আত্মসমালোচনাঃ নেতৃত্বের সংকট, দুর্বল হতে থাকা ঘাঁটির কথা স্বীকার করে ক্যাডারদের প্রতি লড়াইয়ের ক্ষেত্র প্রস্তুত করার আহ্বান জানালেন ভারতের মাওবাদী প্রধান

b

পার্টির “বেশ কয়েকজন নেতাকে হারানোর” কথা স্বীকার করে সিপিআই (মাওবাদী) এর নেতৃত্বের সুরক্ষার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে এবং গ্রামীণ সমতল এলাকা শহর এলাকায় দুর্বল হয়ে পড়া আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ক্যাডারদের শক্তি যোগাতে প্রচারণা চালানোর বিষয়টির উপর গুরুত্ব আরোপ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

মাওবাদী তথ্য বুলেটিনের জন্য দেয়া অভ্যন্তরীণভাবে প্রচারিত এক সাক্ষাৎকারে সিপিআই (মাওবাদী) এর সাধারণ সম্পাদক মুপ্পালা লক্ষণ রাও ওরফে গণপতি পার্টির কাছে চ্যালেঞ্জগুলো উল্লেখ করে বলেন, “কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে শুরু করে গ্রাম পর্যায় পার্টি কমিটি পর্যন্ত আমরা বেশ কয়েকজন নেতাকে হারিয়েছি। সুতরাং, বর্তমানে যেসকল বাহিনী রয়েছে তাদেরকে শত্রুর হামলা থেকে সুরক্ষিত রাখা পার্টির সামনে অন্যতম মুখ্য কাজ হিসেবে আমরা চিহ্নিত করেছি”।

“নেতৃত্বকে” সুরক্ষা প্রদানের বিষয়টির উপর গুরুত্ব আরোপ করে গণপতি ‘নতুন নেতৃত্বকে প্রস্তুত করতে এবং সফল বিপ্লবের শর্ত হিসেবে নেতৃত্বের ধারাবাহিকতায় একটি শক্তিশালী দলের লক্ষ্যে সচেতনতা গড়ে তোলার” আহ্বান জানিয়েছেন।

গণপতি দলের সক্রিয় কর্মীদের গণ আত্মসমর্পণের কথা স্বীকার করেন তবে এটি সরকারের ‘উন্নত আত্মসমর্পণ নীতিমালার’ ফলে ঘটেছে এমনটা তিনি অস্বীকার করেন।

তিন চতুর্থাংশের বেশি গণ আত্মসমর্পণের ঘটনার পিছনে রয়েছে সক্রিয় সদস্যদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে তাদের উপর তীব্র অত্যাচার, ধর্ষণ, সম্পদ ধ্বংস, মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ, হত্যা ও জখমের হুমকি ইত্যাদি।”

তিনি বলেন পিপলস লিবারেশন গেরিলা আর্মি (PLGA)  ও গণ সংগঠনের কিছু সদস্য ” শত্রুদের কাছে অবনত হচ্ছে। হ্যাঁ, সাম্প্রতিক সময়ে এই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। রাজ্য, জেলা ও এরিয়া কমিটি থেকেও কয়েকজন আত্মসমর্পণ করেছে”।

এই সবকিছুর সমাধান হল সকল পর্যায়ের ক্যাডারদের ভেতরে রাজনৈতিক সচেতনতা ও অঙ্গিকার গড়ে তোলা। বলশেভিকীকরণ ক্যাম্পেইনে এ বিষয়টি নিয়ে কাজ চলছে।”

গণপতি বলেছেন বহুদিন ধরে যেসব এলাকায় মাওবাদী পার্টি সক্রিয় ছিল সেসব এলাকায় পার্টি দুর্বল হয়ে পড়েছে। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “আমাদেরকে আরো নতুন নতুন এলাকায় আন্দোলনের বিস্তার ঘটাতে হবে ও নতুন যুদ্ধক্ষেত্র শুরু করতে হবে”।

সকল স্তরে “সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ” করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন বলশেভিকীকরণ (বিপ্লবী অঙ্গিকার) ক্যাম্পেইনকে জোরদার করার প্রয়োজন ছিল। “শত্রুর হামলা বৃদ্ধি পাওয়া, পার্টিতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার কারণে আন্দোলন কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি  হচ্ছে, এ কারণে ক্রমবর্ধমান প্রলেতারিয়েত বিমুখ ধারার পরিপ্রেক্ষিতে প্রলেতারিয়েত ধারার বৃদ্ধি ঘটাতে হবে”।

তিনি “মোদী সরকার ও সাং পরিবারের সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদ পন্থী প্রোপাগান্ডার বিরুদ্ধে ব্যাপক আকারে প্রোপাগান্ডা” চালানোর ব্যাপারে উৎসাহ প্রদান করেন কারণ এতে করে “নয়া উদারপন্থী ও হিন্দুত্ব নীতিমালার ফলে দলিত,  মুসলমান ও শ্রমজীবী শ্রেণীর উপর অন্যায়ের ক্ষেত্র তৈরী হয়”।

তিনি বলেন,  “নাগরিক অধিকার আন্দোলনকে গড়ে তোলা ও শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে ভাল সম্ভাবনা রয়েছে”।

অপারেশন গ্রিন হান্টের তৃতীয় পর্যায়কে মোকাবেলার ক্ষেত্রে পার্টি কী ধরণের প্রস্তাবনা রেখেছে এ প্রশ্নের উত্তরে গণপতি বলেন, “মোদী সরকারের গণ বিরোধী এজেন্ডার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত সকল স্তরের জনগণকে দৃঢ়ভাবে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। এর জন্য, আমাদের নীতিমালা ও কৌশল এমন হতে হবে যেন সকল গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল, ধর্মনিরপেক্ষ ও দেশপ্রেমিক শক্তি উজ্জীবিত হয়ে একত্রে জনগণের পক্ষে মোদির প্রতিক্রিয়াশীল নীতিমালার বিশেষ করে অপারেশন গ্রিন হান্টের তৃতীয় পর্যায়ের বিরোধিতা করে ও পাল্টা লড়াই চালায়। সংসদীয় বামধারার রাজনৈতিক দলগুলোকেও জনগণের ইস্যুকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে চাপ প্রয়োগ করা হবে। শত্রুর বহুমুখী অত্যাচারের বিরুদ্ধে সকল লড়াইয়ের ক্ষেত্র থেকে সকল শক্তিকে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার আহবান জানান।

সূত্র – 

http://indianexpress.com/article/india/india-others/maoist-chief-admits-to-loss-of-leaders-weakening-base-asks-cadres-to-open-fronts/2/


ভারত- ”দীর্ঘস্থায়ী গণযুদ্ধ আসন্ন” সতর্কবাণী জানালেন সিপিআই (মাওবাদী) এর শীর্ষ নেতা গণপতি

india-ganapathi

মাওবাদী তথ্য বুলেটিনকে(MIB) দেয়া এক সাক্ষাৎকারে দলের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে বলেছেন সিপিআই (মাওবাদী) এর সাধারণ সম্পাদক গণপতি

“ক্ষমতায় আসার পর বিজেপি বিদেশের ও ভারতের বৃহৎ পুঁজিপতি ও ভূস্বামীদের স্বার্থ রক্ষার্থে তীব্র গতিতে সাম্রাজ্যবাদপন্থী, দেশ বিক্রির নীতিমালার বাস্তবায়ন ঘটাচ্ছে ও একই সাথে বিভিন্ন পায়তারায় হিন্দু- ফ্যাসিবাদী এজেন্ডাকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। সুতরাং এই অবস্থায়, সকল গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল, ধর্মনিরপেক্ষ ও দেশপ্রেমিক শক্তিগুলোর ঐক্যবদ্ধ হওয়া জরুরী। আরো নতুন শ্রেণী, সামাজিক ক্ষেত্র ও শক্তিকে সংগ্রামের যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে আসতে হবে ও এতে করে গণযুদ্ধের জন্য নতুন সুযোগের দ্বার উন্মুক্ত হবে। “বিপ্লবের জন্য বিশ্বের সর্বত্র পারিপার্শ্বিক অবস্থা ক্রমাগত অনুকূল হচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব অর্থনীতি এখনো পর্যন্ত গুরুতর সংকটের মধ্য দিয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে এবং বিশ্বে সমস্ত মৌলবাদী বিরোধীতাগুলো তীব্র আকার ধারণ করছে। ফলস্বরূপ, বিশ্বের সর্বত্র বিপ্লবী, গণতান্ত্রিক ও জাতীয় মুক্তিকামী শক্তিগুলো সাম্রাজ্যবাদ ও এর অভ্যন্তরীণ খুঁটিগুলোর বিরুদ্ধে শক্তি অর্জন করছে। মাওবাদী শক্তিগুলোও একীভূত হচ্ছে”।

পিএলজিএ (Peples Liberation Guerilla Army) এর উন্নয়নকে তরান্বিত করা ও গেরিলা যুদ্ধকে আরো তীব্র করে তুলতে দলের পরিকল্পনা বিষয়ে গণপতি বলেন, “শত্রু যখন পাল্টা কোন কৌশল গ্রহণ করে, তখনই একটি নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে। তাই আমাদেরকে এমন কৌশল অবলম্বন করতে হবে যা গেরিলা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে শত্রুর উচ্চতর বাহিনীকে মোকাবেলা করতে ও জনগণকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করতে আমাদের জন্য সুবিধাজনক হবে। গেরিলা যুদ্ধ গড়ে তোলা ও উন্নয়ন ঘটানোর ক্ষেত্রে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবে আমাদের গণ ভিত্তিকে মজবুত করা”।

বলশেভিকীকরণ ক্যাম্পেইনের গুরুত্ব প্রসঙ্গে এ শীর্ষ মাওবাদী নেতা বলেন, ২০১৩ সালে পার্টিকে বলশেভিকীকরণের জন্য পার্টি থেকে আহ্বান জানানো হয়েছিল এবং পার্টির অভ্যন্তরে, পিএলজিএ ও গণ সংগঠনগুলোর মধ্যে এ বলশেভিকীকরণ প্রক্রিয়া চালানো হয়েছে। “ এ প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে আরো সময়ের প্রয়োজন এবং কেবল তখনই পার্টির বলশেভিকীকরণের সাফল্য সম্পর্কে আমরা মূল্যায়ন করতে পারব”।

বুর্জোয়া শ্রেণীকে উৎখাত করে রুশ বলশেভিক পার্টি (CPSU-B) (Communist Party of The Soviet Union-Bolsheviks)প্রথম বারের মত প্রলেতারিয়েত একনায়কত্ব কায়েম করে। গোটা বিশ্বে যে সময় কোন কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় ছিল না, সেসময় এই পার্টি সংগ্রামী জনগণকে ক্ষমতায় আসীন করেছিল। বলশেভিক পার্টি মানব ইতিহাসে সর্বপ্রথম সমাজতন্ত্রের সূচনা করে। কাজেই আমরা এ পার্টিকে আমাদের মডেল হিসেবে  গ্রহণ করেছি এবং এ পার্টি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে এর সমস্ত গুণাবলীগুলোকে আত্মস্থ করে আমাদের পার্টিকে এরকম একটি  প্রলেতারিয়েত পার্টিতে রূপান্তরিত করার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছি”।  তিনি আরো বলেন, এ কারণে এর নামকরণ করা হয়েছে বলশেভিকীকরণ ক্যাম্পেইন।

“অন্যদিকে, মাওবাদীদের জন্য চায়নার কমিউনিস্ট পার্টির মডেলটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ চায়না ও ভারতের মধ্যে বেশ কিছু বিষয়ে মিল রয়েছে। চায়না কমিউনিস্ট পার্টির (CPC) যে বৈশিষ্ট্যগুলো আধা উপনিবেশিক, আধা সামন্তবাদী অনগ্রসর দেশ চায়নাতে বিপ্লবকে সাফল্যমন্ডিত করেছে ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে সেই বৈশিষ্ট্যগুলো জানা ও আত্মস্থ করা প্রয়োজন। দেশটির গণযুদ্ধের লাইন গড়ে তোলা ও পিপলস আর্মি গঠন করা, একটি সফল ইউনাইটেড ফ্রন্ট স্থাপন করা ও মুক্তাঞ্চল তৈরী করার পিছনে রয়েছে চায়নার সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক সম্প্রদায়। গঠিত হবার পর থেকেই চায়না কমিউনিস্ট পার্টি CPSU(B) পার্টিকে মডেল ধরে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধির অবিরত প্রচেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে”।

গণপতি বলেন, আমরা এই ক্যাম্পেইনটি চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমাদের পার্টির দীর্ঘ বিপ্লবী ইতিহাস থেকে অর্জিত অভিজ্ঞতার আলোকে পার্টির বলশেভিকীকরণের প্রশ্নে আমরা এই দুটি পার্টিকে আমাদের মডেল হিসেবে বিবেচনা করব।

সূত্রঃ Express News Service, 17th March 2015