, অতীতের সত্যরূপ হিসেবে ইতিহাসকে প্রশ্নবিদ্ধ করায় অবনির্মাণবাদী মতাদর্শ খুব দ্রুতই প্রশ্নবিদ্ধ হয়। বিশ্লেষণপ্রক্রিয়ায় প্রাক-সক্রেটিস ও সক্রেটিস যুগের সফিস্টদের সঙ্গে অবনির্মাণবাদীদের গভীর মিল, দার্শনিক ঐতিহ্যকে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে অস্বীকার করার ক্ষেত্রে তাদের অভিন্নতা অচিরেই তাদের ভিত্তি টলোমলো করে দেয়। এইভাবে নয়া সমীক্ষা বা নিউ-ক্রিটিসিজমের ব্যর্থতা ও সংশয়াচ্ছন্নতার পর অবনির্মাণবাদকে ঘিরে তত্ত্বের জগতে যে আশাবাদ জেগে উঠেছিল, তাও মিলিয়ে যায়। ইতিহাসের চোখে শিল্পকে না দেখে, শিল্পের চোখে ইতিহাসকে দেখার এইসব অস্বাভাবিকত্ব সমাজের একটি অংশকে গ্রাস করলেও সত্যের সন্ধানে নিয়ত মানুষকে কব্জায় নিতে পারেনি।
আশার কথা, স্ট্যালিন ইতিহাসের চোখেই সমগ্র বিষয়টিকে দেখতে চেয়েছেন। তাই নিজের পূর্বাবস্থানকেও পরিত্যক্ত ঘোষণা করতে দ্বিধা করেননি। ভাষাবিজ্ঞানের বিশেষ কিছু দিক পর্যালোচনা করলেও ভাষার সামগ্রিকতার সঙ্গে এসব দিক অবিচ্ছেদ্য হওয়ায় স্ট্যালিনের পর্যালোচনা এখনো প্রাসঙ্গিক। স্ট্যালিন যেমন দেখেছিলেন, এখনও আমরা দেখি, ভাষাবিতর্কের বিভিন্ন পর্যায়ে আসলে ভাষার প্রতি বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠী ও শ্রেণির জনগণের সমভাবাপণ্ন না হওয়াটাই প্রধান সমস্যা হয়ে ওঠে। ‘জনগণের ভাষা’ ‘মুখের ভাষা’ ‘সাহিত্যের ভাষা’ ইত্যাদি বিভিন্ন কথিত পদবাচ্যের যে-বিতর্ক আমরা বাংলাদেশেও দেখতে পাই, তার উৎসও ভাষার প্রতি এই সমমনোভাবাপণ্ন না হওয়া। এবং এর পেছনে কাজ করে কোনো কোনো সাহিত্যিকের বিতর্ক সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে ইতিহাসের পাতায় নাম লেখানোর মারাত্মক এক প্রবণতা। তাই আমরা দেখি, প্রচলিত শব্দভাণ্ডারকেই ভাষার মূল গাঠনিক উপাদান হিসেবে বিবেচনা করে, কখনো জনগণের ভাষায় বক্তব্য তুলে ধরার নামে, কখনো আবার মুখের ভাষায় সাহিত্য রচনার নামে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হয়, ভাষাকে উপভাষা অথবা অপভাষাক্রান্ত করে তোলা হয়। এ ধরণের প্রচেষ্টা কারও কারও ক্ষেত্রে বিষয়টি না বোঝার ফল, কারও ক্ষেত্রে নেহাৎই চটকদার ডায়ালেক্ট ব্যবহারের নামে জনপ্রিয় হওয়ার কিংবা এর মধ্যে দিয়ে যেন-তেনভাবে এক বিতর্ক তৈরি করে নিজেদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসার অপচেষ্টা, কারও কারও ক্ষেত্রে সুপরিকল্পিতভাবে ভাষার ক্ষেত্রে নৈরাজ্য সৃষ্টির প্রচেষ্টা।
আমরা দেখেছি, শব্দের ভাণ্ডার বা ভোকাব্যুলারি ভাষাকে গঠন করে না, যেমনটি স্ট্যালিন বলেন, শব্দের ভাণ্ডার বরং নির্মাণ করে ভাষার ম্যাটেরিয়াল। একটি ভাষার শব্দভাণ্ডার তখনই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, যখন তা ব্যাকরণের নিয়ন্ত্রণে আসে,- এই ব্যাকরণই নির্ধারণ করে বাক্য বা বাক্যসমূহে বিভিন্ন শব্দের সংমিশ্রন ঘটবে কোন নিয়মে, শব্দসমূহের অর্থকে বিশেষিত করা হবে কোন নীতির ভিত্তিতে। এই নীতিমালাগুলিই ভাষাকে সক্ষম করে তোলে সম্মিলিত ও তাৎপর্যপূর্ণ কাজে।
ব্যাকরণ হলো, স্ট্যালিনের ভাষায়, সুদীর্ঘ সময় ধরে মানুষের মনের মধ্যে উপস্থাপিত বিমুর্তায়ন প্রত্র্নিয়ার ফসল। এ কারণে স্ট্যালিন এর সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন জ্যামিতির সঙ্গে। ভাষা ও শব্দের ভাণ্ডারের নিরবচ্ছিন্ন পরিবর্তনের কথা তিনি অস্বীকার করেননি বটে, কিন্তু ভাষার ওপর প্রভূত্ব তৈরির জন্যে, ভাষাকে ব্যবহার করে নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধির জন্যে বিশেষ গোষ্ঠী যে অপভাষা বা সাধারণ জনগোষ্ঠী বিচ্ছিন্ন ডায়ালেক্ট-এর অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে থাকে, সেটি স্পষ্টই বলেছেন। তাঁর এই পর্যবেক্ষণকে ভাঙচুর করে বলা যায়, কোনও সাহিত্যিক কোনও ডায়ালেক্ট অথবা জারগন সফলভাবে ব্যবহার করতে সক্ষম হলে তা ভাষার শব্দভাণ্ডারে যুক্ত হতে পারে, কিন্তু তা জীবন্ত শব্দ হিসেবে ব্যবহূত নাও হতে পারে। শক্তিমান সাহিত্যিক কোনও ডায়ালেক্টকে সামগ্রিক সৃষ্টির পরিপ্রেক্ষিতে জীবন্ত করে তুলতে পারেন, মানুষ কিছুদিন তা বলাবলিও করতে পারে রাস্তাঘাটে, আড্ডায় আর পানশালাতে; কিন্তু তার মানে এই নয় যে তা সমগ্র জনগোষ্ঠীতে সুদীর্ঘ সময়ের জন্যে ব্যবহারোপযোগী হয়ে উঠবে। দুঃখজনক ব্যাপার হলো, ডায়ালেক্টকে এখন সাহিত্যে কিংবা নাটকে খুব কমই ন্যায়সঙ্গতভাবে এবং শৈল্পিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। দেশে কর্পোরেট পুঁজির দাপট ক্রমশই বাড়ছে, কর্পোরেট সে পুঁজির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষকে কাতুকুতু দিয়ে জনপ্রিয় হওয়ার স্বভাব আর প্রবণতাও বাড়ছে, তারুণ্যকে এই কাতুকুতু দেয়া-নেয়ার প্রক্রিয়ায় শামিল করার জন্যেও চলছে নিত্যনতুন বিচিত্র আয়োজন। আর এই আয়োজনকে বৈধতা দেয়ার জন্যে দোহাই দেয়া হচ্ছে জনগণের ভাষার – যদিও জনগণের সেই ডায়ালেক্টকে, তাদের জীবনযাত্রাকে গভীর তলদেশ থেকে তুলে আনার লক্ষ থেকে নয়, বরং ব্যবহার করা হচ্ছে মধ্যবিত্তের ড্রয়িংরুমে বসে হাসাহাসি করার করার কাজে, অবসর বিনোদনের কাজে। সাহিত্যে কিছু আঞ্চলিক শব্দ বা ব্যবহারিক জীবনের কিছু শব্দ যুক্ত করলে, ক্রিয়াপদকে বিচিত্র এক কথ্যরীতিতে লিখলে কিংবা নিজের পছন্দ অনুযায়ী একটি বানানরীতি ব্যবহার করলেই ভাষাকে পাল্টে দেয়া যায় না। এ সবের মধ্যে দিয়ে শ্রেণিবোধের প্রকাশ ঘটাচ্ছি, জনগণের ভাষাকে সাহিত্যে গ্রহণযোগ্য করে তুলছি, নতুন ভাষা সৃষ্টি করছি বলে আমরা আত্মতৃপ্তিতে ভুগতে পারি – কিন্তু ভাষার তাতে কোনও কিছুই আসে যায় না, ভাষা তাতে পাল্টেও যায় না। কিছুদিনের জন্যে হয়তো সে অস্বস্তিতে ভোগে, অস্বস্তির কারণে দাপাদাপি করে, আর সেই দাপাদাপিকে আমরা কেউ কেউ আবার ‘এই ভাষা দারুণ গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে’ ভেবে তাদের পদানুসরণ করার জন্যে ঝাপিয়ে পড়ি; কিন্তু, স্ট্যালিন যে বলেছেন, ভাষা অবকাঠামো থেকে রেডিক্যালি আলাদা- শেষ পর্যন্ত তাই দেখা যায়, ভাষা এত রেডিক্যাল যে খুব সহজেই ওইসব অস্বস্তি-উৎপাত হজম করে ফেলেছে অথবা সেসব ফেলে দিয়েছে পরিত্যক্ত বর্জ্য হিসেবে।

সুত্রঃ  http://nirmanblog.com/imtiar/5874


কমরেড স্তালিনের দুর্ধর্ষ প্রত্যাবর্তন

Stalin

সঙ্কটগ্রস্ত পুঁজিবাদের অবস্থাটা হলো সেই কাদায় আটকে যাওয়া পাখির মতো। কাদায় জড়ানো ল্যাজ ছাড়াতে গিয়ে ঠোঁট ডুবে যাচ্ছে কাদায়, আবার কাদা থেকে ঠোঁট তুলতে গেলে কাদায় জড়িয়ে যাচ্ছে ল্যাজ।”      — স্তালিন

স্তালিন ৫লক্ষ ১৯হাজার ১৭। নেভেস্কি ৫লক্ষ ২৪হাজার ৫৭৫।

মাত্র সাড়ে পাঁচ হাজার কম ভোট পেয়ে স্তালিন তৃতীয়। নেভেস্কি শীর্ষে।

আসলে স্তালিন এক নম্বরেই থাকতেন। যদি না ছ’মাস ধরে দেশজুড়ে চলা এই ভোটের একেবারে শেষ মুহূর্তে অন্য কাউকে ভোট দেওয়ার জন্য সংগঠকরা আবেদন না করতেন। এবং স্তালিন এক নম্বরে ছিলেনও। একবার নয়, দু’-দু’বার। যদিও, শেষে সবাইকে বিস্মিত করে, সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়ে প্রথম হন ত্রয়োদশ শতকের রুশ যুবরাজ আলেকজান্ডার নেভেস্কি। যাকে আজকের রাশিয়া প্রায় চেনে না বললেই চলে। নেভেস্কির পিছনে ছিল আজকের ক্রেমলিন। ছিল পুতিন, মেদভেদেভের সমর্থন। তাঁকে জাতীয় নায়ক হিসেবে প্রচার করে ক্রেমলিন। লক্ষ্য ছিল রাজতন্ত্রকে প্রচারের আলোয় নিয়ে আসা। দু’নম্বরে ইয়োটর স্টলিপিন। বিশ শতকের গোড়ার সময়ের প্রধানমন্ত্রী, যিনি কাজ করেছেন শেষ জার দ্বিতীয় নিকোলাসের আমলে, পুতিনের কাছে যিনি ‘রোল মডেল।’

তবু স্তালিন তৃতীয়। কুড়ি বছর আগে, বার্লিনের প্রাচীর ভাঙার দিন রাশিয়ার মহান ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের তালিকায় এই স্তালিনই ছিলেন দশ নম্বরে। আর আজ, মানুষের রায়ে ‘রাশিয়ার সর্বকালীন সেরা নেতৃত্বের’ তালিকায় স্তালিন উঠে এসেছেন তিন নম্বরে। পেয়েছেন ৫লক্ষের ওপর ভোট।

ছ’মাস ধরে পঞ্চাশ লক্ষের বেশি মানুষ ফোনে এবং ইন্টারনেটে তাঁদের এই মতামত দেন। রাশিয়ার মানুষ বেছে নেন প্রথমে পাঁচশ জনের মধ্যে পঞ্চাশ জনকে। সেখান থেকে শীর্ষ বাছাই বারো জনকে।

এবং এই বারোতে আছেন ভ্লাদিমির লেনিনও। ছ’নম্বরে।

তালিকায় কোনও জীবিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন না। স্তালিনকে ‘স্বৈরাচারী’ বলা নোবেল জয়ী ভাড়াটে লেখক আলেকজান্ডার সলঝনেৎসিনের মৃত্যুর পর তাঁকে যুক্ত করা হলেও, খুব সামান্যই ভোট পান তিনি। পঞ্চাশে থাকলেও, ১২’তে আসার আগেই হারিয়ে যান নিকিতা ক্রুশ্চেভ থেকে বরিস ইয়েলৎসিন।

আরও তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো, ভোটারদের অধিকাংশ ছিলেন তরুণ, যাঁরা স্তালিনকে দেখেননি।

বছর ছয়েক আগের শীত। ২১ডিসেম্বর, ২০০৯। স্তালিনের ১৩০তম জন্মবার্ষিকী। স্তালিনের স্তুতি করে লেখা একটি স্তবক নতুন করে বসানো হয়েছে মস্কোর অন্যতম ব্যস্ত মেট্রো স্টেশনের প্রবেশ হলে। ঢেলে সাজানো হয়েছে ১৯৪৯তে তৈরি কুরস্কায়া স্টেশনের রোটান্ডা। তাতে লেখা হয়েছে ১৯৪৪এ সোভিয়েত জাতীয় সঙ্গীতের একটি লাইন, ‘স্তালিন আমাদের শিখিয়েছেন মানুষের প্রতি আনুগত্য, তিনি আমাদের উদ্দীপ্ত করেছেন শ্রমের জন্য, বীরত্বের জন্য।’

স্তালিনের মৃত্যুর ৫৯বছর। ক্রুশ্চেভ তাঁর বিরুদ্ধে ‘ব্যক্তিপূজার’ অভিযোগ তোলার পর, রাতারাতি রাশিয়ার রাস্তা, সরকারী দপ্তর থেকে মুছে ফেলা হয় স্তালিনের নাম, তাঁর ছবি। রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে চিরস্থায়ী করে রাখা তাঁর মরদেহ সরিয়ে দেওয়া হয় ক্রেমলিনের মুসোলিয়ামে ভ্লাদিমির লেনিনের পাশ থেকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অসাধারণ বীরত্ব ও শৌর্যের বিপুল খ্যাতি সত্ত্বেও ছেঁটে ফেলা হয় স্তালিনগ্রাদ শহরের নাম। ভেঙে ফেলা হয় স্তালিনের বহু স্মৃতিসৌধ।

‘ফিরিয়ে দিতে হবে স্তালিনগ্রাদের নাম।’ ঠিক এইমুহূর্তে ভলগার কোলে একসময়ের স্তালিনগ্রাদ, আজকের ভলগোগ্রাদে চলছে সই সংগ্রহ অভিযান। সংগ্রহ করতে হবে অন্তত ১,০০,০০০সই। তাহলেই বিল আনা যাবে সংসদে। রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি (সি পি আর এফ)-র কর্মীরা তাই যাচ্ছেন বাড়ি। রাশিয়ায় কমিউনিস্ট পার্টির যা শক্তি, তার চেয়ে অনেক বেশি গণভিত্তি রয়েছে এই শহরে।

লালফৌজের সবচেয়ে গৌরবজনক লড়াই এই স্তালিনগ্রাদে। নেতৃত্ব মার্শাল জুকভ। শুরুতে নাৎসিরা শতকরা ৭৫ ভাগ অংশই দখল করে ফেলে। শেষে স্তালিনগ্রাদের এক বীরত্বপূর্ণ লড়াই। বিজয়।

‘আমি নিশ্চিত একদিন ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবেই। স্তালিনগ্রাদের বিজয়ের পর দুনিয়ার প্রায় সব দেশে রাস্তা, স্কোয়ার, বুলেভার্ডের নামকরণ করা হয়েছে স্তালিনগ্রাদ। সেকারণে ভলগোগ্রাদকে তার প্রকৃত নাম — স্তালিনগ্রাদ ফিরিয়ে দেওয়া উচিত।’ বলেছেন সি পি আর এফের চেয়ারম্যান গেন্নাদি জুগানভ। স্তালিনগ্রাদ যুদ্ধের বর্ষপূর্তিতে, রাউন্ড টেবিল বৈঠকে। ‘ইউরোপের বহু শহরই যে স্তালিনগ্রাদের নায়ককে অমর করে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা আদৌ কোনও দুর্ঘটনা নয়।’ বলেছেন টেলিভিশন ভাষ্যকার ভ্লাদিমির রুদাকভ। ব্রাসেলস, প্যারিসে রয়েছে স্তালিনগ্রাদ স্ট্রিট। ‘অথচ রাশিয়ার মানচিত্রে এই নাম অনুপস্থিত গত পঞ্চাশ বছর ধরে। ইতিহাসের কৌতুকই বটে!’ সি পি আর এফের নিকোলাই কার্তিনোভা বলেছেন, রাশিয়ায় সবাই স্তালিনকে ভালোবাসেন এমন নয়। ‘তবে অধিকাংশই মনে করেন, স্তালিন যা করেছিলেন, তার মধ্যে নেতিবাচক দিকগুলির চেয়ে ইতিবাচক দিকই বেশি।’

আজ আবারও দাবি উঠছে স্তালিনকে ফেরানো হোক ক্রেমলিনে। জাবত্রাঁ পত্রিকার মুখ্য সম্পাদক আলেকজান্ডার প্রোখানভ যেমন বলেছেন, ‘স্তালিনের থাকা উচিত ক্রেমলিনেই। তাঁর প্রতি আজ বিপুল আগ্রহ। কারণ, আজকের নেতাদের প্রতি মানুষ আস্থা হারিয়েছেন। শক্তিশালী ও প্রাজ্ঞ নেতার অভাবে মানুষ আবার পিছনের দিকে তাকাতে বাধ্য হচ্ছেন, যখন দেশে ছিল মহান নেতৃত্ব, জনগণের প্রকৃত জনক। এবং স্তালিন তাঁদের মধ্যে প্রথম।’ টেলিভিশনের ডাকসাইটে সঞ্চালক নিকোলে প্রোজদভ বলেছেন, ‘স্তালিন একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব। বইয়ে তাঁর ভূমিকার বস্তুগত মূল্যায়ন হওয়া উচিত।’ আজ আবার বইয়ের দোকানে স্তালিন ও তাঁর সময়কে নিয়ে লেখা বইয়ের ভিড়। এবং অধিকাংশই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে লেখা। প্রাদেশিক শহরগুলিতে মেরামত করা হচ্ছে স্তালিনের মূর্তি। একসময়ের স্তালিনগ্রাদ, আজকের ভলগোগ্রাদে প্রথম বেসরকারী জাদুঘরের নাম রাখা হয়েছে স্তালিনের নামে।

মস্কোর রাস্তায় ফের বসানো হয়েছে আশি ফুট উঁচু ইস্পাতের তৈরি সোভিয়েত আমলের সবচেয়ে পরিচিত অসাধারণ ভাস্কর্য। সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার মুখ। হাতে কাস্তে হাতুড়ি নিয়ে ‘শ্রমিক ও যৌথ খামারের কৃষক রমণীর’ দৃপ্ত পদক্ষেপ। স্তালিন পুরস্কার পাওয়া অনন্যসাধারণ স্থাপত্য। পার্টির মুখপত্র প্রাভদা পত্রিকায় সি পি আর এফের অন্যতম শীর্ষ নেতা ইভান মেলিনিকভ বলেছেন, ‘এই স্মারক-সৌধটির ঐতিহাসিক তাৎপর্য বিপুল। এবং অবশ্যই আমরা খুশি। মস্কো শহরের কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ। তবে অন্যদিকটিও ভুললে চলবে না। এটি আসলে শ্রম ও শ্রমিকের স্বীকৃতি। বহু শতাব্দী ধরে শোষণের পর সোভিয়েত ছিল শ্রম ও শ্রমিকের পক্ষে। এখন রাষ্ট্রের চরিত্রের পরিবর্তন হয়েছে। শ্রম ও শ্রমিকের ভূমিকার পরিবর্তন হয়েছে। স্মারক সৌধটি ফিরেছে, কিন্তু সে যুগ এখনও ফিরে আসেনি।’

স্তালিন দেবদূত ছিলেন না। ছিলেন না কোনও অবতার।

স্তালিন মানুষ ছিলেন। এটা ঠিক, কিছু ভুল-ভ্রান্তি তাঁরও ছিল। এবং এই ভুলভ্রান্তি, ব্যক্তিপূজাকে আড়াল করা নয়। বরং তার থেকে ভবিষ্যতের শিক্ষা নেওয়াই মার্কসবাদীদের কাজ। কিন্তু তা করতে গিয়ে তার ফাঁক দিয়ে মূল বিষয়টি যেন হারিয়ে না যায়।

স্তালিন মানে, ট্রটস্কিবাদকে পরাস্ত করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার তত্ত্বকে বাস্তবে রূপায়িত করা। স্তালিন মানে, স্থায়ী বিশ্ববিপ্লব না হলে কোনও একটি দেশে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা গঠন অসম্ভব — লিঁও ট্রটস্কির এই তত্ত্বকে পরাজিত করে একটি দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তাঁর অবিস্মরণীয় অবদান।

স্তালিন মানে, একটি অনগ্রসর কৃষিপ্রধান, সামন্তবাদী ও জারতন্ত্রের শোষণে শোষিত, বঞ্চিত, রিক্ত রাশিয়াকে শিল্পে, কৃষিতে, শিক্ষা, বিজ্ঞানে পুঁজিবাদী দেশগুলির সমকক্ষ গড়ে তোলা। কোনও কোনও ক্ষেত্রে পুঁজিবাদী দেশগুলির চেয়েও উন্নত অবস্থায় নিয়ে আসার মহান কৃতিত্ব।

স্তালিন মানে, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের শক্তিশালী অর্থনৈতিক বিকাশ। গত শতকের তিনের দশকের গোড়ায়, মহামন্দায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদী শক্তির যখন শ্বাসরোধ হওয়ার অবস্থা, তখন স্তালিনের সোভিয়েত ইউনিয়ন অর্থনৈতিক বিকাশে বিশ্বের মধ্যে প্রথম স্থানে। এবং এটা নেহাতই কাকতালীয় ছিল না। বরং, এটি ছিল দু’টি অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মতাদর্শগত ভিন্নতার অনিবার্য প্রতিফলন। স্তালিনের সোভিয়েতে অর্থনীতি ছিল পরিকল্পিত অর্থনীতির ভিত্তিতে সমাজতন্ত্র। আর এই বিকাশ শুধু পরিমাণগত বৃদ্ধির কারণেই নয়, অর্জিত হয়েছিল অর্থনীতির গুণগতমান উন্নয়নের কারণেও। যে ভিতের নকশা তৈরি করেছিলেন স্বয়ং স্তালিন।

মহামন্দার চার বছর আগেই ১৯২৫এ, সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির চতুর্দশ কংগ্রেসে স্তালিন বলেছিলেন, ‘অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর, স্বাধীন এবং দেশীয় বাজারের ওপর ভিত্তি করে আমাদের দেশকে তৈরি করা উচিত… আমাদের অর্থনীতি আমাদেরই নির্মাণ করা উচিত, যাতে আমাদের দেশ পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার লেজুড় না হয়, পুঁজিবাদী উন্নয়নের সার্বিক প্রকল্পের মধ্যে এটি ছিল না, তার সহযোগী সংস্থাগুলি আমাদের অর্থনীতিকে উন্নত করেনি, যেমন করেছে বিশ্ব পুঁজিবাদে, এটি ছিল আমাদের দেশের শিল্প ও কৃষি অর্থনীতির জোটবন্ধনের ভিত্তিতে একটি স্বাধীন অর্থনৈতিক ইউনিট।’

সেদিন স্তালিন বলেছিলেন, ‘উন্নত দেশগুলির তুলনায় আমরা পঞ্চাশ থেকে একশ বছর পিছিয়ে আছি। আগামী দশ বছরে মধ্যে আমাদেরকে এই দূরত্ব অতিক্রম করতেই হবে। হয় এটা আমাদের করতে হবে, নাহলে ওরা আমাদের গুঁড়িয়ে দেবে।’ এবং স্তালিনের সোভিয়েত তা করে দেখিয়েছিল।

স্তালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েতে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯২৮-৩২) ছিল সার্বিক অগ্রগতির এক উৎসমুখ। পরিকল্পনার প্রথম চার বছরেই কৃষি, শিল্প, শিক্ষাসহ সবকটি মৌলিক ক্ষেত্রেই দেখা যায় গড়পড়তা ৯৩ শতাংশ সাফল্য। রীতিমতো তাক লগিয়ে দেওয়া অগ্রগতি। প্রথম পরিকল্পনার চার বছরে সোভিয়েতে শিল্পোৎপাদন বেড়ে যখন দ্বিগুণ, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তা কমে ৫৭শতাংশ, ব্রিটেনে ১৮শতাংশ, জার্মানিতে ৪০শতাংশ এবং ফ্রান্সে ৩০শতাংশ।

স্তালিন মানে, দুর্ধর্ষ নাৎসী বাহিনী ও হিটলারের দস্যুদের পরাস্ত করে ফ্যাসিবাদের ধ্বংসসাধন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জয় এবং ইউরোপের জন্য স্বাধীনতা।

স্তালিন মানে, পরমাণু অস্ত্রের মালিকানা শুধু একচেটিয়া আমেরিকার হাতে না — পরবর্তী পঞ্চাশ বছরে কোনও বড় যুদ্ধ না, এবং নয় আর কোনও হিরোশিমা-নাগাসাকি।

স্তালিন মানে, লেনিন প্রদর্শিত পথে আন্তর্জাতিকতাবাদের প্রসার। লেনিনের সমস্ত প্রবন্ধ ও অভিজ্ঞতাকে সূত্রায়িত করে লেনিনবাদের প্রচার।

স্তালিন মানে, বিভিন্ন জাতি-উপজাতির (প্রায় একশ’) সুদৃঢ় ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠা।

চার বছর আগে ত্রয়োদশ কংগ্রেসে স্তালিনের ঐতিহাসিক ভূমিকার পুনর্মূল্যায়ন করে কমিউনিস্ট পার্টি অব রাশিয়ান ফেডারেশন (সি পি আর এফ)। পরের বছর ২৪মার্চ পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি ‘জোশেফ স্তালিনের ১৩০তম জন্মবার্ষিকী নিয়ে’ গ্রহণ করে একটি প্রস্তাব। দেশজুড়ে হয় মিটিং-মিছিল, সভা-সমাবেশ, সেমিনার। হয় কনসার্টও। বিলি করা হয় এক লক্ষের উপর ‘অর্ডার অব স্তালিন’। পার্টি সদস্যদের মধ্যে, পার্টির বাইরে সাধারণ মানুষের মধ্যে। জুগানভ বই লেখেন স্তালিন সম্পর্কে। শিরোনাম স্তালিন ও আজকের রাশিয়া। এবং বাজারে পড়তেই বই শেষ। নতুন সংস্করণ। ফের নতুন সংস্করণ।

লেখক – শান্তনু দে, ২২/১২/২০১২