প্রগতিশীল কলমযোদ্ধা মহাশ্বেতা দেবীঃ আদিবাসী ও নিপীড়িতদের স্বপক্ষে ছিলেন আমৃত্যু অবিচল

 

বৃটিশ বিরোধী “কল্লোল সাহিত্য আন্দোলন” ও তৎকালীন “গণনাট্য সংঘে”র সামনের সারিতে থাকা শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্পন্ন এক মধ্যবিত্ত শিক্ষিত পরিবারে মহাশ্বেতা দেবীর জন্ম। তিনি ১৯২৬ সালের ১৪ জানুয়ারি ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মনীষ ঘটক কল্লোল সাহিত্য আন্দোলন ও গণনাট্য সংঘে’র সুপরিচিত কবি ছিলেন। সেই সূত্রে মহাশ্বেতা দেবীও গণনাট্য সংঘের সাথে যুক্ত ছিলেন। ভারতের বাংলাভাষাভাষী এই প্রগতিশীল লেখক সম্প্রতি বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেছেন।

মহাশ্বেতা দেবীর সাহিত্যের প্রধানতম ক্ষেত্র ছিল আদিবাসী, দলিত ও নিপীড়িত জনগণ- যার এক বিরাট অংশ জুড়ে ছিল নারী। যারা নিজেদের অধিকারের জন্য বৃটিশের বিরুদ্ধে, ভারতের শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে ও উঁচুজাতের জোতদার, মহাজনদের বিরুদ্ধে নিরন্তর বীরত্বপূর্ণ লড়াই-সংগ্রামে জড়িত। তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়ের গ্রামাঞ্চলে আদিবাসীদের মধ্যে বছরের পর বছর থেকেছেন, মিশেছেন। তাদের দুঃখ-কষ্ট-সংগ্রাম-আত্মবলিদান-সাহসী অধ্যবসায় প্রভৃতিকে গভীর উপলব্ধিতে ধারণ করেছেন। একে সাহিত্যে জীবন্তভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি বলেছেন- তার গল্পের কাহিনী তিনি তৈরি করেননি- এগুলো জনগণেরই জীবন এবং তাদেরই সৃষ্টি। আদিবাসীদের জীবন ও সংগ্রামকে ঘিরে তার এমনি এক অসাধারণ উপন্যাস “চোট্টিমুন্ডা ও তার তীর”।

তিনি সারা জীবন আদিবাসীদের ন্যায্য দাবি ও সংগ্রামের পক্ষে থেকেছেন। সেজন্যই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের লালগড় ও নন্দীগ্রামের আদিবাসীদের জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধেও সোচ্চার ছিলেন তিনি। আদিবাসী ছাড়াও তিনি শাসকশ্রেণির রক্তচক্ষু ও হুমকিকে উপেক্ষা করে শ্রমিক-কৃষকসহ নিপীড়িত জাতিসত্তা ও জনগণের আন্দোলন-সংগ্রামের পক্ষেও বলিষ্ঠভাবে দাঁড়িয়েছেন, সাহসী প্রতিবাদ করেছেন, কলম ধরেছেন। এরই অংশ হিসেবে ভারতে মাওবাদীদের নির্মূল করতে শাসকশ্রেণির নির্বিচার গণহত্যা ও নিষ্ঠুর নির্যাতনের সামরিক অভিযান “অপারেশন গ্রিনহান্টে”র বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছেন। উল্লেখ্য, ৬০-এর দশকে ভারতে মাওবাদীদের নেতৃত্বে ঐতিহাসিক নক্সালবাড়ি আন্দোলন তাকে প্রভাবিত ও আলোড়িত করেছিল। তখনও তিনি “নক্সালদের” উচ্ছেদে শাসকশ্রেণি ও তার রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে উন্মোচন করে রচনা করেছিলেন উপন্যাস “হাজার চুরাশির মা”। তিনি তার প্রথম উপন্যাস “ঝাঁসির রাণী”তে বৃটিশের বিরুদ্ধে এক যুদ্ধে নারী নেতৃত্ব লক্ষ্মীবাঈসহ অনেকের বীরত্বপূর্ণ লড়াই ও আত্মত্যাগকে অত্যন্ত নিপুণ হাতে তুলে ধরেছেন। সুদীর্ঘ ৬০ বছরের সাহিত্য সাধনার ফসল হিসেবে তিনি বাংলাভাষায় ১০০টিরও বেশি উপন্যাস এবং ২০টি গল্প সংকলন রচনা করেছেন এবং অসংখ্য সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। উল্লিখিত উপন্যাসগুলো ছাড়াও মহাশ্বেতা দেবীর উল্লেখযোগ্য আরো উপন্যাস হচ্ছে- তিতুমীর, অরণ্যের অধিকার, অগ্নিগর্ভ প্রভৃতি এবং গল্প- রোদালী, দ্রৌপদী, স্তন্যদায়িনী, ভাত ইত্যাদি। তার প্রগতিশীল রচনাসমূহ প্রগতিবাদীদের সাহিত্যকর্মের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ শর্ত এবং দৃষ্টান্ত। যা শ্রমিক-কৃষক সহ সকল নিপীড়িত জনগণের আন্দোলন-সংগ্রামের পক্ষে তাদের লেখালেখিতে উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি করবে, সাহস যোগাবে।

মহাশ্বেতা দেবীর উল্লিখিত অগ্রসর দিক সত্ত্বেও তার গুরুতর দুর্বল দিক সম্পর্কে কিছু না বললেই নয়। তিনি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সংস্কারের দাবিতে আটকে থেকে বুর্জোয়া রাজনীতির বেড়াজালে বিভ্রান্ত হয়েছেন। যেমন, তার বুর্জোয়া প্রতিক্রিয়াশীল পার্টি তৃণমূল কংগ্রেসকে সমর্থন করা। একই কারণে শেখ মুজিব-হাসিনার আওয়ামী রাজনীতির প্রতিক্রিয়াশীলতাকে বুঝতে না পারা। সর্বোপরি নিপীড়িত জনগণের মুক্তির জন্য বিপ্লবী রাজনীতি-মতাদর্শ সম্পর্কে তার দুর্বলতা।

মহাশ্বেতা শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী থেকে ইংরেজিতে সম্মান এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৪ সালে বিজয়গড় কলেজে শিক্ষকতা করেন। তার যোগদানের পর থেকে তারই প্রচেষ্টায় এই কলেজটি শ্রমজীবী নারী ছাত্রীদের প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে তিনি শিক্ষকতার চাকুরি ছেড়ে লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন। আমৃত্যু লেখালেখিই ছিল পেশা। ২০১৬ সালের ২৮ জুলাই তিনি মারা যান। 

সূত্রঃ নারী মুক্তি, মার্চ ২০১৭ সংখ্যা


বিপ্লবী চলচ্চিত্রঃ ‘হাজার চুরাশির মা/Hazaar Chaurasi Ki Maa’

bollywood-films-based-on-novels-16

বিপ্লবী চারু মজুমদারের ইশতেহারের ডাকে নকশালবাড়ি আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল অসংখ্য শিক্ষিত তরুণ। কলকাতায় তখন সময়টা সত্তরের দশক।  নকশাল আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা লেখিকা মহাশ্বেতা দেবীর বই ‘হাজার চুরাশির মা’ অবলম্বনে নির্মিত এই সিনেমা।  কাহিনীটি সুজাতার, যিনি ব্রতী অর্থাৎ মর্গের ১০৮৪ নং মৃতদেহটির মা।

অন্যান্য অনেক তরুণের মত কলেজপড়ুয়া ব্রতিও গিয়েছিল নকশাল আন্দোলনে।  কিন্তু বাড়িতে খবর এলো, সে ফিরেছে লাশ হয়ে।  ব্রতীর নকশাল রাজনৈতিক মতবাদ ও ক্রিয়াকলাপের জন্য তাকে নির্দয় ভাবে হত্যা করেছিল কংগ্রেস সরকার।  লেখাপড়ায় ভাল, আদরের সন্তান ব্রতী নয় বরং হাজার চুরাশি নাম্বার লাশের দায়িত্ব বুঝে নিতে বলা হয় তার মা, সুজাতাকে।

নকশালবাড়ি আন্দোলনে ছেলে হারানো এক মায়ের মর্মস্পর্শী এই গল্প লিখেছিলেন মহাশ্বেতা দেবী, তার ‘হাজার চুরাশির মা’ উপন্যাসে।  সেই গল্প থেকেই ভারতে ১৯৯৮ সালে নির্মিত হয় ‘হাজার চৌরাসি কা মা’।  কলকাতায় ষাট থেকে আশির দশকের মধ্যে বামপন্থী নকশালদের আন্দোলনে পুলিশি অত্যাচার এবং গুলিবর্ষণে নিহত হয়েছিল এরকম অসংখ্য তরুণ।  গুমোট এই পরিস্থিতির বেদনাবহুল প্রেক্ষাপট পরিষ্কারভাবেই ধরা পড়েছিল জয়া বচ্চনের অভিনীত সুজাতা চ্যাটার্জি চরিত্রটিতে।

আমরা এই মাকে ব্লতীর মৃত্যুবার্ষিকীতে তার ছেলের স্মৃতিচারণ করতে দেখি ও তার মাধ্যমে বাংলার যুবাদের সেই রক্তাক্ত বিপ্লবী নকশাল আন্দোলনের সাথে পরোক্ষ ভাবে জড়িয়ে পড়া মানুষগুলির মুখ খুব কাছ থেকে দেখতে পাই।

http://www.dailymotion.com/video/x2fnrag

 


দূর থেকেই ক্ষমা চেয়েছি বাপ্পার কাছে : মহাশ্বেতা দেবী (একমাত্র পুত্র নবারুণ ভট্টাচার্য স্মরণে)

1082014247031-large

(প্রখ্যাত সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী ও অভিনেতা বিজন ভট্টাচার্যের একমাত্র সন্তান ছিলেন নবারুণ। প্রথাবদ্ধ চিন্তার দেয়াল ভাঙতে চাওয়া লেখক ছিলেন নবারুণ।   )

ওকে যে আমি ইচ্ছা করে ছেড়ে এসেছিলাম , তা নয়৷ আমাকে দুনিয়া হয়তো খুব নিষ্ঠুর মা হিসাবেই দেখবে৷ ’ একান্ত সাক্ষাত্কারে মহাশ্বেতা দেবী ৷ আলাপে রাহুল দাশগুন্ত

মনে হয়, আমার বিষয়ে আমার ছেলে শুধুই ক্রিটিকাল ছিল না , ওর মধ্যে একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিংও ছিল৷ অ্যাট দ্য এন্ড অফ মাই লাইফ , আজ সেই হাহাকার নেই যে , তাকে চোখে দেখিনি কত দিন

Nabarun--621x414
রাহুল দাশগুন্ত : আপনি এক বার লিখেছিলেন , ‘হাজার চুরাশির মা ’ বইয়ে ব্রতীর শৈশবচিত্র তো আমার ছেলে নবারুণেরই শৈশব৷ ওঁর শৈশব নিয়ে যদি কিছু বলেন৷

মহাশ্বেতা দেবী : আমার ছেলেকে তোমরা নবারুণ বলে চেনো৷ ওর ডাকনাম , বাপ্পা৷ আর আমি তো ওকে ‘বাবু’ বলে ডাকতাম৷ বাবুর জন্ম , ১৯৪৮ সালে৷ দেশ সবে স্বাধীন হয়েছে৷ আমি তখন বাবা -মা ’র কাছে ছিলাম৷ ও বাড়িতেই জন্মেছে৷ ওর জন্মের পর আমার বাবা মনীশ ঘটক অসম্ভব আনন্দ পেয়েছিলেন৷ একদম শিশুর মতো হয়ে উঠেছিলেন৷ বলেছিলেন , তোমরা মনে রেখো , ওর সঙ্গে আমার বন্ধুত্বই সবার আগে হবে৷ মা যেন এর মধ্যে মাথা না গলান ! বাবু ছিল ‘তুতুল ’ মানে আমার বাবার বড়ো নাতি৷ কলকাতায় এলেই বাবুর জন্য বাবা চকোলেট আনতেন৷ ‘পাতাবাহার ’ আর ‘শিলালিপি ’ উপহার দিয়েছিলেন৷ বাপ্পা খুবই দুরন্ত ছিল৷ বাবা ওকে বাগে আনার চেষ্টা করতেন৷ পারতেন না৷ সত্তর দশকের গোড়ায় বাপ্পার ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না ’ প্রকাশিত হয়৷ বইটি পড়ে বাবা ওকে একটা পোস্ট কার্ডও পাঠান৷ লেখাটার বেশ তারিফ করেছিলেন উনি৷ বাপ্পার জন্মের পর বিজনও খুব খুশি ছিলেন৷ বাপ্পাকে নিয়ে ওঁর বাবা কত কবিতা আর গান যে বানিয়েছিলেন , তা বলে শেষ করা যাবে না৷ বিজন বলতেন , আমাকে একদম বাধা দেবে না৷ ছোটবেলায় শিশুরা মা -সর্বস্ব হয় ঠিকই , কিন্ত্ত এ ব্যাপারে বাবাকেও যথেষ্ট আমল দিতে হবে৷ মা তাকে যত ভালোবাসে , বাবা কিছু কম ভালোবাসে না !
রাহুল দাশগুন্ত : বাপ্পাকে যখন ছেড়ে এলেন , সেই সময়কার কথা কিছু যদি বলেন৷
মহাশ্বেতা দেবী : আমার ছেলের ১৪ বছর বয়সে স্বামীকে ছেড়ে এসেছিলাম৷ ঠিক করেছিলাম , একা থাকব৷ এমন নয় যে , বিজন আমাকে কোনো বাধা দিয়েছিলেন৷ উনি আমার সব কাজেই আমাকে অসম্ভব উত্সাহ দিয়েছেন৷ বলা যায়, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা৷ আমার অসম্ভব স্বাধীনতা ছিল৷ আমার সব কিছু, প্রতিটি কাজকর্মেই তিনি থাকতেন৷ মানুষ হিসাবে অসম্ভব খোলামেলা৷ আর একদম খাঁটি শিল্পী৷ কিশোর নবারুণ আর বিজনকে ছেড়ে আমি বালিগঞ্জ স্টেশন রোডে জ্যোতির্ময় বসুর গেস্ট হাউসের একটা ছোটো ঘর ভাড়া নিয়ে চলে আসি৷ মনে করেছিলাম , আমার ‘একলা হওয়া ’ খুব দরকার৷ একলা ছিলাম , এটাও সত্যি৷ সন্তান জন্মানোর পর নিজের সাধ্যমতো চেষ্টায় তাকে বড়ো করতে লাগলাম৷ এমন নয় যে , আমার সঙ্গে বিজনের কোনো বড়োসড়ো ঝগড়া হয়েছে৷ কোনো কথা -কাটাকাটিও হয়নি , যা হয়েছে সে যত্সামান্য মতবিরোধ৷ অত্যন্ত তুচ্ছ কারণে৷ বাট আই ওয়াজ ফোর্সড টু লিভ মাই সান৷ ১৪ বছর বয়সে সেই যে নবারুণকে ছেড়ে আসি , তারপর আর আমাদের একসাথে থাকা হয়নি বলতে গেলে৷ কিন্ত্ত ওকে ছেড়ে আসলেও ওর লেখাপড়ার খরচ ও অন্যান্য সব কিছুর দেখাশুনো সাধ্যমতো পিছন থেকে আমিই করতাম৷ বিজনও চেয়েছিল , যতটা সময় একসঙ্গে থাকা যায়৷ বিজনের দিক থেকে কোনও বাধাও ছিল না৷ বাপ্পার বাবা যেভাবে স্নেহ আর যত্নে ওকে মানুষ করেছিল , তার কোনও তুলনা হয় না৷ তারপর একটা সময় পর ওর বিয়েও হয়ে যায় , নিজের একটা স্বতন্ত্র পরিবারও হয়৷ বাপ্পার সঙ্গে যোগাযোগটা আমার ছিলই৷ তারপর ক্রমে সেই যোগাযোগ ক্ষীণ হতে শুরু করে৷ আমি মাঝে মাঝে চিঠি লিখতাম , উত্তর পেতাম না৷ সে সব কথা আজ আর তুলতেও ইচ্ছা করে না৷ আমি দীর্ঘ দিন যে বিজনকে ছেড়ে ছিলাম , তার পিছনে আমাদের দু’জনের মধ্যেকার ভুল -বোঝাবুঝি সম্পূর্ণ দায়ী৷ পরে এ -জন্য আমি যথেষ্ট অনুশোচনা করেছি৷ আর বাপ্পার সঙ্গে তো মনের দিক থেকে আমি সব সময়ই জড়িয়ে ছিলাম৷ ওকে যে আমি ইচ্ছা করে ছেড়ে এসেছিলাম , তা নয়৷ সবটাই আমার হাতের বাইরে চলে গেছিল৷ আমাকে দুনিয়া হয়তো খুব নিষ্ঠুর মা হিসাবেই দেখবে৷mohashata-debi
রাহুল দাশগুন্ত : নবারুণদার লেখা আপনার কেমন লাগতো ?
মহাশ্বেতা দেবী : খুব পজিটিভ আর খুব পাওয়ারফুল৷ কবিতা -গল্প -উপন্যাস , সবকিছুতেই ও দক্ষতা দেখিয়ে গেছে! ওঁর লেখা বেরোলেই আমি সাধ্যমতো জোগাড় করে পড়তাম৷ কারণ সেই লেখার মধ্যেই আমার ছেলেকে আমি খুঁজে পেতাম৷ ও যা লিখেছে , নিজের হাতে কলম দিয়ে লিখেছে , সেটাই আমার কাছে বিরাট পাওয়া৷ লেখক হিসাবে ও যে দাঁড়িয়েছে , এটা আমার কাছে একটা মস্ত বড় প্রান্তি৷ বাপ্পা তো অনেক লেখেনি৷ ওর লেখা ওর সমসাময়িকদের চেয়ে অন্য রকম , ভিন্ন স্বাদের ছিল৷ ও লিখতেই এসেছিল৷ ওর লেখা যে মানুষের ভালো লেগেছে , স্বীকৃতি পেয়েছে , এটাই তো সবচেয়ে ইতিবাচক ব্যাপার৷ ভবিষ্যতে ওর লেখা থেকে যাবে এটাই আমার সবচেয়ে বড় পাওনা৷
রাহুল দাশগুন্ত : বাবা না ছেলে , কার কথা আপনার বেশি মনে পড়ে ?
মহাশ্বেতা দেবী :  বাপ্পা , আমার ছেলের কথাই খুব বেশি করে মনে পড়ে৷ হ্যাঁ, বিজনের থেকেও বেশি৷ বিজন খুব আনন্দময় মানুষ ছিলেন৷ অসম্ভব দারিদ্রের মধ্যে বড়ো হয়েছেন৷ আমাকে উনি ভীষণ শ্রদ্ধা করতেন৷ আর নবারুণ ? আমি তার মা৷ অথচ আমরা তো বেশি দিন একসঙ্গে থাকি নি৷ ও আসলে বাবার খুব কাছের ছিল৷ ওদের দু’জনের কাছেই আমি একটা রিয়েলিটি৷ ‘অ্যাজ আ পার্সন আই এক্সিস্ট৷ ’ এটা ওদের দু’জনের কেউই অস্বীকার করতে পারবে না৷ মনে হয় , আমার বিষয়ে আমার ছেলে শুধুই ক্রিটিকাল ছিল না , ওর মধ্যে একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিংও ছিল৷ অ্যাট দ্য এন্ড অফ মাই লাইফ , আজ সেই হাহাকার নেই যে , তাকে চোখে দেখিনি কত দিন৷ এক সময় খুব মনে হতো , আমার ছেলেকে আমি জানতে চাই , তার সঙ্গে কথা বলতে চাই , তাকে আমার বাড়িতে আনতে চাই , কাছে পেতে চাই৷ ইচ্ছা করত , তার হাত ধরে নিয়ে আসি৷ সে -ও নিশ্চয়ই আমাকে গ্রহণ করবে , ভালোবাসবে৷ ‘হি ইজ বর্ন অফ মি ’, এই সম্পর্কটা তো কেউ কোনও দিন অস্বীকার করতে পারবে না ! অন্যরা দূর থেকেই আমার বিচার করে যাবে৷ কিন্ত্ত আমার ভিতরটা কি কেউ দেখতে পাচ্ছে ? কেউ জানে , আমার ভিতরে কী হয় ? দূর থেকে কত বার যে ওর কাছে ক্ষমা চেয়ে গেছি , নিজের ছেলের কাছে , ‘কনটিনিউয়াস ’, কেউ জানে তা ? কত বার মনে হয়েছে , আমি মা , আমারই তো আগে যাওয়া উচিত৷ ও আমার কাছে একটা মস্ত বড় রিয়েলিটি হয়ে ছিল , ও যে আছে সেটাই , মনে হতো , চাইলেই তো যে কোনও সময় গিয়ে ওর সঙ্গে দেখা করতে পারবো ! ও কেমন আছে , কী লিখছে , কী ভাবছে , এইসব চিন্তা আমাকে অস্থির করে তুলতো৷ আরও মনে হত , ও কি আমার কথা ভাবে ? আমি কেমন আছি জিগ্যেস করে ? আমার লেখা পড়ে ? ওকে যে সে ভাবে আমি কাছে পাই নি , তার মধ্যে আমারও ভুল অনেকটাই আছে৷ কিন্ত্ত বাপ্পা বা ওর বাবা আমাকে কখনও কোনও সমালোচনা করেনি৷ আজ মনে হয় , কেন করে নি ? করলে ভালো হত৷
রাহুল দাশগুন্ত :  নবারুণদাকে যাঁরা চেনেন না , তাদের জন্য যদি কিছু বলেন …
মহাশ্বেতা দেবী : বাপ্পা বই -পাগল ছিল৷ বই পড়তে ভীষণ ভালোবাসতো৷ ওর মতো ছেলের নিজস্ব একটা জগত্ থাকবেই৷ সেই জগতেই ও থাকত৷ ও একেবারে বইয়ের জঙ্গলের মধ্যে শিকারী হয়ে ঘুরে বেড়াতো৷ ওর চেনাজানা জঙ্গল ! বিজন নাটক লিখত , আমি গল্প -উপন্যাস৷ বাপ্পা শুরুই করেছিল কবিতা দিয়ে৷ ওর একটা কবিতা খুব মনে পড়ে , ‘একটা কথার ফুলকি উড়ে শুকনো ঘাসে পড়বে কবে / সারা শহর উথাল -পাথাল , ভীষণ রাগে যুদ্ধ হবে / ফাটবে চিবুক, পোড় খাবে বুক, একটা নদী উতল হয়ে ’, আর মনে পড়ছে না ! কিছু দিন পর ও খুব মন দিয়ে গল্প লিখতে শুরু করল৷
বই পড়ার পাশাপাশি ও খেতেও খুব ভালোবাসতো৷ মাংসের একটা রান্না আমি করতাম , পুরনো দিনের , রেজালা , সেটা ছিল ওর খুব পছন্দের৷ রেজালা ছিল কম ঝোলের , আর সেটাই বাপ্পা ভালোবাসতো৷ মাংসটাই বেশি মনে পড়ে৷ আমি তখন জীবনে খুবই ব্যস্ত৷ খুব যে গুছিয়ে রান্নাবান্না করে ওকে খাওয়াবো , সেটা আর হয়ে উঠতো না৷ রান্নাবান্না করতামও কালেভদ্রে৷ ও সিনেমা দেখতে খুব ভালোবাসত৷ কিন্ত্ত ওকে নিয়ে সিনেমা যাওয়া -টাওয়াও আমার খুব একটা হয় নি৷ ছোটবেলায় খুব দুরন্ত হলেও , ১২-১৩ বছর বয়স থেকেই ও যেন বদলে যেতে শুরু করলো৷ জীবনের ব্যাপারে খুব সিরিয়াস হয়ে গেল৷ অ্যাজ আ সিরিয়াস পার্সন , ওর নিজের ইনটিগ্রিটি , ওর নিজের ডেপথ গড়ে উঠেছিল৷ ও কী করতে চায় বা না চায় , সে বিষয়ে ওর নিজের মনেই খুব স্পষ্ট ধারণা তৈরি গেছিল৷ ওকে গভীর ভাবে চিন্তা করতে দেখতাম৷ বাপ্পা এই রকমই ছিল …গত দশ বছরে আপনাদের মধ্যে যোগাযোগ আর ছিলো না বললেই চলে …আসলে বাপ্পা ওর নিজের জীবন ও পরিবার নিয়ে আলাদা হয়ে গেছিল৷ আমার কাজ , আমার একাকিত্ব , আমার ব্যস্ততা নিয়ে আমিও সরে থেকেছি৷
মনে আছে , আমার নাতি তথাগতকে সমস্ত কলেজ স্ট্রিট তিন -চার দিন ঘুরে ঘুরে  বিভূতিভূষণের যত বই পেরেছি জোগাড় করে জন্মদিনে দিয়েছিলাম৷ কী মধুর স্মৃতি সেটা আমার জীবনের ! আমি তো ওদের সবাইকে নিয়েই থাকতে চেয়েছি৷ কিন্ত্ত শুধু পরিবার তো কখনও আমার জীবন ছিল না ! আমার অন্যান্য দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতা বরাবরই ছিল৷ সে ব্যাপারে কখনও আমার পরিবার নিজেদের জড়াতে চায়নি৷ আমি যখন বিভিন্ন আদিবাসী গ্রামে যেতে আরম্ভ করেছি , তখনও বাপ্পা আমার কাছে থাকে নি৷ বয়স হলে মা -বাবারা ছেলেমেয়েদের কাছেই থাকতে চায়৷ কিন্ত্ত আমার আর অতীতে ফিরে যেতে ইচ্ছা করেনি৷ দূর থেকেই আমার ছেলের খোঁজ নিতাম৷ ওর শুভকামনা করতাম৷ ওকে ভালোবাসতাম৷ ওর সাফল্য কামনা করতাম৷ কখনও মনে হতো , সব মিটিয়ে ফেলা যাক৷ আমিও আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করি৷ পরে বুঝতাম , সে আর হয় না৷ আর সে সব সম্ভব নয় ! শেষ বছরগুলোয় আর কোনও ভাবেই আমাদের দেখাসাক্ষাত্ সম্ভব হয়ে ওঠেনি ! অথচ ওকেই , আমার ছেলেকে , আজ সবচেয়ে বেশি দেখতে ইচ্ছা করছে৷