’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা কত?

c1

’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অসংখ্য বিতর্ক ও মতপার্থক্যের মাঝে একটি স্পর্শকাতর বিষয়ের উপর বিতর্ক সম্প্রতি পুনরায় বড় আকারে দেখা দিয়েছে যখন বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া এ বিষয়ে কয়েকটি মন্তব্য করেছেন। তার বক্তব্যে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে শহীদের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন ছাড়াও আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে। ২৩ ডিসেম্বর জাতীয় দৈনিকগুলোতে তার বক্তব্য যেভাবে এসেছে তাহলো- তিনি বলেছেন, “স্বাধীনতা যুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহীদ হয়েছেন বলা হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কতজন শহীদ হয়েছেন, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। একেক বই-এ একেক রকম তথ্য পাওয়া যায়। ……যারা মুক্তিযুদ্ধ করেননি তারা আজ বড় মুক্তিযোদ্ধা। আওয়ামী লীগ মুক্তিযোদ্ধাদের নাম দিয়ে নিজের ঘরে যুদ্ধাপরাধীদেরও পালছে। ………..উনি (শেখ মুজিব) স্বাধীনতা চাননি, চেয়েছিলেন কেবল ক্ষমতা। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন।” – ইত্যাদি। এই বক্তব্যের সকল বিষয় নিয়ে আমরা এ নিবন্ধের ক্ষুদ্র পরিসরে আলোচনা করতে পারবো না। শুধু শহীদের সংখ্যা বিষয়ের বিতর্কটিই আমাদের আলোচনার প্রধান বিষয় হবে।

বেগম জিয়া কেন এ বক্তব্যটি দিলেন তার কারণ এটা নয় যে তিনি প্রকৃত ইতিহাস সন্ধান করতে চান। কারণ, বিএনপি-ও শাসক বুর্জোয়া শ্রেণিরই একটি দল, যারা ’৭১-এর চেতনা’র কম/বেশি পরিবর্তিত একটি সংস্করণকে ধারণ করে। তারাও আওয়ামী লীগের মতই দেশ ও জনগণবিরোধী একটি দল। তবে বর্তমান আওয়ামী ফ্যাসিবাদের দমনে তারা যখন কোনঠাসা, এবং ’৭১-এর চেতনা নিয়ে আওয়ামী সংস্করণের বিকৃত মিথ্যা প্রচারে তারাও এতটা আক্রান্ত যে বেগম জিয়া এখন বাধ্য হচ্ছেন আওয়ামী লীগের মিথ্যা ও বিকৃতির কিছুটা উন্মোচনের মাধ্যমে পাল্টা জবাব দিতে। প্রতিক্রিয়াশীল গণবিরোধী শাসক শ্রেণির এই অন্তর্দ্বন্দ্বে ইতিহাসের কিছু সত্য উঠে আসতেই পারে, যেমনটা এসেছিল ’৭১-এ আওয়ামী মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান সেনানী খন্দকারের বই-এ।

দেখা যাচ্ছে বেগম জিয়ার বক্তব্যটি মাঠে পড়তে না পড়তেই আওয়ামী প্রচারযন্ত্র তার সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তারা তাকে দেশদ্রোহী, পাকিস্তানের দালাল, যুদ্ধাপরাধী ইত্যাদি নামে অভিহিত করেই ক্ষান্ত হয়নি। ইতিমধ্যে তার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মামলা রুজু করা শুরু হয়েছে।

অথচ বেগম জিয়া ৩০ লক্ষের বিপরীতে কোন সংখ্যা পেশ করেন নি। তিনি শুধু এ নিয়ে বিতর্কটিকে তুলে ধরেছেন। যদিও তার সাথে মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগের ভূমিকা, বিশেষত তাদের প্রধান নেতা শেখ মুজিবের ভূমিকার বিষয়টিতেও মন্তব্য করেছেন। এখন দেখা যাচ্ছে, এ ধরনের মন্তব্য বা বক্তব্য দেয়া মানে হলো আওয়ামী ফতোয়ায় দেশদ্রোহীতা করা, সংবিধান লঙ্ঘন করা, রাষ্ট্রদ্রোহীতা করা, মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করা, শহীদদেরকে অপমান করা- যার শাস্তি মৃত্যুদন্ড পর্যন্ত হতে পারে। অনেক বিভ্রান্ত একচোখা বাঙালি-জাতীয়তাবাদে অন্ধ বুদ্ধিজীবী বলছেন যে শহীদদের সংখ্যার বিষয়টা নাকি একটি মীমাংসিত ইস্যু, একে বিতর্কিত করা নাকি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার সামিল, শহীদদের অপমানের সামিল- ইত্যাদি।

প্রশ্ন হলো, এই বিষয়টি সহ মুক্তিযুদ্ধের গোটা রাজনীতি শুধু নয়, অসংখ্য তথ্যকে আওয়ামী ধারায় বিতর্কের উর্ধে¦ বললেই তো সেগুলো তা হয়ে যাবে না। ইতিহাস নিয়ে এ ধরনের বালখিল্যতা শুধু ফ্যাসিবাদের লক্ষণকেই প্রকাশ করে। যা এখন ইসরাইলীরা করে থাকে। করে থাকে ইসলামী মৌলবাদীরাও। বাবরী মসজিদ নিয়ে ভারতের হিন্দুত্ববাদীরাও এরকম করেছে ও করছে।

কিন্তু এটা তো একটা জ্বলজ্যান্ত সত্য কথা যে ’৭১-সালের শহীদের এ সংখ্যাটি নিয়ে একেক বই-এ একেক রকম তথ্য পাওয়া যায়। অনেক বুদ্ধিজীবীই এ নিয়ে কথা বলেছেন। অনেকে চুপ করে থাকাটাকেই শ্রেয় মনে করেছেন বটে, কিন্তু তারা জানেন যে এ সংখ্যাটি কোন প্রামাণ্য তথ্য নয়। ফলে এ নিয়ে যে বিতর্ক রয়েছে তাতে কোন সন্দেহই নেই। কিন্তু এই বাস্তব তথ্যটি তুলে ধরার জন্যই যে আওয়ামী নেতা-পাতি নেতা ও বুদ্ধিজীবীরা খালেদার উপর হামলে পড়েছে তা নয়। বাস্তবে খালেদা জিয়া এ বক্তব্যটি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা বিষয়ে সরকারি বক্তব্যের ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। যেখানে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অসংখ্য মিথ্যা প্রচারের উপর আওয়ামী লীগের (এবং আংশিকভাবে বিএনপি’রও) গোটা রাজনীতিটা দাড়িয়ে রয়েছে সেখানে এমন একটি বিষয়ে খালেদা জিয়া আঙ্গুল রেখে ’৭১ নিয়ে আওয়ামী প্রচার, তথা আওয়ামী রাজনীতির একেবারে গোড়াতেই হাত রেখেছেন। এটা শুধু আওয়ামী লীগ নয়, গোটা শাসকশ্রেণি, রাষ্ট্রযন্ত্র ও তার সৃষ্টি-সময়কালের প্রকৃত সত্য খুঁচিয়ে তোলার একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। ঠিক এ জায়গাটাতেই আওয়ামী লীগের আতংক। তাই তাদের প্রচারযন্ত্র তাৎক্ষণিক লাঠির ঘায়ে এ আলোচনাটিকে নিভিয়ে দিতে চাইছে। কাবু করতে চাইছে তার ক্ষমতার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি-কেও।

আমরা আমাদের পত্রিকায় ’৭১ নিয়ে শাসক বুর্জোয়া শ্রেণির, বিশেষত আওয়ামী লীগের বহু মিথ্যার কিছু বিষয়ে মাঝে মাঝে ইতিপূর্বেও আলোচনা করেছি। এক কথায় যদি বলা যায় তাহলে একটি মন্তব্যই শুধু পুনরায় করা যায়, তাহলো তাদের তৈরি করা পুরো ইতিহাসটিই মিথ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত। শহীদের সংখ্যাও তার ব্যতিক্রম নয়।

এর অর্থ এটা নয় যে, পাকবাহিনী ’৭১-সালে গণহত্যা করেনি। তারা তা করেছে এবং খুবই বর্বর ও নৃশংসভাবে তার শিকার হয়েছিলেন এদেশের সাধারণ জনগণ। হাজার লাখো সাধারণ মানুষকে তারা হত্যা করেছিল, অসংখ্য নারীকে নিপীড়ন করেছিল, অসংখ্য বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছিল, লুট করেছিল, ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দু ধর্মাবলম্বীদেরকে দেশছাড়া করার এক বর্বর ‘এথনিক ক্লিনজিং’ চালিয়েছিল। যার কারণে হিন্দু-মুসলিম মিলে প্রায় এক কোটি জনগণ দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। অনেক জায়গায় হিন্দুধর্মাবলম্বীদেরকে জোর করে মুসলিম বানানোও হয়েছিল। এসবই ইতিহাস। কিন্তু এটা ইতিহাসের একটি দিকের একটি অংশ মাত্র। এই বর্বরতার বারংবার ও অতিরঞ্জিত উল্লেখ দ্বারা আওয়ামী রাজনীতির মহত্ব প্রকাশিত হয়না। তা যে হয়না তার একটি স্থূল উদাহরণ পাওয়া যাবে এই শহীদের সংখ্যা নিয়ে তাদের রাজনীতিতেই।

খালেদা জিয়ার একটি বক্তব্য ধরে আওয়ামী প্রচারযন্ত্র তাদের হাজারো মিথ্যার রাজনীতির মত ৩০ লক্ষ শহীদের যে অকাট্য সন্দেহাতীত প্রচার চালাচ্ছে, ও এতদিন চালিয়ে এসেছে, তার ভিত্তিটা কী? ’৭১-এর পর দীর্ঘ ৪৪ বছরেও কেন শহীদদের কোন তালিকা করা হলো না? অথবা তার চেষ্টা পর্যন্ত করা হলো না? কী জবাব দেবে আওয়ামী লীগ, তার বর্তমান সরকার ও তাদের অন্ধ সুবিধাভোগী বুদ্ধিজীবীকূল, যারা কিনা ’৭১ নিয়ে অনবরত কাঁদুনি গেয়ে চলেছে?

বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যেখানে প্রতিটি জায়গায় অতিঘনত্বে জনগণ রয়েছেন যুগ যুগ আগে থেকেই (শুধু পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলটি বাদে)। এই দেশটি চার দশক আগে তো বটেই, এখনো রয়েছে গ্রামভিত্তিক। প্রতিটি গ্রামের মানুষ একে অন্যকে চেনে জানে। আর এ জানাজানিটা অন্তত দুই তিন পুরুষ ধরে বয়ে চলে। শহরাঞ্চলে যারা থাকেন, এমনকি যাদের বাড়িঘর শহরে, তাদেরও প্রধান অংশটির ভিত্তি এখনো গ্রামে রয়েছে। তারা ঈদের ছুটিতে দল বেধে গ্রামের বাড়িতে যান। একেবারে শিকড়বিহীন মানুষ বাংলাদেশে এখনো খুবই কম; ’৭১-সালে ছিল আরো অতি নগণ্য। তাই গ্রামকে ভিত্তি করে শহীদদের সংখ্যা ও পরিচয় বের করা খুবই সম্ভব।

একটি গ্রামে কয়জন মানুষ ’৭১-সালে মুক্তিযুদ্ধকালে পাকবাহিনীর হাতে শহীদ হয়েছেন তা কোন গোপন ব্যাপার নয়। এখনো যাদের বয়স ৬০-এর উর্ধ্বে তেমন লোকেরা ’৭১-এর স্মৃতি ভালভাবেই স্মরণ করতে পারবেন। এবং প্রতিটি গ্রামে এরকম ব্যক্তির সংখ্যা এখনো একেবারে কম নয়। এরকম অবস্থায় দেশের প্রতিটি গ্রামে ইউনিয়ন পরিষদের দায়িত্বে গ্রামভিত্তিক ও পাড়াভিত্তিক সভা করে প্রত্যক্ষভাবে হিসেব বের করা এখনো খুবই সম্ভব যে কারা কারা তখন শহীদ হয়েছিলেন। এটা কোন কঠিন কাজ নয়। তবু কেন কোন সরকার, বিশেষত যারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এত বেশি গলাবাজি করে সেই আওয়ামী সরকার মোট চারবার ১৫ বছরের বেশি ক্ষমতায় থেকেও এ বিষয়ে কোন উদ্যোগ নেয়নি? এটা বোঝা কঠিন কিছু নয়। এর সোজা কারণ হলো তারা প্রকৃত ইতিহাসটিকে তুলে ধরতে চায় না। তারা শহীদদের মধ্যকার মূল জনগণÑ যারা শহীদদের নিরংকুশ সংখ্যাগুরু, তাদের প্রতি কোন শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা পোষণ করে না। শুধু জনগণের দুর্গতি দুর্দশাকে পুঁজি করে নিজেদের গণবিরোধী রাজনীতিটা তারা চালাতে চায়।

ধরে নেয়া যাক আওয়ামী লীগের দাবি অনুসারে খালেদা জিয়া পাকিস্তানের দালাল, ধরে নেয়া যাক তার স্বামী জিয়াউর রহমান, যিনি আওয়ামী লীগের প্রধানতম নেতা শেখ মুজিবের সরকার কর্তৃক জীবিতদের জন্য প্রধান রাষ্ট্রীয় খেতাব “বীরোত্তম” প্রাপ্ত, তিনিও পাকিস্তানের দালাল। কিন্তু সেটা বলে তো একথা জায়েজ করা যাবে না যে এখনো পর্যন্ত সুযোগ থাকা সত্ত্বেও প্রকৃত শহীদের নামের তালিকা, পরিচয়, শহীদের ঘটনা ইত্যাদির জরিপ না করে আওয়ামী লীগ শহীদদের প্রতি চরম অবমাননা করেছে?

তারা প্রায় ১০ কোটি মানুষের ভোটার আইডি কার্ড করতে পারে, ডিজিটাল সুযোগে প্রত্যেক নাগরিকের তথ্যাদি সংরক্ষণ করতে পারে, মোবাইল ফোনের প্রতিটি সিম কার্ডের তথ্যব্যাংক করতে পারে, অথচ একেকটি গ্রামকে ভিত্তি করে শহীদদের তালিকাটা করতে পারে না? তার চেষ্টাও যে তারা কখনো করেনি তা-কি স্পষ্ট নয়? অথচ এটা রাষ্ট্রের জন্য এক অতি সহজ কাজ। কিন্তু তারা সেটা করছে না, করেনি ও করবেও না, একারণে যে এটা করলে তাদের দ্বারা প্রচারিত এক বড় মিথ্যা প্রকাশ হয়ে পড়বে। অথচ খালেদা জিয়াই প্রথম নন যিনি এ ব্যাপারে বিতর্ক তুলেছেন। বরং তিনি হলেন শাসকশ্রেণির প্রতিনিধি হিসেবে এই সব অনেক মিথ্যার বেনিফিসিয়ারি, যেমনটা আওয়ামী লীগ। এতদিন পর তিনি তার বুর্জোয়া রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে এ বিতর্ক তুলেছেন, যা বাস্তবে ৪৪ বছর দেরি হয়ে গেছে।

যদি প্রশ্ন করা হয় ৩০ লক্ষ সংখ্যাটি আওয়ামী লীগ কীভাবে পেল তার কী জবাব? কখনো কি রাষ্ট্্রীয়ভাবে এর জরীপ করা হয়েছে? করা হয়নি। ৩০ লক্ষ শহীদ মানে হলো তৎকালীন গ্রাম পিছু প্রায় ৬০ জন মানুষের শহীদ হওয়া। (তখন যদি ৫০ হাজার গ্রাম ধরা হয়)। কিছু ব্যতিক্রম গ্রাম বাদে এটা এক অসম্ভব সংখ্যা। প্রায় প্রতিটি মানুষ নিজ নিজ গ্রামে অনুসন্ধান করলেই একথার সত্যতা পাবেন। ’৭১-সালে নগরায়ন এখনকার মত ছিল না। তবুও শহরগুলোর গণহত্যায় নিহত মানুষদের প্রায় জনেরই গ্রামকে ধরে হিসেব বের করা সম্ভব। সব কিছুর পরও ১০ থেকে ২০% ত্রুটি ধরে নিয়েও জরিপ করলে এমন কোন বিরাট সংখ্যা পাওয়া যাবে না।

এই বানানো সংখ্যাটি তাহলে কীভাবে এলো? এ সম্বন্ধে একটা তথ্য প্রচলিত রয়েছে যাকে আওয়ামী লীগ মাটির নিচে চাপা দিয়ে রেখেছে। বিবিসি’র প্রখ্যাত সাংবাদিক, এক সময়ে শেখ মুজিবের খুবই স্নেহভাজন প্রয়াত সিরাজুর রহমান তার বহু কলামে, আলোচনায় ও পুস্তকে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য দিয়েছেন। সে ব্যাপারে সরকার ও আওয়ামী লীগারদের বক্তব্য কী?

ড.আহমদ শরীফের মত বিজ্ঞ বুদ্ধিজীবী বহুবার বলেছেন, এটি একটি বানানো সংখ্যা, শহীদের সংখ্যা ২/৩ লক্ষের বেশি হবে না। আহমদ শরীফকে কেউ পাকিস্তানের দালাল বলবে না নিশ্চয়ই।

শহীদদের তালিকা না করে তাদের স্মৃতির প্রতি চরম অবমাননা করে তাদের এক কাল্পনিক সংখ্যাকে বিতর্কের উর্ধ্বে বলে ইতিহাসের সত্য আবিস্কারের পথ রাষ্ট্রীয় আইন ও দমন নির্যাতন দিয়ে মাটিচাপা দিয়ে রাখাটা শহীদদের মর্যাদা বাড়ায় না, যতই আওয়ামী লীগাররা তার ভাব দেখাক না কেন। ভারত যখন প্রত্যক্ষ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে তখন থেকে বাংলাদেশ সৃষ্টি পর্যন্ত ভারতের প্রায় ৪/৫ হাজার সেনা নিহত হয়। এর হিসেব রয়েছে। সে সময়টাতে মুক্তিযোদ্ধা মারা যান প্রায় ৪ হাজারের মত। এরও একটা হিসেব আছে। সারা দেশে বুদ্ধিজীবী (যাদের মাঝে রয়েছেন শিক্ষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক- ইত্যাদি) নিহত হয়েছেন প্রায় ১ হাজার- যাদের মাঝে মুক্তিযোদ্ধা বুদ্ধিজীবীও রয়েছেন। এগুলো সরকারি তথ্য। তাহলে কেন সাধারণ জনগণসহ সকল শহীদদের প্রকৃত সংখ্যাটি ও পরিচয় অন্তত কাছাকাছিভাবে করা যাবে না? বাস্তবে মুক্তিযুদ্ধ-বান্ধব একটি সরকার, যারা প্রকৃতই শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, এবং শুধু তাদের মৃত্যু নিয়ে অপরাজনীতিতে লিপ্ত নয়, তেমনটা হলেই এটা সম্ভব। আওয়ামী লীগ প্রমাণ করেছে তারা তা নয়।

শহীদদের সংখ্যা ৩০ লক্ষের বদলে ৩ লক্ষ বা ১ লক্ষ হলে কি সেটা পাকবাহিনীর বর্বরতাকে কমিয়ে দেয়? অথবা সেটা বললে কি পাকবাহিনীর প্রতি পক্ষপাতিত্ব করা হয়? মোটেই নয়। তা-কি তৎকালে এদেশের আপামর জনগণের মহাদুর্যোগ ও সংকটকে কমিয়ে দেয়? মোটেই নয়। প্রকৃত সংখ্যাটি যা-ই হোক না কেন সেটা ভয়াবহ। তাকে অতিরঞ্জিত করা বা আন্দাজে একটা সংখ্যা বানিয়ে তাকেই ইতিহাস বলার মধ্যে কোন সত্যটি রয়েছে? কিছুই না। এটা শুধু মিথ্যার পাহাড়কে বড় করা,। এটা হলো ভিন্ন অবস্থান থেকে ইতিহাসের বিকৃতি করা। যা করেছে এদেশের শাসকশ্রেণি, বিশেষত আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে। তাদের অপরাজনীতিকে চূর্ণ না করে এইসব মিথ্যা ও বানানো ইতিহাস থেকে জাতি ও জনগণ মুক্তি পাবেন না।

সূত্রঃ আন্দোলন পত্রিকা, ফেব্রুয়ারি ‘১৬ সংখ্যা


তুরস্কঃ অমর মাওবাদী নারী গেরিলা কমরেড Yeliz Erbay ও Sirin Öter লাল সালাম

1919128_1236395943041329_5690230184022804458_n

গত ২২শে ডিসেম্বর তুরস্কের ইস্তাম্বুলে দুই মাওবাদী কমিউনিস্ট নারী গেরিলা কমরেড Yeliz ErbaySirin Öter কে এক বাড়িতে সন্ত্রাস বিরোধী অভিযানের নামে আহত আবস্থায় হত্যা করেছে ফ্যাসিস্ট পুলিশ। সমাজতান্ত্রিক নারী কাউন্সিল (SKM) ও মার্কসবাদী লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্ট (MLCP)-র কেন্দ্রীয় কমিটি এক বিবৃতিতে এই হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। বিবৃতিতে SKM বলেন, পুলিশের গোলাগুলিতে তারা যখন আহত হয়, তখনি কমরেড “Yeliz Erbay এবং Sirin Öter কে ভুয়া সংঘর্ষের নামে হত্যা করে পুলিশ। কুর্দি সম্প্রদায়ে জন্ম নেয়া এই দুই কমরেড সমাজতান্ত্রিক নারী আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। তারা দুজনেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন মাওবাদী আন্দোলনে যোগ দেন। ফ্যাসিবাদী তুরস্ক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলনে নারীদের যুক্ত করার ক্ষেত্রে তাদের অবদান খুবই উজ্জ্বল। এর মধ্যে কমরেড Yeliz Erbay, MLCP-র ৫ম কংগ্রেসে কমিউনিস্ট নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে পর্যবেক্ষক হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন।

mlkp_3

অনুবাদ সূত্রঃ

http://jinha.com.tr/en/ALL-NEWS/content/view/39806

http://www.kaypakkayahaber.com/haber/gule-gule-yoldaslar-direnisinizi-ve-kavganizi-buyutecegiz


বাংলাদেশঃ টাঙ্গাইলে র‍্যাবের সাথে কথিত বন্দুকযুদ্ধে পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি(লাল পতাকা)-র তিন সদস্য নিহত

Tangail_BG_491375829

টাঙ্গাইল সদর উপজেলার কাকুয়া ইউনিয়নের ওমরপুর গ্রামে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) সঙ্গে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ তিনজন কমিউনিস্ট সদস্য নিহত হয়েছেন। র‍্যাব বলছে, নিহত ব্যক্তিরা নিষিদ্ধ পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য।

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের জন্য ব্যাপক সমালোচনার মুখে থাকা এলিট ফোর্স র‍্যাব গতকাল বুধবার দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে এ ঘটনা ঘটায়।

নিহত কমিউনিস্টরা হলেন, সদর উপজেলার বাঘিল ইউনিয়নের ওমর (৩০), ঢালানগোপালপুর গ্রামের কাশেম (২৫) এবং খোর্দজুগনি গ্রামের সাদ্দাম (২৬)।

ওমর পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির (এম এল-লাল পতাকা) টাঙ্গাইল জেলা শাখার সভাপতি, কাশেম সংগঠনের এমপি ও সাদ্দাম স্কোয়াড কমান্ডার।

ঘটনাস্থল থেকে দুটি বিদেশী পিস্তল, সাতটি গুলিসহ দুটি ম্যাগাজিন ও দুটি দোনলা বন্দুক উদ্ধার করা হয়েছে বলে র‍্যাব জানিয়েছে।

র‍্যাব-১২ এর তিন নম্বর কোম্পানি কমান্ডার মহিউদ্দিন ফারুকি বলেন, গোপন সূত্রে খবর পেয়ে র‍্যাবের একটি দল পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের ঘেরাও করে। র‍্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে তাঁরা গুলি ছোড়ে। র‍্যাবও পাল্টা গুলি ছোড়ে। এতে তিনজন আহত হয়। তাঁদের উদ্ধার করে টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক তাঁদের মৃত ঘোষণা করেন।

নিহত ব্যক্তিদের লাশ টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজের মর্গে রাখা হয়েছে।

ওমরপুর গ্রামে নিহত কমিউনিস্ট সদস্যদের দেখতে উপস্থিত জনগণ

ওমরপুর গ্রামে নিহত কমিউনিস্ট সদস্যদের দেখতে উপস্থিত জনগণ

সূত্রঃ http://www.thedailystar.net/country/3-%E2%80%98pbcp-outlaws%E2%80%99-killed-%E2%80%98gunfight%E2%80%99-tangail-rab-191956


আজ পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (লাল পতাকা)র সাধারণ সম্পাদক ডাঃ টুটুলের শহীদ দিবস

ডাঃ মিজানুর রহমান টুটুল
ডাঃ মিজানুর রহমান টুটুল

গত ২৭ জুলাই ২০০৮ সালে বাংলাদেশের বিশেষ বাহিনী র‍্যাবের হাতে তথাকথিত ক্রসফায়ারে নিহত মাওবাদী কমরেড ডাঃ মিজানুর রহমান টুটুল ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। মাধ্যমিক ও উচ্চ-মাধ্যমিক উভয় পরীক্ষায় তিনি বোর্ড-স্ট্যাণ্ড করেন। এর পরে তিনি ডাক্তারী পড়ার জন্য রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন। মেডিক্যাল কলেজের সব থেকে মেধাবী এ-ছাত্রটি সাম্যবাদী আদর্শে দীক্ষিত হয়ে সমাজ বদলের সশস্ত্র ধারার রাজনীতি পূর্ব-বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল) সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন।

শহীদ ডাঃ মিজানুর রহমান টুটুল
শহীদ ডাঃ মিজানুর রহমান টুটুল

ডাঃ টুটুল সশস্ত্র মাওবাদী ধারার রাজনীতিতে দ্রুত জনপ্রিয় সাংগঠনিক ও তাত্ত্বিক নেতায় পরিণত হন। এবং খুব অল্প সময়েই পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (লাল পতাকা) বাংলাদেশের বৃহত্তম মাওবাদী দলে পরিণত হয়। ২০০২ সালে দলের অপর তাত্ত্বিক নেতা মোফাখকার চৌধুরীর সাথে বিপ্লবের প্রশ্নে দ্বিমত পোষণ করে দল ছেড়ে বেরিয়ে এসে গঠন করেন পূর্ব-বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল-লাল পতাকা; পরবর্তীতে যা লাল পতাকা নামে অধিক পরিচিত)।

images

১৯৮৫ সালে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন টুটুল। এরপর অল্প কিছু দিনের জন্য রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজে চাকরী করেন তিনি। ঝিনাইদহ কৌট চাঁদপুরের এলেঙ্গায় উচ্চবিত্ত এক পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন টুটুল। টুটুলের বাবা দাউদ হোসেন বেঁচে না থাকলেও ৮০ বছরের বৃদ্ধা নভেরা খাতুন এখোনো বেঁচে আছেন। এক মাত্র বোন নুরজাহান বেবীর বিয়ে হয়ে গেছে বেশ আগেই। অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে টুটুল অপরের উপকার করতে গিয়ে নিজেদের জমিজমার প্রায় সবটুকু বিক্রি করে দিয়েছিলেন।

টুটুল বিয়ে করেছিলেন খুলনা ফুলতলা উপজেলার দামোদার গ্রামে। গোপন বিপ্লবী জীবনের কারণে বিয়ের কিছুদিন পরে স্ত্রী লুসি খানম তাকে ছেড়ে চলে যায়। পিতুল নামে টুটুলের একটি ছেলে রয়েছে। পিতুল বর্তমানে ঢাকায় পড়াশোনা করছে।

বৃদ্ধা মায়ের আকুতি বাঁচাতে পারলো না টুটলকে

টুটুলের মা নভেরা খাতুনের বক্তব্য অনুযায়ী ২৬ জুলাই কোট চাঁদপুর পুলিস বাড়ীতে এসে টুটুলকে গ্রেফতারকরার খবর জানায়। এরপর টুটলের মা প্রায় ২শো মানুষ সাথে নিয়ে ঝিনাইদহ ডিসির কাছে স্মারকলিপি দিতে যান। স্মারকলিপিতে নভেরা খাতুন উল্লেখ করেন যে, তার ছেলে কোনো সন্ত্রাসী নয়। কোনো খুনের সাথে জড়িত নয়। এলাকায় ভালো মানুষ ও দয়ালু ডাক্তার হিসেবে টুটুলের সুনাম রয়েছে। ছেলেকে ক্রসফায়ারে না দিয়ে বিচারের মুখোমুখি জন্য সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান মা নভেরা খাতুন। কিন্তু টুটুলের মায়ের এ-আর্তি ডিসি গ্রহণ করেনি। শেষ পযর্ন্ত ছেলের প্রাণের জন্য নভেরা খাতুনকে ঝিনাইদহ প্রেসক্লাবে সংবাদসম্মেলন করতে হয়। রাষ্ট্রের কানে টুটুলের মায়ের হাহাকার গিয়ে শেষ পযর্ন্ত পৌছায়নি। ২৭ জুলাই ভোর রাতে তথাকথিত ক্রসফায়ারের টুটুলকে হত্যা করা হয়।

একই গল্পঃ মানুষ আর বিশ্বাস করছে না

সংবাদপত্রে ক্রসফায়ারে মৃত্যুর সংবাদ সব দিনের জন্য সব পত্রিকার জন্য সমান। একই সংবাদ শুধু ভিকটিমের নাম ও স্থান পাল্টে যায়। গল্পটা প্রত্যেকবার হয় মোটামুটি এ-রকমঃ

গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে গোপন আস্তানা বা অস্ত্রের সন্ধান দেয়ার জন্য আটক রাখার স্থান থেকে বাইরে নিয়ে যায় র‍্যাব বা পুলিশ। এ-সময় আটক ব্যক্তিটিকে মুক্ত করে নেয়ার জন্য ওঁত পেতে থাকা সন্ত্রাসীরা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে। আক্রান্ত হবার কারণে আত্মরক্ষার প্রয়োজনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে পালটা গুলি চালাতে হয়। গোলাগুলির সময় পালাতে গিয়ে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিটি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।

রাষ্ট্রের দেয়া এহেন বক্তব্যের আদৌ কোনো গ্রহণযোগ্যতা জনগণের কাছে নেই। সকলেই জানে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিটিকে ঠাণ্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করেছে সরকারী বাহিনীর সদস্যরা। ডাঃ টুটুলের ক্ষেত্রেও ঘটানো হয়েছে একই ঘটনা। দেয়া হয়েছে একই বক্তব্য।

জামাত-বিএনপি আমলে গঠিত র‌্যাবের হাতে ২০০৮ পযর্ন্ত ৪১৯টি ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৫১১ জন। র‍্যাবের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ২৪৮টি ঘটনায় ক্রসফায়ারে ২৮৪ জন এবং ১৭১টি ঘটনায় এনকাউন্টারের ঘটনায় ২২৭ জন মারা গেছে। এর বাইরে আরও ২১ জন রাাব হেফাজতে মারা গেছে। র‍্যাবের দাবী হার্ট এট্যাকে মারা গেছে এরা।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রধান ও সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামালের মতে, ৫০০ বার একই ধরণের ঘটনা কীভাবে ঘটলো? রাষ্ট্রের হেফাজতে বার-বার মানুষ মারা যাচ্ছে এটা কাম্য হতে পারে না। আইনে বলা আছে আটক হওয়ার পর ওই লোকটির নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর। তা তারা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। আইনজীবী শাহদীন মালিকের মতে, রাষ্ট্র যখন ক্রমাগতভাবে বিনা বিচারে হত্যার কারণ হয়, তখন সেই রাষ্ট্রে আইন ও সাংবিধানিক শাসনের সম্ভাবনা সুদূরপরাহত হয়ে যায়। এসব বাক্যকে অবশ্য বুর্জোয়া নীতি বাক্য হিসাবেই দেখছেন অনেকে। একাধিক বামপন্থী-কর্মী একান্ত আলাপে জানা যায়, টুটুলকে হত্যা করা হয়েছে রাজনৈতিক কারণে। কারণ তাঁর বেঁচে থাকাটা রাষ্ট্রের জন্য বিপদজনক ছিলো। এরা মনে করেন নেপাল ও ভারতে মাওবাদী আন্দোলনের বিকাশ ও সাফল্য দেখে চিন্তিত হয়ে পড়েছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতীয় সম্প্রসারনবাদ। এ-কারণেই বাংলাদেশে আণ্ডারগ্রাউন্ড বামদের নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করা হচ্ছে।

সূত্রঃ http://www.ukbengali.com/MainNews/MN2008/MN200808/MN20080802-Who-was-Dr-Tutul.htm


ভারতের গণযুদ্ধে শহীদ নারী (১৭), কমরেড পদ্মাক্কা

 poddakka

কমরেড পদ্মাক্কা

  কমরেড পদ্মাক্কা ছিলেন অন্ধ্রপ্রদেশের কর্ণোল জেলার আদোনী শহরের অধিবাসী। ছাত্রীবস্থায় তিনি বিপ্লবী রাজনীতির প্রভাবে আসেন ও ১৯৮৩ সাল থেকে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে থাকেন। ১৯৮২-১৯৮৩ বছরগুলিতে কর্ণোলের ছাত্রদের মধ্যে তিনি কাজ করেন আর বিপ্লবী রাজনীতি প্রচার করেন। বিপ্লবী কাজের ধারাবাহিকতায় তিনি এক সহকর্মী কমরেডের প্রেমে পড়েন এবং তাকে বিয়ে করেন। তখন থেকে এই দম্পতি তাদের যুগলজীবনকে আন্দোলনের অগ্রগতির জন্য উৎসর্গ করেন। ১৯৮৫-৯০ সময়কালে তিনি সব সময় নারী সমস্যা নিয়ে ভাবতেন ও বিভিন্ন স্তরের পার্টি-কমিটিতে তা আলোচনা করতেন। এই সময়কালে একটি টেকনিক্যাল কাজ করার সময় কমরেড পদ্মাক্কা সমাজে নারীরা যে সমস্যা মোকাবেলা করছে সে বিষয়ে তীক্ষ্ণ আগ্রহ প্রকাশ করেন। নারীদের সংগঠিত করার কাজ করতে কঠিন পরিশ্রম করেন। ৮০ দশকের শেষার্ধ থেকে তিনি অন্ধ্রপ্রদেশের রয়েলসীমা অঞ্চলে নারী আন্দোলন গড়ে তোলার দায়িত্ব নিলেন এবং এই দায়িত্ব পালন করতে করতেই মাত্র ৩৪ বছরের তরুণ বয়সে শহীদ হয়ে জীবন দিলেন।

  আন্ডারগ্রাউন্ড জীবন যাপনকারী একজন নারী হিসেবে যে সব সমস্যা ও কষ্ট মোকাবেলা করতে হয় কমরেড পদ্মাক্কা দক্ষতার সাথে হাসিমুখে সে সব সমস্যা সমাধান করেছেন, সেই সঙ্গে সাথী নারী কমরেডদের নেতৃত্ব দিয়েছেন। একটি নারী আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য কমরেড পদ্মাক্কা এক দশক ধরে ক্লান্তিহীন ও অব্যাহতভাবে যে প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছিলেন সবেমাত্র তার ফল ধরতে শুরু করেছিল। কমরেড পদ্মাক্কা সেইসব কমরেডদের অগ্রভাগ ছিলেন যারা নতুন জাত কিছু নারী লেখক ও নারীবাদী কর্মীদের মধ্যে বিদ্যমান ভুল চিন্তাধারার বিরুদ্ধে জীবন-মরণ রাজনৈতিক সংগ্রাম চালান। কমরেড পদ্মাক্কা ছিলেন একজন আদর্শ কমিউনিস্ট যিনি তার মতাদর্শগত স্তরকে উন্নত করতে প্রয়াস করেছেন। যাতে সেই সব উপদলের মুখোশ উন্মোচন করতে নিজেকে সক্ষম করে তোলা যায়। যারা সাম্রাজ্যবাদী ‘সাহায্য সংস্থা’ থেকে ভিক্ষা নিয়ে নারীবাদী চ্যাম্পিয়ন হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিচ্ছিল, যারা ছিল সাম্রাজ্যবাদের পরোক্ষ সমর্থক। কমরেড পদ্মাক্কা তার ও নারী ফ্রন্টে কর্মরত সহকর্মী কমরেডদের জন্য পার্টির কাছে নিয়মিত গাইড চাইতেন। এই প্রক্রিয়ায় তিনি নারী আন্দোলনে নিজেকে উৎসর্গ করেন এবং বিবিধ নারী সমস্যা বুঝতে ও অধ্যয়ন করতে তার কমরেডদের গাইড দিতেন। অন্ধ্রপ্রদেশে পার্টির ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ১৯৯২ সালে রাজ্য বিশেষ প্লেনামে নারীরা প্রতিনিধি নির্বাচিত হলেন, আর কমরেড পদ্মাক্কা ছিলেন তাদের মধ্যে একজন। অন্ধ্রপ্রদেশের পুলিশ বিশেষভাবে একটি টাস্কফোর্স গঠন করলো কমরেড পদ্মাক্কাকে হত্যা করতে, যিনি ছিলেন নিলোর ও রয়েলসীমা অঞ্চলের মদ বিরোধী সংগ্রাম থেকে শুরু করে যৌতুকের জন্য নারী নির্যাতন চালিয়ে হত্যাসহ নারীদের বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলনের নেতৃত্বে। এই বর্বর অফিসগুলো শেষ পর্যন্ত ১৯৯৪ সালের ২৯ শে সেপ্টেম্বর কমরেড পদ্মাক্কাকে ধরতে সক্ষম হলো। তার উপর অত্যাচার চালাতে যে সব পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে, তা এমনকি একদা কুখ্যাত দক্ষিণ আফ্রিকার BOSS (ব্যুরো অব স্টেট সিকিউরিটি)-কেও লজ্জায় ফেলবে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে তার সমগ্র শরীরকে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলা হয়েছিল এবং তার দু’টি চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছিল। আসুন আমরা গভীরভাবে অনুভব করি কমরেড পদ্মাক্কার আত্মত্যাগ আর আদর্শের প্রতি দৃঢ়তা, যা তিনি শত্রুর সকল নির্যাতন সহ্য করে প্রদর্শন করে গেলেন।

  আসুন, আমরা বিপ্লবী সালাম জানাই, সর্বহারা যোদ্ধা কমরেড সুরাইয়া ও নারী বিপ্লবী যোদ্ধা কমরেড পদ্মাক্কাকে তাদের অনুপম ত্যাগ ও সাহসিকতার জন্য।

সুত্র

http://bannedthought.net/India/CPI-Maoist- Docs/Women/WomenMartyrsNaxalbariTo2010-Vol-1.pmd.pdf